শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৩

মৌলবাদীদের নারীবিদ্বেষ এবং রাজনীতির অপকৌশল

ড. ইশা মোহাম্মদ
খুব জোরেশোরে আওয়াজ দিয়ে মৌলবাদীরা শুরু করেছে তাদের সাম্প্রতিক অপতৎপরতা। অনেক আগে থেকেই তারা বিভিন্ন রকম অপকৌশল প্রয়োগ করেছে এবং অধিকাংশই ছিল জামায়াতকেন্দ্রিক। জামায়াতের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষতা ছিল ্প্রতিটি কর্মকা-ে। সহজেই চেনা যেত তাদের মৌলবাদী অপতৎপরতাকে। কিন্তু এবার তারা ভিন্নবেশে অবির্ভূত হয়েছে ধর্মীয় লেবাসে নারীবিদ্বেষকে উপজীব্য করেছে।
হেফাজতে ইসলাম নাম ব্যবহার করে তারা ইসলামের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকেই ধ্বংস করার অপচেষ্টয় লিপ্ত। ইসলামে সকল মানুষকেই সমান বলা হয়েছে এমনকি নারী-পুরুষকেও পার্থক্য করা হয়নি। হেফাজতে ইসলাম ইসলামী লেবাসে অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুশীলনের নিদর্শনস্বরূপ নারীবিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গির অনুশীলন করছে। তারা বাংলার মুসলমানদের মধ্যে যে পরমত সহিষ্ণুতা আছে, পরধর্মের প্রতি যে শ্রদ্ধা আছে এবং সর্বোপরি যে স্বাভাবিক সামাজিক সহনশীলতা আছে তাকে ধ্বংস করে একটি বিশৃঙ্খল সামাজিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। বিশৃঙ্খল সামাজিক পরিস্থিতিতে তারা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চায়। কি সেই রাজনৈতিক ফায়দা? স্পষ্টতই বোঝা যায়, তারা আওয়ামী লীগকে দুর্বল রাজনৈতিক দলে পরিণত করতে চায়। কিভাবে? যে কোন সিদ্ধান্তই বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতাকে জনগণের সামনে উপস্থাপনের মাধ্যমে তারা প্রমাণ করবে, আওয়ামী লীগ পরমতসহিষ্ণুতায় ভুগছে। তাদের পক্ষে কোন কিছুই করা সম্ভব নয়। যেমন সংবিধানকে পুরোপুরি সেক্যুলার করতে পারেনি। শাহরিয়ার কবিরসহ অনেকেই সে জন্য আওয়ামী লীগকেই দোষারোপ করছে। এখন চলছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এ বিচারের কোন ফল যাতে ফলতে না পারে সেদিকেই তারা গুরুত্ব দিয়েছে। পদ্মা সেতু যাতে না করতে পারে সেদিকেও তারা নানান ধরনের কুতৎপরতরা দেখিয়েছে।
বাংলার জনগণের সাধারণ সম্পদ তেল ও মূল্যবান খনিজ রক্ষায় যাতে ব্যর্থ হয় সে ব্যাপারেও তারা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাদের মূল উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের কাছে আওয়ামী লীগকে অপাঙক্তেয় করা। তারা তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে: যেমন নারী স্বাধীনতার মূলসূত্র সম্পত্তির সমান হারে উত্তরাধিকার বিষয়ক শেখ হাসিনার উদ্যোগকে তারা ব্যর্থ করে দিয়েছে। সে সময়েও ধর্মীয় উন্মাদনাকেই তারা ব্যবহার করেছে। আবার এখন হেফাজতে ইসলাম ধর্মীয় উন্মাদনাকেই ব্যবহার করছে; যাতে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের পতন হয়।
যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা সামলানো যথেষ্ট কষ্টকর হলেও অসম্ভব নয়। ধর্মীয় উন্মাদনায় বিভোর হয়ে তারা নারীবিদ্বেষী কালোরূপ প্রকাশ করেছে। এটি আবার আওয়ামী লীগের জন্য শাপেবর হয়েছে। বাংলার আপাময় নারীজাতি ক্ষেপেছে। তারা মনে করছে, যেটুকু স্বাধীনতা তারা পেয়েছিল তা তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হবে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত নারীসমাজ চাকরিবাকরি করে যৎসামান্য আয়-রোজগার করে সংসারে স্বল্পমাত্রায় হলেও সচ্ছলতা এনেছিল তারা ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। আফগানিস্তানের মতো তাদেরকে চাকরিচ্যুত করা হবে। এই দুর্মূল্যের বাজারে তারা সংসার চালাবে কি করে? কোন কোন সংসারে মেয়েরাই একমাত্র উপার্জনক্ষম। অনেক পরিবারে স্ত্রীর উপার্জনে সংসার চলে; স্বামীরা বিভিন্ন কারণে উপার্জন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। বাপ, মা, ছেলেমেয়েসহ পুরো পরিবারটিই ঐ মহিলাই চালাচ্ছে। হেফাজতে ইসলামের হুঙ্কার সম্প্রতি এদের প্রতিই। এর চেয়েও বড় সমস্যা ঘটেছে মনস্তাত্ত্বিক অঙ্গনে। বাংলাদেশের সকল মহিলাই ভাবছে ইসলাম ধর্মই মনে হয় নারীবিদ্বেষী। তাই যদি স্থায়ী হয়ে যায় তবে মুসলিম সমাজটিই ক্যান্সার আক্রান্ত হবে। প্রতিটি পরিবারই সংগোপনে ধর্মের প্রতি অনাসক্ত হয়ে যাবে। এমনও হতে পারে অবস্থাÑমেয়েরা দেশের বাইরে চলে যাবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে বাঙালী মুসলিম সমাজে। মেয়েদের মনোবল ভেঙ্গে যাবে এবং অনেকেই মানসিক বৈকল্যতায় ভুগবে। বাঙালী মুসলিম সমাজ অসুস্থ ও বিকৃত মানবিকতায় আক্রান্ত হলে এবং সমগ্র নারীজাতি অন্ধকারের প্রতি আত্মসমর্পণ করলে তার কুপ্রভাবে জাতীয়ভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক শক্তি মেরুদ-হীন হয়ে যাবে। এমন ধরনের মেরুদ-হীন সামাজিক বৈকল্যের সমাজ তাদের রাষ্ট্ররক্ষায় এবং নিত্যভূমিকা রাখতে পারে না। কেননা রাষ্ট্র্র্রশক্তি ও মানসিক বৈকল্যতায় আক্রান্ত হয় এবং রাষ্ট্ররক্ষার চেয়েও আত্মসর্পণকেই শ্রেয় মনে করে, বিধির বিধান হিসেবে মেনে নেয়। মধ্যযুগের শুরুতে ভারতের ইতিহাস এক্ষেত্রে পাঠযোগ্য। কার্লমার্ক্স বলেছেন, সামাজিক এবং মানসিকভাবে ভারত বিজিত হওয়ার জন্য তৈরি ছিল। ভারতের একটি ভাল হয়েছে যে, রুশ-চীন কিংবা জার্মানির উপনিবেশ না হয়ে ইংরেজের উপনিবেশ হয়েছে। তার ধারণা হয়েছিল, ইংরেজ ব্যতিরেক অন্য যে কেউ আরও বেশি শোষণ-নির্যাতন করত। মার্ক্সের মতামত আপনারা গ্রহণ নাও করতে পারেন। তবে এটা তো মানতেই হবে যে, ইংরেজরা আসার আগে মোগলরা ভারত জয় করেছিল এবং তার আগে পাঠানদের দ্বারা বাংলাদেশও বার বার বিজিত হয়েছিল। বিদেশীদের কাছে ঐ সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক বৈকল্যের কারণে আপনারা স্পেনের মুসলিম সভ্যতার পতনের ইতিহাসও জানেন। খুটিয়ে খুটিয়ে পড়লে চানতে পারবেন সামাজিক বৈকল্যের কাহিনী। স্পেনের মুসলিম শাসনকালের এক পর্যায়ে রাষ্ট্রশক্তি বৈকল্যতায় ভুগতে থাকে। সভ্যতার ইতিহাসবিদরা মনে করেনÑমুসলমানদের হাতে বিজ্ঞান যেভাবে এগিয়েছিল, মুসলিম সমাজ সেভাবে অগ্রসর হয়নি এবং সমগ্র নারীজাতি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। তার প্রভাবে পুরুষরাও মেরুদ-হীন হয়ে এমন কদর্য মানসিকতায় আক্রান্ত হয়েছিল যে যন্ত্রণাহীন মৃত্যু কামনা করে ঘুষ দেয়ার ঘটনাও ঘটত।
নারী জাতিকে অন্ধকারের গহ্বরে নিক্ষিপ্ত করে নিজেরাই অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিল। তার পরিণতি হয়েছিল খারাপ। তারা শুধু তাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বই হারায়নি, মুসলমান হিসেবে শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল তাদেরই দ্বারা, যারা মুসলমানদের কাছ থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিখেছিল। দুয়ের মধ্যে পার্থক্য ছিল একটাই। খ্রীস্টানদের নারীজাতি অধিকতর দৃঢ় ছিল মুসলিম নারীজাতির চেয়েও। ইতিহাসের এই পাঠ কেউ পড়ে না। ইতিহাসের বাঁকাপাতা পড়ে সবাই মুগ্ধ হয়, সোজাপাতা পড়ে কেউ শিক্ষিত হতে চায় না। এই ধর্মীয় উন্মাদনাও নারীবিদ্বেষের কারণে কি বাংলায় তমসার যুগ নেমে আসবে? এরশাদ যখন ধর্মীয় উন্মাদনায় অংশ নিয়ে উদ্বাহু হয়ে নৃত্যগীত শুরু করেছে তখন সন্দেহ হয় রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য অনেকেই ধর্মীয় উন্মাদনাকে তাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইবে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলও মনে করতে পারে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ধর্মীয় উন্মাদনাকে ব্যবহার করলে সুফল পাওয়া যাবে। যদি পক্ষ-প্রতিপক্ষ সবাই উন্মাদনা ব্যবহার করতে উন্মাদ হয়ে যায় তবে পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
সুফল কিছুই পাওয়া যাবে না। কিন্তু কুফল ফলবে অনেক। তার ফলে কালক্রমে জাতি সার্র্বভৌমত্ব হারাবে এবং অন্য জাতির গোলাম হয়ে যাবে।
বর্তমান যুগে নারী স্বাধীনতা একটি স্বাভাবিক বিষয়। স্বাভাবিকতার বিরুদ্ধাচারীরা প্রকৃতিরই বিরুদ্ধাচারী। ইদানীং এরশাদ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য দেশ ও জাতির মানসের বিপরীত স্রোতে অবস্থান নিয়েছেন। এক সময় তিনি স্বৈরাচারী ছিলেন এক কথা এখন তার প্রতিপক্ষরা এখনও বলেন। মহাজোটে যোগদান করে তিনি কিঞ্চিৎ দেশসেবা করে সে অপবাদ কিছুটা ঘোচাতে চেষ্টা করেছেন। তার পূর্বের পাপাচার সাধারণ মানুষ সামান্য পরিমাণে হলেও ক্ষমা করেছে। ক্ষমা পেয়েই যদি তিনি আবার আগের রূপে ফিরে যান তবে বুঝতে হবে যে, তিনি বদলাননি। তার তো ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, তিনিই সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম বিষয়ক জটিলতা সৃষ্টি করেছিলেন। যার দায় পুরো জাতিকেই বহন করতে হচ্ছে। তিনি যদি পূর্বের ন্যায় ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন তবে জাতির কাছে চিরকালের জন্য কলঙ্কিত হয়ে থাকবেন। এ ধরনের স্বপ্ন মরীচিকা হবে এবং বাঙালী জাতির অর্ধেক নারীজাতি তাদের ঝাটাপেটা করবে।এখন শুধু অপেক্ষার পালা।
নির্বাচনে এবার মহিলাদের ভোট ও তরুণ প্রজন্মের মতই নির্ধারক হবে। গতবার হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ মহাজোটের একটি শর্ত হয়েছিল। কিন্তু নির্ধারক নয়। তরুণ প্রজন্মই ছিল এর নির্র্ধারক। এবার তার সঙ্গে যোগ হয়েছে মহিলারা। আমার মনে হয় আওয়ামী লীগ যে পরিস্থিতিতেই নির্বাচনে যাক না কেন জয় তাদের জন্য সহজ। কেননা, নারী সমাজ সাধ করে মধ্যযুগের বর্বরতায় আত্মসমর্র্পণ করবে না এবং নবীন-কিশোররাও তাদের মায়ের কথা ফেলবে না। তাহলে ভোটের ফলাফল কি হতে পারে?
যারা মধ্য যুগে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবেন তাদের আবারও ভাবতে হবে। তারা জনতার কাতারে নাকি রাজনীতির দুষ্ট মানুষদের সঙ্গে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন