শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৩

শাহবাগ আন্দোলন : আরো কিছু কথা

ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
হায়রে আমার দেশ! দুঃখিনী দেশ। গত কয়েকদিন ধরে এই শব্দ দুটি বারবার দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বের হয়ে আসছে। রাতে ঘুমাতে পারি না আর নানান ভাবনায় সারাক্ষণ বুঁদ হয়ে থাকছি। কিন্তু কেন এমন সময় আমার/আমাদের কাটাতে হচ্ছে। কেন আমরা মুক্তিযুদ্ধের এতো সময় পরে এসে স্বাধীনতার যথার্থতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হচ্ছি। কেন আমাদের প্রায় সকল রাজনৈতিক শক্তি এতো আপোসকামী আর স্বার্থপর। কেন ক্ষমতা ছাড়া আমাদের সমাজের সকলেই নিজেকে সাধারণ মনে করে। এরকম এক হাজার /লক্ষ/কোটি প্রশ্ন আমার চোখের পাতায় প্রতি রাতে ভর করে। আর আমাকে ঘুমাতে দেয় না। আমি জানি এই না ঘুমানো মানুষের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে।
এমন দিন আর কতোদিন পরে শেষ হবে। আমি গত একটা লেখায় শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে আমার কিছু অভিমত লিখেছিলাম। লিখাটিতে শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাদের কার্যক্রম, এই আন্দোলনের লক্ষ্য, ইসলামী ব্যাংকসহ মৌলবাদী প্রতিষ্ঠান, সাম্প্রদায়িক হামলা, নাস্তিক প্রসঙ্গ, সংখ্যালঘু নির্যাতনসহ আরো কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। কেউ কেউ আমার লিখার বিরূপ মন্তব্য করেছিল আর কেউ কেউ আবার প্রশংসা করেছিল। যাহোক আজকের আলোচনা একটু ভিন্ন আঙ্গিকে।

আহারে! ভোট আসছে বাহারে

আজকে একটা বিষয়ই চোখের সামনে আমাদের ক্ষমতাসীনরা দেখছেন (শয়নে, স্বপনে, জাগরণে, বিভ্রমে) ব্যালট পেপার আর ভোট। তাই তো দেখেন দুই নেত্রী কতোভাবে নিজেদের জনগণের সামনে নিয়ে যাচ্ছেন আর ভোট-ব্যালট ভিক্ষা চাচ্ছেন। নিজেদের তারা অনন্য প্রমাণ করার জন্য ব্যস্ত। প্রতিদিনই এখন তাদের ক্ষমতার দৌড়ের প্রস্তুতি। আর আমাদের দেশের পাবলিক আছে মহাসুখে, উন্নয়নের জোয়ারে। রাজনীতি খেলা শুরু হয়ে গেছে। খেলাটা অনেকটা গ্রামের বানর নাচের মতো। একজন হাতে ঢোল নিয়ে গোল মানুষের মধ্যে ঘুরে ঘুরে বলতে থাকেন এইৃরেৃরে খারা খারা এইবার আপনারা দেখবেন আগামী সংসদ নির্বাচন কেমনে হইবো। এই বানর দেখা তো। বানর তার খেলা দেখাতে থাকে। আর আমরা পাবলিক হাততালি দেই-মজা নেই। আর কেউ কেউ এর মধ্যে তার কাজ পাকাপোক্ত করে নেয়। খেলা শেষ হলেই প্রথমে পকেট আর তার পর মাথায় হাত। এই হলো আমাদের দেশের ভোটের বানর খেলা। খেলা যতোক্ষণ আছে পাবলিক ততোক্ষণ মজা পায় আর নির্বাচনের পর ৃ

শাহবাগ! এতো বড় সাহস

’৫২, ’৬২, ’৬৯, ’৭১, ’৯০, ২০০৮, ২০১৩ আমাদের এই পথচলায় কোন সময়টা এর চেয়ে অনেক মসৃণ ছিল? তাই বলতে চাই শাহবাগ এতো বড় বেয়াড়া হচ্ছে এর অর্থ হলো এখনো বাংলাদেশ তার ইতিহাসকে ধারণ করে। এখনো তার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সেই প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের ফল্গুধারা। আমরা তো ইতিহাস ভুলে যাই আর কেউ আবার ইতিহাসকে করে অস্বীকার। তাই তো এতো রক্তদানের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে আমরা অস্বীকার করি। আমাদের সকল রাজনৈতিক শক্তি মুক্তিযুদ্ধ আর তার অর্জনকে নিজের সম্পদ করে ভাবতে অভ্যস্ত। কিন্তু আভাগা আমাদের সেই সাধারণ মানুষ, যারা লুঙ্গি মালকোচা মেরে অস্ত্র হাতে সেদিন যুদ্ধে গিয়েছিল। আজ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার সংকট তাদেরই। খুব সরল আর তীব্র ভাষায় বলতে চাই এই ৮০-৯০ ভাগ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের কোনো সুফল আজো ভোগ করেনি। এর কারণ আমাদের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর নির্লজ্জতম লুটপাটের মানসিকতা।

জাগো বাহে কুনঠে সবাই

এই লুটপাটের বাইরে শাহবাগ আজ এক নব জাগরণের নাম। সেই জাগরণ এখন আরো খাঁটি জায়গায় যাচ্ছে। এই আন্দোলন আবারো দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে। এই শাহবাগ হবে বাংলাদেশের আরেক সংগ্রামী তীর্থস্থান। জামাতিরা এতো সাহস কোথায় পায়? সর্ষের মধ্যেৃ

ব্লগাররা নাস্তিক, ব্লগাররা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে, ব্লগারদের ফাঁসি দিতে হবে, শাহবাগ আন্দোলন বন্ধ করতে হবে, দেশে কোনো নাস্তিক থাকতে পারবে না এই কথাগুলো কার জন্য, কার স্বার্থে বলা হচ্ছে। আর যারা বলছেন তারা কারা। এই বিষয়গুলো খুব স্পষ্টভাবে আমাদের বুঝতে হবে এবং তা দেশবাসীর সামনে উন্মোচন করতে হবে। আমাদের সরকার তো তার নিরাপত্তা বলয়ের নাম করে এই আন্দোলনের তেরটা বাজিয়েছে আর এই শক্তির বিরুদ্ধে কোনো কথা না বলার মধ্য দিয়ে এবং সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে এই শক্তিকে আরো প্রশ্রয় দিয়েছে। চাঁদে সাঈদীকে দেখিয়ে মৌলবাদীরা দেশকে প্রায় আচল করে দিলো আর আমাদের সরকার একটা কথা দেশব্যাপী তার প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে জনগণকে জানাতে পারলো না। নাকি জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি? তাই বিষয়টি পরিষ্কার হচ্ছে যে এই জামাত, সরকারের নীরবতাকে সম্মতিজ্ঞান করে তার জিহাদি কর্মকা- পরিচালিত করছে। গত কয়েকদিনে ৪ জন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমার প্রশ্ন তাদের কোন অপরাধের প্রেক্ষিতে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে আর যেভাবে হাতকড়া পরিয়ে তাদের গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে তা কতোটা মানবিক এবং আমাদের আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? তারা কি চিহ্নিত আপরাধী, তারা কি যুদ্ধাপরাধী? তারা কি হত্যাকারী? তারা যদি অপরাধী হয় তবে তার জন্য রাষ্ট্রীয় আইন ও তদন্তের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। নাকি হেফাজত আর জামাতিদের সন্তুষ্ট করতে এই পদক্ষেপ, তা দেশবাসী জানতে চায়। এই হেফাজতে ইসলাম এবং খেলাফত মজলিশ যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। খেলাফত মজলিশ একটি যুদ্ধাপরাধী দল তা বাংলার মানুষ খুব ভালো করে জানে। তাই তাদের কোনোভাবে যদি কেউ ছাড় দেয়ার কথা চিন্তা করে, তবে এর ফলাফল হবে ভয়ঙ্কর। এর দায় নিতে হবে বাংলাদেশের সমস্ত মানুষকে।

আমি শাহবাগের আমাদের সাহসী যোদ্ধাদের উদ্দেশে বলতে চাই। এখন সময় এসেছে সকলের মুখোশ খুলে দেখানো। আজ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ (কাদের সিদ্দিকী) সকলেই এক কথা বলছে। তাই আজ শাহবাগের তরুণ প্রজন্মকে বলতে হবে। এই সকল রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে ভিন্ন রাজনৈতিক আবস্থান ঘোষণা করতে হবে আর তা না হলে তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে ভিন্ন পথে হাঁটতে হবে। বলতে হবে এই তরুণ সমাজ এই সকল চিহ্নিত শক্তিকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। আগামীতে প্রকৃত পক্ষে দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক জনগণের পক্ষের শক্তিকে ক্ষমতায় বসাতে হবে। বাংলাদেশে আজ সত্যিকার অর্থে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ জরুরি। এক্ষেত্রে সকল ছোট ছোট রাজনৈতিক শক্তি, সৎ-দেশপ্রেমিক মেধাবী ব্যক্তি গোষ্ঠী আর এদেশের কৃষক, শ্রমিক, বস্তিবাসী, বেকার, রিকশাওয়ালা, গার্মেন্ট শ্রমিক, ক্ষেতমজুরসহ সকল শক্তিকে নিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতার দিকে এগিয়ে যেতে হবে। একজন চোর, অসৎ, টেন্ডারবাজ, সন্ত্রাসী যদি নীতিনির্ধারক হতে পারে তবে কেন আমাদের সমাজের একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক সাধারণ শ্রমিক, তরুণ, শিক্ষক, সাংবাদিক হতে পারবে না। কথাগুলো হয়তো অনেকের কাছে পাগলামোর মতো মনে হবে। কিন্তু আজ আমি সত্যিকার অর্থে মনে করি এই সকল সাধারণ মানুষের বিপরীত মেরুর দলকে এখনই প্রত্যাখ্যান করা উচিত। পৃথিবীর দেশে দেশে যুগে যুগে অনেক ইতিহাস রচিত হয়েছে। এই বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা জন্ম দিয়েছে বহু ইতিহাস। আসুন আরেকটা ইতিহাস গড়ে তুলি। জয় হোক সাধারণ মানুষের।

ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল : সাবেক ছাত্রনেতা, লেখক।
ভোরের কাগজ : শনিবার, ১৩ এপ্রিল ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন