শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৩

গো. আযম কামারুজ্জামানের রায়ের পর সহিংসতার প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত

মানুষের সমর্থন নাও পেতে পারে
এ আশঙ্কায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে
যোগাযোগে ব্যস্ত
জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ জামায়াতের সাবেক আমির ঘাতককুল শিরোমণি গোলাম আযম ও আরেক নেতা কামারুজ্জামানের বিচারের রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ হলেই নাশকতায় নামবে জামায়াত-শিবির। দুই নেতার বিচারের রায়ের প্রস্তুতির খবরে জামায়াত-শিবির আবারও সহিংসতার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জামায়াত এবার ধরেই নিয়েছে রায় হচ্ছে মৃত্যুদ-, তাই বিকল্প কোন চিন্তায় যাচ্ছে না উগ্রবাদী এ দলটি ও তাদের সমর্থনপুষ্টরা। পরিকল্পনা গোপন হলেও ইতোমধ্যেই বেরিয়ে পড়েছে রায়কে কেন্দ্র করে তৈরি জামায়াতের নাশকতার ছক। জানা গেছে, আগে রায়ের দিন থেকে হরতালে গেলেও এবার ট্রাইব্যুনালে রায়ের তারিখ ঘোষণা হলেই হরতাল দিয়ে তা-ব শুরু করা হবে। এরপর রায়ের দিন থেকে লাগাতার হরতালের ঘোষণা দিয়ে দেশজুড়ে শুরু করা হবে তা-ব। শক্তিশালী অবস্থান থাকা জেলাগুলোকে অবরুদ্ধ করে রাখা হবে। হামলা হবে পুলিশসহ সরকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর। এদিকে নাশকতায় এবার ঢাল হিসেবে জামায়াত ও হেফাজত নেতাদের মহিলা মাদ্রাসার নারীদের মাঠে নামানোর অপকৌশল নেয়া হয়েছে।
ইতোমধ্যেই রায়কে কেন্দ্র করে জামায়াত ও তাদের সমর্থনপুষ্টদের নাশকতার বিষয়ে সরকারকে অবগত করেছে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। বৃহস্পতিবার সরকারের একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেছেন, ইতোমধ্যেই নাশকতার বিষয়ে সরকারকে বিভিন্নভাবে অবগত করা হয়েছে। এছাড়া আরও কিছু বিষয়ে দু-একদিনের মধ্যেই রিপোর্ট আকারে সরকারের কাছে তুলে ধরা হবে। সূত্রগুলো বলছে, হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে সক্রিয় ১৮ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে ইতোমধ্যেই কয়েক দফা আলোচনা করেছে জামায়াত-শিবির নেতারা। পুলিশের খাতায় পলাতক থাকলেও বৈঠকে ছিলেন এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান ও ঢাকা মহানগর সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম বুলবুল। গত কয়েক মাস ধরে এই নুরুল ইসলাম বুলবুলই হেফাজত নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। এমনকি লংমার্চসহ নাশকতার পরিকল্পনা নিয়ে তার সঙ্গে হেফাজতের তিন নেতার টেলিফোনে আলাপও ইতোমধ্যে ধরা পড়েছে। ১৮ দলের শরিক ও হেফাজতের ব্যানারে থাকা উগ্রবাদী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ইতোমধ্যেই মহিলা মাদ্রাসার নারীদের মাঠে নামানোর বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছে বলেও জানা গেছে। হেফাজত নেতারা নারীদের মাঠে নামানোর কথা স্বীকার করলেও দাবি করছেন, এর সঙ্গে জামায়াত নেতাদের বিচার ও আন্দোলনের সম্পর্ক নেই। জামায়াত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের শাস্তি নিয়ে আবারও সহিংসতা চালাবে দলটি। গোলাম আযম ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিচার কার্যক্রম শেষ হয়েছে। যে কোন দিন রায় ঘোষণা হতে পারে। সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় এ রায় নিয়ে সহিংসতা চালানোর বিষয়টি সকলেই এক প্রকার নিশ্চিত। জামায়াতের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, আগের রায়গুলোর দিন থেকে হরতালসহ তা-ব শুরু করলেও এবার কিছুটা ব্যতিক্রম অবস্থানে যেতে পারে দলটি। এবার যেদিন রায়ের তারিখ ঘোষণা করা হবে সেদিনই হরতালের ডাক দিয়ে মাঠে নামতে চায় দলটি। তারিখ যেদিন ঘোষণা হবে তার পরদিন হরতাল পালনের বিষয়টি চূড়ান্ত করেছে জামায়াত-শিবির। এছাড়া যেদিন রায় ঘোষিত হবে, সেদিন হরতাল দেয়া হবে। এরপর পরিস্থিতি বুঝে টানা হরতাল দেয়া হতে পারে। তবে একাধিক জামায়াত নেতা বলেন, এবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার বিষয়টিও তাদের ভাবতে হচ্ছে। বিএনপি রায় নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে থাকবে কি না তাও নিশ্চিত নয়। তা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগের চেয়ে অনেক বেশি তৎপর।
জামায়াত নেতারা বলছেন, তারা আপাতত আন্দোলনে (সহিংসতা) অংশ নিতে কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করা, তহবিল গঠন, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ রক্ষার কাজ করছেন। রায়ের তারিখ নির্ধারণ হলেই মাঠে সক্রিয় হবেন তাঁরা। প্রত্যেক নেতাই বলছেন, এটা তাঁদের অস্তিত্বের বিষয়। দলের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেছেন, জামায়াত নেতাদের দ-িত করে রায় দেয়া হলে তা মানবে না দলটি। দেশের মানুষ জানে, জামায়াত নেতারা নির্দোষ। তাঁদের এক মিনিট সাজা দেয়া হলেও মানুষ তা মানবে না। এদিকে বৃহস্পতিবার বিকেলে নয়াপল্টনে ১৮ দলের সমাবেশে শিবিরের সাবেক এ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সতর্ক করে বলেছেন, আইন করে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা যাবে না। যতই আইন করুন, গণমানুষের মন থেকে জামায়াত-শিবির ও তাদের নেতাদের মুছে ফেলতে পারবেন না। জামায়াত-শিবির রাজপথে থাকবে, জীবনবাজি রেখে হাসিনা সরকারের পতন করব। জামায়াত নেতার দাবি, চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে জামায়াত-শিবির নয়, জনগণ আওয়ামী লীগকে প্রতিরোধ করেছে। সরকারকে হুমকি দিয়ে তিনি বলেন, আগামীতে হরতাল দিয়ে আপনাদের বের হওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হবে। চলতি মাসের শেষ দিকে কামারুজ্জামান ও আগামী মাসে গোলাম আযমের রায় হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শীঘ্রই অন্তত একজনের রায়ের তারিখ ঘোষণা হতে পারে। তার তারিখ ঘোষণা হলেই নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা করবে বিএনপির রাজনৈতিক মিত্র জামায়াত-শিবির।
এদিকে সাঈদীর রায়ের মতো মাঠ পর্যায়ে এবার প্রতিক্রিয়া নাও হতে পরে বলে দুশ্চিন্তায় আছেন জামায়াত নেতারা। জামায়াত নেতারা মনে করেন, জামায়াতের কর্মী-সমর্থকের বাইরে গ্রামাঞ্চলে সাঈদীর বেশ ভক্তগোষ্ঠী রয়েছে। সাঈদীর রায়পরবর্তী ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সময় তাদের পাশে পাওয়া গিয়েছিল। গোলাম আযম ও কামারুজ্জামানের ওই রকম সাধারণ সমর্থক নেই। তাদের সাজা হলে দলীয় কর্মী ছাড়া আর কেউ এগিয়ে আসবে না। এ বাস্তবতা মাথায় রেখেই কর্মীদের বেশি সক্রিয় করার কৌশল এবার জামায়াতের। তবে জামায়াত নেতারা মনে করেন, সাঈদীর মতো ভক্ত না থাকলেও গোলাম আযমের আন্তর্জাতিক পরিচিতি রয়েছে। দীর্ঘদিন দলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রক্ষার দায়িত্ব পালন করায় কামারুজ্জামানেরও পরিচিতি রয়েছে। এ পরিচিতি কাজে লাগিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি দেশ, তুরস্ক ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে জামায়াত। জামায়াত সমভাবাপন্ন রাজনৈতিক দল তুরস্ক, মিসর ও তিউনিসিয়ায় ক্ষমতাসীন। এ দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। গোলাম আযমকে যেন মৃত্যুদ- দেয়া না হয়, তার জন্য এসব দেশের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির কথাও শোনা যাচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, সাঈদীর রায়ের পর সহিংসতা মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি ছিল না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। কিন্তু এবার রায়ের আগে থেকেই ব্যাপক প্রস্তুতি নেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ইতিমধ্যে জামায়াতের রাজশাহী, সিলেট ও খুলনা মহানগরের আমির গ্রেফতার ছাড়াও নরসিংদী, ভোলা, কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার আমিরকে আটক করা হয়েছে। আগের রায়ের পর নাশকতায় এরা সক্রিয় ছিল। রায়ের তারিখ যত ঘনিয়ে আসবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা তত বাড়বে। জামায়াত-শিবির কর্মীদের এবার সহসা সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দেয়া হবে না। এবারের আন্দোলন নিয়ে জোট শরিক বিএনপিকেও আনুষ্ঠানিকভাবে পাশে পাওয়া যাবে না বলে মনে করে জামায়াত। তাই নিজ শক্তির ওপর ভরসা রাখতে হচ্ছে জামায়াতকে। বাছাইকৃত কর্মী, সাথী ও সদস্য প্রার্থীদের নিয়ে টিএস ও এটিএস (শিক্ষা শিবির) আয়োজন করা হচ্ছে। আন্দোলনের নামে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য জরুরী তহবিলও গঠনের কাজ চলছে। জামায়াতের রুকন ও কর্মীরা মাসে যে টাকা ইয়ানত (মাসিক চাঁদা) দেন দলীয় তহবিলে, তার অন্তত ১০ গুণ এককালীন হিসেবে দিতে হচ্ছে। রায়পরবর্তী সহিংসতায় নিহত দলীয় কর্মী-সমর্থকদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেয়া, আহতদের চিকিৎসা করা ও আটক কর্মী-সমর্থকদের জামিন করাতে এ অর্থ ব্যয় করা হবে। এদিকে নাশকতায় এবার ঢাল হিসেবে জামায়াত ও হেফাজত নেতাদের মহিলা মাদ্রাসার নারীদের মাঠে নামানোর অপকৌশল নেয়া হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে সক্রিয় ১৮ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে ইতোমধ্যেই কয়েক দফা আলোচনা করেছে জামায়াত-শিবির নেতারা। জানা গেছে, হেফাজত নেতারাও তাদের ১৩ দফা দাবির সমর্থনে মাঠে নামাতে চায় হেফাজতে ইসলামের মহিলা কর্মীদের। মহিলা মাদ্রাসাগুলোতে মহিলা কর্মীদের সংগঠিত করার কাজ চলছে বলে জানা গেছে। দেশের ইসলামী সংগঠনগুলোতে নারীদের কর্মকা- তেমন না থাকলেও সম্প্রতি হেফাজতের ১৩ দফা বিশেষ করে ৪র্থ দাবিটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এ দাবিকে মধ্যযুগীয় বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, সারাদেশে জামায়াত ও হেফাজত নেতাদের পরিচালিত সব মহিলা মাদ্রাসাকে কাজে লাগাতে চায় জামায়াত ও হেফাজত নেতারা। জামায়াতের পক্ষে নামা নিয়ে অবশ্য হেফাজতের কয়েক নেতার আপত্তি আছে। হেফাজতে ইসলামের প্রচার সচিব মাওলানা মুনীর আহমদ নারীদের মাঠে নামানোর কথা স্বীকার করেছেন। তার দাবিÑ আমরা আমাদের মহিলা কর্মীদের ১৩ দফার পক্ষে মাঠে নমিয়ে এ বিষয়ে জনগণকে সঠিক অবস্থান জানিয়ে দিতে চাই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন