শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৩

আধ্যাত্মিক নেতার চাওয়া-পাওয়া

এম আবদুল হাফিজ
যে হেফাজতে ইসলাম হাটহাজারীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে রাজধানী পর্যন্ত একটি সফল লংমার্চ করে এখন আলোচনার শীর্ষে, তা কিন্তু আসলে রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক সে বিষয়কে ঘিরেও কম প্রশ্নবিদ্ধ নয়। সেসব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা না থাকলেও হেফাজতের কথিত আস্তানা হাটহাজারীর সঙ্গে আমার এক নিবিড় সম্পর্ক সেই ১৯৬৪ সাল থেকেই একজন তরুণ আর্টিলারি অফিসার থাকাকালীন সময়েই গড়ে উঠেছিল। অরণ্য পরিবৃত অনুচ্চ পাহাড়বেষ্টিত এক মনোরম উপত্যকায় ওপরওয়ালাদের নির্দেশে আমারই হাতে গড়া বাংলাদেশে গোলন্দাজ চানমারির এই রেঞ্জটি। চট্টগ্রাম আমার কোনো প্রিয় গন্তব্য না হলেও হাটহাজারীতে অতিক্রান্ত সময়গুলো ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলোর অন্যতম। তার সবকিছুই ছিল আর্টিলারিকে ঘিরে এবং ভালোবেসে।
ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য তৈজসপত্র কিনতে যখনই হাটহাজারী বাজারে গিয়েছি চোখে পড়েছে পুরনো স্থাপত্যের এক বিশালকায় হাটহাজারী কওমি মাদ্রাসা। সহকর্মীদের প্রশ্ন করে জানতে পারি যে, সে সময় মাদ্রাসা শিক্ষায় প্রচলিত ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে কওমি মাদ্রাসাগুলোই নাকি ধর্মীয় শিক্ষার শুদ্ধতম ব্যবস্থা ছিল। মাদ্রাসা কমপ্লেক্সটি দেখলেও মনে হতো যে তা এক প্রকার আধ্যাত্মিকতার মোড়কে আবৃত। এর অর্থ এই নয় যে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানও কখনও তার বিশুদ্ধতায় পার্থিব লোভ-লালসার মিশ্রণ ঘটাতে পারে না, যার অভিযোগ সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকেও উচ্চারিত হয়েছে।
ভারতে কংগ্রেস শাসনামলে নেহরু-গান্ধী পরিবারের রাজনীতিকরা কোনো কোয়ালিশন গঠনের প্রয়োজন বোধ ছাড়াই যখন লোকসভার নির্বাচনে অবতীর্ণ হতেন, দস্তুর ছিল যে দেশটির শক্তিশালী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শ্রদ্ধাভাজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের শরণাপন্ন হতেন তারা। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন দিলি্ল জামে মসজিদের ইমাম বোখারি, যিনি কংগ্রেস নেতা-নেত্রীদের দুর্বলতা বুঝতে পেরে তার সমর্থনের মাশুল হিসেবে পুরস্কার চাইতেন। ইমাম বোখারি দিলি্ল জামে মসজিদের ইমাম হিসেবে ভারতের আম মুসলমানের জন্য ভোটের দিকনির্দেশনা দিতেন বলে শুনেছি এবং সে কথা ভারতের শীর্ষ সাপ্তাহিকীগুলোতে পড়েছিও। ইমাম বোখারির বিরুদ্ধে দুর্বলতার বস্তুগুলোর মধ্যে ছিল আমদানিকৃত বিরল ব্র্যান্ডের গাড়ি।
একজন ইমাম যিনি দেশটির প্রায় চৌদ্দ কোটি মুসলমানকে প্রভাবান্বিত করতে পারেন তাকে খুশি করার জন্য ভারতের মতো দেশের ঐশ্বর্যের কোনো অভাব ছিল না। রাজনীতিকরা ইমাম বোখারির কাছে ফায়দা ওঠাতে পারলেও বোখারি সম্ভবত হারিয়েছিলেন তার আধ্যাত্মিকতার পরশমণি। ইন্দিরা গান্ধীর কথা শুনেছি যে, তিনি তার বাছাই করা গির্জা-মন্দির ছাড়াও নির্বাচনের প্রাক্কালে কখনোই আজমির শরিফে যেতে ভুলতেন না।
আম মুসলমানের চোখে ধর্মীয় বিশুদ্ধতার প্রতীক একজন বয়োবৃদ্ধ আল্লামা শফীর এই পৃথিবীতে চাওয়ার কিছুই নেই। কিন্তু সবার অনুমানকে ভুল প্রমাণিত করে তিনি যদি তা চান বা চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করেন বিপাকে পড়বেন তিনিই এবং সেটাই হবে এই আধ্যাত্মিক নেতার ইহ ও পারলৌকিক জীবনের প্রাপ্তি। তবে তাদেরকে সাধারণত পঙ্কিলতায় ডোবায় দুনিয়ার ঐশ্বর্যলোভী রাজনীতিক, আমলা, ব্যবসায়ী ও জেনারেলরা। আমার দৃষ্টিতে আধ্যাত্মিকতার অধিকারী কোনো ব্যক্তিত্বকে নিয়ে বিতর্কের ঝড় তোলা নিরর্থক। কেননা তিনি তার অর্জিত স্তর থেকে একবার স্খলিত হলে তাকে নিয়ে তো দুশ্চিন্তার কোনো কারণ থাকে না। আমাদের আমজনতা এ কথা বুঝতে পরিপকস্ফ যে, বাইরের লেবাস সত্ত্বেও তাদের মধ্যে কে পরিত্যাজ্য এবং কে গ্রহণীয়। তবে একটি বিষয় বাস্তবতার খাতিরেই বিবেচনায় আসতে পারে। আমাদের দেশটি নিদারুণভাবে বিভাজিত। যদিও এ মুহূর্তে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে আগামী নির্বাচন জেতার সব অনুষঙ্গই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুকূলে, তবু ওই যে বলা হয় রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই। তা ছাড়া কিছুটা অদ্ভুত ঠেকলেও অনেকেই ভাবছেন, হেফাজতে ইসলাম ও তাদের অনির্ণীত সংখ্যক সমর্থক এবং গণজাগরণ মঞ্চের কুশীলব ও তাদের সমমনারা নির্বাচনী ভারসাম্যে কী তারতম্য ঘটাবে_ কেউ তা জানে না। বাহ্যত বিএনপি ও তার সমমনারা যারা ইতিমধ্যেই হারার পথেই ছিল সেই সম্ভাবনাকে পূর্ণতা দিল এক অখ্যাত মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার।
কিন্তু নিশ্চয়তার নিকষ কালো অন্ধকারের অন্তরালে জেগে উঠছে এক আশার দীপ। আফটার অল একটি জনগোষ্ঠী_ তা যেখানকারই হোক গিলোটিনে নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য ঘাড় পেতে দেয় না। বাঁচার এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা তাকে সাহস জোগায়, বিশ্বাস জোগায় অবরুদ্ধ গণতন্ত্রের মুক্তির অভিযাত্রায়। কিন্তু অনেকেই যে আবার বলেন, গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনার রাজনীতিই তো গণতন্ত্রকে নিষ্কলুষ করতে ও পূর্ণতা দিতে পারে। কিন্তু আপাতত থাক সেই প্রসঙ্গ।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন