বুধবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৩

গণজাগরণ আন্দোলন কি নতুন পর্বে প্রবেশ করছে?

আনু মুহাম্মদ
একমাস শেষ হবার আগেই সরকার গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। প্রথমে উচ্ছসিত থাকলেও গণজাগরণ মঞ্চের বর্তমান গতিবিধি নিয়ে সরকার বিব্রত ও ক্ষুব্ধ। এই মঞ্চ বন্ধ করে দেবারও চেষ্টা সরকার এখন করছে বলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায় (কালের কন্ঠ, ১ এপ্রিল ২০১৩; প্রথম আলো, ২ এপ্রিল ২০১৩)। এর মাধ্যমে বিএনপি জাতীয় পার্টি জামায়াত হেফাজতে ইসলামের দাবিই সরকার পূরণ করতে যাচ্ছে।

এরমধ্যে মঞ্চের প্রধান কোনো দাবি পূরণ না হলেও ১ এপ্রিল রাতে ‘ধর্মানুভূতিতে আঘাত’ করে লেখার অভিযোগে তিনজন তরুণ ব্লগারকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করেছে এবং আদালত ২ এপ্রিল তাদের বিরুদ্ধে ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। স্পষ্টতই হেফাজতে ইসলাম সহ বিভিন্ন ইসলামপন্থী শক্তির সঙ্গে আপোষ সমঝোতার অংশ হিসেবেই সরকারের এই সক্রিয়তা। জামাত ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে যুদ্ধাপরাধীদেও রক্ষা করতে চায়, বিএনপি ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে ভোটের রাজনীতিতে টেক্কা দিতে চায়। আওয়ামী লীগ এখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী। উল্লেখ্য যে, সাম্প্রদায়িক হামলা, রেলওয়েতে উপর্যুপরি অন্তর্ঘাত যারা করেছে তাদের গ্রেফতারের ব্যাপারে সরকারের এই সক্রিয়তা দেখা যায়নি।

২.

এর আগে ‘শহীদ রুমী স্কোয়াড’ এর সদস্যরা জামাত শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে অনশন শুরুর পর থেকে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন, এই আন্দোলনের ভেতরে নানাশক্তির অবস্থান, আন্দোলনের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক সবকিছুই বড় ধরণের টানা পোড়েনে পড়েছিলো। সাতদিন টানা অনশনের পরও সরকার কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা জানায়নি।

যে দাবিতে শহীদ রুমী স্কোয়াডের কিশোর তরুণেরা অনশনে জীবন বিপন্ন করেছেন - সে দাবির পক্ষে সরকারের লোকজন, বিশেষত বাচাল মন্ত্রীরা বহুবারই কথা বলেছেন। হয়তো তাদের কথাবার্তার কারণেই সমাজে প্রত্যাশা আরও বেড়েছিলো। এতোবার যদি মন্ত্রীরা জামাত শিবির নিষিদ্ধের কথা বলে থাকতে পারেন, তাহলে তাঁদের অবস্থান ও পরিকল্পনা স্পষ্ট করতে অসুবিধা কী? জানি এখন নানা জটিলতা আইনী বিষয়ের কথা বলা হবে। প্রশ্ন হলো, কথা বলার সময় এগুলো মনে থাকে না কেনো? আসলে অসুবিধা কি এইখানে যে, কথাগুলো মূলা হিসেবে ঝুলিয়ে মানুষকে ভোটের রাজনীতিতে ব্যবহার করবার জন্যই বলা হয়েছে, বাস্তবায়ন করবার জন্য নয়? সরকারের জামাত বিরোধিতা কৌশলগত, নীতিগত বা মতাদর্শিক নয়? কিন্তু কাজের মতো কথারও তো দায়িত্ব নিতে হবে। খোঁচা মেরে, উস্কানি দিয়ে সরকারের লোকজন যে জামাত শিবিরের হাতে অনেক অস্ত্র তুলে দিয়েছেন তার কী হবে?

৩.

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথম থেকেই তাঁর কথা ও কাজ দিয়ে জামাতকে অনেক শক্তি যুগিয়েছেন। সর্বশেষ ১ এপ্রিল বলেছেন, তিনি জামাতের মূলোৎপাটন করবেন। এর উল্টোদিকে হেঁটে এসব কথা যথারীতি জামাতকেও আরও সুবিধাই দেবে। মানুষ ও সম্পদের নিরাপত্তা দিতে বরাবর ব্যর্থ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এর আগে গত ২৫ মার্চ আরেকটি চরম দায়িত্বহীন মন্তব্য করেছেন, ‘নাশকতাকারীদের দেখামাত্র গুলি করা হবে।’ দেখার বা গুলির সীমানায় কেউ যদি নাশকতা করে তাহলে তাদের ধরতে অসুবিধা কী? গুলি করে মেরে ফেললে কারা এই নাশকতা করাচ্ছে তা জানা যাবে কীভাবে? গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কী করছে? আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কাউকে খুন করে যদি বলেন ‘ও নাশকতা করছিলো’, তা আমরা বিশ্বাস করবো কেনো? ২০০২ সাল থেকে বিভিন্ন সরকার এ ধরণের যুক্তি দিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করেছে। বিএনপি-জামাত সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর সর্বশেষ বর্তমান সরকার- সবগুলো আমলেই একই মিথ্যা প্রেসনোট দিয়ে ক্রসফায়ার ও এনকাউন্টার নামে রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞ চলেছে। সরকার বদলায়, মিথ্যা প্রেসনোট বদলায় না। হত্যার পর নিহতের ঘাড়ে ঝুলিয়ে দেয়া হয় ‘সন্ত্রাসী’ পরিচয়। আর সরকারের শরীরে লেপটে থেকে তাদের কাজ করতে থাকে সন্ত্রাসী ও তাদের গডফাদাররা।

৪.

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সরকারের অযত্ন, অবহেলা, অমনোযোগ নিয়ে অভিযোগ প্রথম থেকেই ছিল। এগুলোর পাশাপাশি নানা ঘটনায় জামাতের সাথে সরকারের আঁতাতের একটি সন্দেহ সমাজে ক্রমশ: দানা বাঁধতে থাকে। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায় সমাজের মধ্যে বিস্তৃত এই সন্দেহকে আরও প্রতিষ্ঠিত করে। কয়েকজন ব্লগার প্রথমে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহবান জানালেও পরবর্তীতে এই প্রতিবাদী অবস্থানের পক্ষে ব্যাপক মানুষের অবস্থান, অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ এবং দেশব্যাপী তার বিস্তৃতি প্রমান করে যে, বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যেই এই রায় ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি করেছিল।

প্রথমে প্রতিবাদী সমাবেশ ক্রমে টানা দিনরাত বিরতিহীন সমাবেশে রূপান্তরিত হয়, সারাদেশে তা ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধাপরাধীদের যথাযথ বিচার, সর্বোচ্চ শাস্তি (বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ফাঁসি) দাবি নিয়েই এর শুরু হলেও ক্রমে আরও বেশিকিছু দাবি অন্তর্ভূক্ত হয়। এর মধ্যে জামাত শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, সহিংসতার উস্কানিদাতা হিসেবে ‘আমার দেশ’ এর সম্পাদককে গ্রেফতার, ইসলামী ব্যাংক ও জামাতের সহযোগী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা ছিলো অন্যতম।

আন্দোলনের প্রাথমিক বিজয় হয় যুদ্ধাপরাধী আইনের কতিপয় দুর্বলতা দূর করে নতুনভাবে আইন প্রণয়ন করায়। এই আন্দোলনের বিস্তারে মিডিয়া বিশেষত বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অবিরাম সমর্থন, উল্লেখযোগ্য সময় সরাসরি সম্প্রচার বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলো। পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তি, এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী এই গণজাগরণ মঞ্চের দাবিদাওয়ার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। এর ফলে সকলের কাছে এরকম একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয় যে, আগে যাই ঘটুক না কেনো সরকার যুদ্বাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে শক্ত অবস্থান নিয়েছে, জামাত শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ সহ আরও কিছু পদক্ষেপ তার সক্রিয় বিবেচনাধীন আছে।

১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে পরিস্থিতির মধ্যে পরিবর্তন আসতে থাকে। ঐদিন রাজীব হায়দার নামে একজন ব্লগার খুন হন। তিনি ছদ্মনামে ইসলাম বিদ্বেষী কিছু লেখা ব্লগে প্রকাশ করেছেন বলে প্রথমে সরকার সমর্থক ‘ইনকিলাব’ পত্রিকায় জানানো হয়। পরে ‘আমার দেশ’ এই লেখাগুলো ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করে এবং তার ভিত্তিতে জামাত সহ নানা ইসলামপন্থী গোষ্ঠী এসব বক্তব্য গণজাগরন মঞ্চের সাথে গুলিয়ে পুরো আন্দোলনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এবং অনেকখানি সক্ষম হয়।

এই পরিস্থিতিতেই ২৮ ফেব্রুয়ারি দেলোয়ার হুসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় প্রকাশিত হয়। এই রায়কে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ত্রাস তৈরি করতে সক্ষম হয় জামাত। সেসময়ই দেশজুড়ে শুরু হয় অভূতপূর্ব সাম্প্রদায়িক হামলা। পুলিশের গুলি ও জামাতের হামলায় এক সপ্তাহে নিহত হন শতাধিক। সেই সহিংসতা এখনও চলছে।

৫.

ফেসবুক বাংলাদেশে যতটা পরিচিত, ব্লগ তুলনায় আরো কম। ব্লগের এসব লেখার সাথে মুষ্টিমেয় ব্লগার ছাড়া কারও কোন যোগাযোগ থাকে না। ব্লগ যেহেতু একটি অনানুষ্ঠানিক, উন্মক্ত এবং পরিচিত জনদের মধ্যেকার আলাপচারিতার জায়গা সুতরাং এগুলোতে অনেকেই তাৎক্ষনিক চিন্তার প্রকাশ হিসেবে লেখেন। সকলের পাঠের জন্য প্রকাশিত নয় বলে এসব লেখা খুব কম ক্ষেত্রেই সুচিন্তিত, সুপরিকল্পিত এবং পরিশীলিত হয়। অনেকের লেখাতেই দুর্বল ভাষা, অকথ্য গালিগালাজ, ব্যক্তিগত আক্রমণ, বিদ্বেষ দেখা যায়। সেজন্য অংশগ্রহণকারী ছাড়া কেউ ব্লগের লেখা পড়তে সাধারণত আগ্রহী থাকে না। হাতে গোণা কজন ব্যক্তির নিজেদের মধ্যেকার কথাবার্তা- যা মানুষের মধ্যে প্রকাশের জন্য লিখিত নয়, এরকম কিছু লেখা ‘ইনকিলাব’ ও ‘আমার দেশ’ এর মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।

এসব লেখা আরও হিংস্র ও কদর্য দেখানোর জন্য অনেককিছু যোগ করা হয়েছে বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন। এগুলো নিয়ে মসজিদ ও মাদ্রাসায় ব্যাপক প্রচার করা হয়। এক বিচারপতিও ফটোকপি করে এগুলোর প্রচার শুরু করেন। এগুলো সকল পর্যায়ের মানুষের মধ্যেই তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এসব লেখায় যে ধরণের ব্যক্তি বিদ্বেষ, কুৎসা ও ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তা শুধু ধর্মভীরু মুসলমান নয় যেকোন মানুষকেই বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ করবে। এসব লেখা সমাজে কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য হবার মতো নয়। ধর্ম নিয়ে আলোচনা বিতর্ক খুব প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এধরণের লেখা সমাজে ফ্যাসিবাদীদের হাতকেই শক্তিশালী করে। কিন্তু কারা এগুলো এভাবে লিখলো? আর কারা প্রচার করে মানুষকে আহত করলো তার দিকে কে খেয়াল করবে? সরকার পরিষ্কার করেছে? তারা করবে না।

৬.

সর্বশেষ পরিস্থিতি দাঁড়াচ্ছে এই যে, গণজাগরণ মঞ্চ উত্থাপিত দাবিগুলির প্রতি প্রথম পর্যায়ে সমর্থন দিলেও এখন সরকার উল্টোপথে। ব্লগারদের গ্রেফতারেই এর শেষ হবে না মনে হয়। ইসলামপন্থীদের সকল গ্রুপের সক্রিয়তা অভূতপূর্ব মাত্রা লাভ করেছে, যা বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতিকেই সুবিধা দিচ্ছে। আর এরমুখে আওয়ামী লীগ সরকারও ইসলামপন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠীর সমর্থন লাভের জন্য প্রাণপণ চেষ্টায় নিয়োজিত। রাজনীতির কেন্দ্রে এখন ধর্ম। দীর্ঘমেয়াদে ভিন্ন কিছু প্রভাব পড়বার সম্ভাবনা থাকলেও স্বল্পমেয়াদে অন্তত নির্বাচনের আগে পর্যন্ত গণজাগরণ আন্দোলনের বিপরীত প্রতিক্রিয়াই সামনে এখন। পরিস্থিতি থেকে দেখা যাচ্ছে, একদিকে (১) সামগ্রিক রাজনীতি আরও সহিংস ও ধর্মীয়করণ হচ্ছে। এবং অন্যদিকে (২) ১৯৭১ এর অমীমাংসিত বিষয় ফয়সালা করতে তরুণদের মূলধারার আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিএনপি - জামাত - জাতীয় পার্টির সাথে এখন আওয়ামী লীগও যোগ দিয়েছে।
Source: http://amaderbudhbar.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন