শনিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৩

আওয়ামী লীগের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই

আলী রীয়াজ
হেফাজতে ইসলাম বা জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকেরা কখনোই আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না, আওয়ামী লীগের পক্ষে এসে দাঁড়াবে না, তার পরও কেন সরকার তাদের সঙ্গে আপসের পথই বেছে নিল—এই প্রশ্ন এখন আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল, এমনকি আওয়ামী লীগের সমর্থকদের অনেকের কাছে শোনা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতা তোফায়েল আহমেদের ভাষায় আওয়ামী লীগ এখন দুই নৌকায় পা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের শরিকদের একজন রাশেদ খান মেনন বলেছেন, এতে করে ‘আমও যাবে, ছালাও যাবে’। হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আপস, তাদের তুষ্ট করার জন্য তরুণ ব্লগারদের গ্রেপ্তার, গণজাগরণ মঞ্চ বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ, মঞ্চ ভেঙে দেওয়ার পরামর্শের পর আওয়ামী লীগ সরকার এখন বিরূপ সমালোচনার মুখে আছে।

হেফাজতে ইসলামের হুমকির মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের নতজানু অবস্থা দেখে, সরকার ও সরকারি দলের দিকভ্রান্ত আচরণ দেখে, যে আপসের আলামত দেখে গণজাগরণ মঞ্চের সূচনা হয়েছিল, তা স্মরণ করে জাগরণ মঞ্চের সমর্থকদের অনেকেই বলছেন যে তাঁদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে, বলছেন যে এই সবই ‘আমরা’ মনে রাখব এবং আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার ‘ফল’ পাবে। এই অনুভূতি বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় তরুণদের মধ্যেই বেশি। গত নির্বাচনে এঁদের এক বড় অংশই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন এবং আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতির কারণে তার প্রতি সমর্থন দিয়েছিলেন। তাঁদের এই ক্ষোভ দেখে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষরা আনন্দিত হচ্ছে কি না, তা না জানলেও অনুমান করতে পারি যে তারা তাতে অখুশি হবে না।
এযাবৎকালে আওয়ামী লীগের এই আচরণকে নির্বাচনী হিসাব-নিকাশের বাইরে আর কোনো দিক থেকে ব্যাখ্যা করা হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে যে সরকার গোড়াতে জামায়াতে ইসলামীর বিপরীতে ইসলামপন্থীদের একটা আলাদা শক্তিকেন্দ্র তৈরিতে উৎসাহ জোগালেও হেফাজতে ইসলামের নাটকীয় উত্থান, তাদের আচরণ এবং তাতে জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধীদের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনায় এখন শঙ্কিত। হেফাজতের নেতারা আগে নিজেদের অরাজনৈতিক বলে দাবি করার চেষ্টা করছিলেন, ঢাকামুখী হওয়ার পর তাঁদের ভাষায় ও বিষয়ে পরিবর্তন ঘটেছে। তাঁদের অবস্থান এখন আর সরকারের অনুকূলে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এসব দিক বিবেচনা করেই অধিকাংশ মানুষের প্রশ্ন, আওয়ামী লীগ এ ধরনের সিদ্ধান্ত কেন নিল। আর এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ ব্যক্তিরাই এখন বলছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে এর মাশুল গুনতে হবে। তাঁদের এসব কথা শুনে একটা প্রশ্ন জাগে, আসলেই কি আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে তার এই আচরণের জন্য কোনো রকমের মাশুল গুনতে হবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে মোটা দাগে রাজনীতির মাঠের অবস্থা স্মরণ করা দরকার।
বাংলাদেশের দ্বিদলীয় রাজনীতির মাঠে বিএনপি-জামায়াতের ঐক্য যে এখন অমোচনীয় কালির মতন, তা না বোঝার কারণ নেই। কয়েক মাস আগে জোটের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বিএনপি। তারা চাইলে জামায়াতকে বাদ দিতে পারত; এখন ঠিক উল্টোটাই ঘটেছে মনে হয়। জামায়াতের আগ্রহের অভাব না থাকলে বিএনপির জন্য এই জোট ত্যাগের কোনো কারণ নেই, অন্যদের বাদ দেওয়ার ক্ষমতাও নেই। বিএনপির সমর্থকেরা দলের এই অবস্থা ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারেন। দলের মধ্যে যাঁরা জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য করা নিয়ে এত দিন সামান্য দ্বিধা দেখিয়েছেন, গত কয়েক সপ্তাহে তাঁরা নিশ্চয় তাঁদের দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। গত দুই বছরে প্রাণপাত করে, তারিখের পর তারিখ দিয়ে বিএনপি যা করতে পারেনি, এখন জামায়াতের উপর্যুপরি হরতাল, সন্ত্রাসী তৎপরতা এবং সর্বশেষ হেফাজতে ইসলামের হুমকি ও লংমার্চ থেকে সরকারের প্রতিপক্ষরা তার চেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে। বিএনপি দলগতভাবে তাতে লাভবান হয়নি, বরং এখন বিএনপি জামায়াতনির্ভর দলে পরিণত হয়েছে। তাতে দেশের যে ক্ষতি হয়েছে, যে ব্যাপক সংখ্যায় প্রাণহানি ঘটেছে, দীর্ঘ মেয়াদে রাজনীতিতে যে সহিংসতার ধারাকে প্রায় স্থায়ী রূপ দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট মোটেই চিন্তিত বলে মনে হয় না। তারা যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়াকে তাদের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেছে। একসময় নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবিই ছিল মুখ্য। এখন তাদের লক্ষ্য হচ্ছে সরকারের পতন ঘটানো।
এই অবস্থা মোকাবিলায় সরকার যে শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নিয়েছিল, তার পরিণতি সরকারের জন্য ইতিবাচক বা অনুকূল হয়নি। সহিংসতা দমানোর জন্য শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজনকে অস্বীকার না করেও বলা যায়, সরকার শক্তি প্রয়োগের ব্যাপারে যথাযথ ব্যাখ্যা প্রদানে সব সময়ই যে সফল হয়েছে, তা নয়। অনেক সময় সরকারি কর্মকর্তাদের, এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য ভিন্ন ব্যাখ্যার সুযোগ দিয়েছে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ওপরে উপর্যুপরি হামলা কেবল জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের ভয়াবহ অমানবিক চেহারাই তুলে ধরেনি, নিরাপত্তা প্রদানে সরকারের ব্যর্থতাও প্রকাশ করেছে। সরকার সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা মোকাবিলা করতে পারেনি, এখনো পারছে না। কোথাও কোথাও সরকার-সমর্থকেরা তাতে যুক্ত ছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্যাপকভাবে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর থেকে বেসামরিক প্রশাসনের যে কর্মতৎপরতার প্রয়োজন ছিল, তা প্রায় সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত থেকেছে। রাজনৈতিকভাবে, সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগ বা ১৪ দল গত এক মাসে, যখন তাদের রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হওয়ার দরকার ছিল সবচেয়ে বেশি, তখন কোনো রকম তৎপরতা দেখাতে পারেনি। এই পরিস্থিতির অন্যতম কারণ হলো, গত চার বছরে সরকারের সাফল্যের ঘাটতি। আমার মনে হয় শেষ বিচারে তাদের সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতাই বেশি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো এত বড় একটা বিষয় হাতে নিয়ে সরকার তার গুরুত্ব ও মাত্রা বুঝতে সক্ষম হয়নি বলেই এখন মনে হয়। কেননা, এ রকম একটা কাজের জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করা দরকার ছিল, যে ধরনের মানবসম্পদ বরাদ্দ করা দরকার ছিল, বিচার-প্রক্রিয়ার সমালোচনা এবং বিচারের বিরুদ্ধে প্রচারণা মোকাবিলায় যে ধরনের প্রস্তুতি ও কার্যক্রম দরকার ছিল, তার প্রায় কিছুই গত তিন বছরে লক্ষ করা যায়নি। ফলে আগাগোড়া একটা দুর্বল অবস্থান থেকে সরকার এই বিচারের কাজ পরিচালনা করেছে। উপরন্তু দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারিতে সরকারের অবস্থান ও গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পেয়েছে। বড় কাজের জন্য যে ধরনের শৃঙ্খলা দরকার, অন্য অনেক আশু স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়ার প্রয়োজন, তা আওয়ামী লীগের নেতারা এবং সরকার দেখাতে পারেনি।
তদুপরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্ত এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া দুই-ই সরকারের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাব কিংবা রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। বিশেষ করে, যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করতে সরকারের যথেষ্ট দেরি হয়ে গিয়েছিল, সে ক্ষেত্রে এমনকি কৌশলগত বিবেচনায়ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত ছিল। এ বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় সরকারের অনুৎসাহিতার ফলেই রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
এই রকম পটভূমিতেই আওয়ামী লীগ সামনের নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ করছে। আমরা অনুমান করতে পারি, আগামী নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত-ইসলামী ঐক্যজোট (এবং অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় হেফাজতে ইসলাম) থাকবে একসঙ্গে ‘১৮ দল’ (বা ওই জাতীয় একটা জোট) হিসেবে। তারা ভোটপ্রার্থী হবে একসঙ্গেই। তার বিপরীতে আওয়ামী লীগ একা কিংবা মহাজোট হিসেবে নির্বাচনে ভোটপ্রার্থী হবে।
গত কয়েক দিনের আচরণের বিবেচনায় যাঁরা আওয়ামী লীগের ওপরে ক্ষুব্ধ, তাঁদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগের এই আচরণের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দিতেই পারেন। আওয়ামী লীগ ১৯৯১ সাল থেকেই যে ক্রমাগতভাবে দক্ষিণে সরে গেছে, তাঁরা তা তথ্যসমেত তুলে ধরতে পারেন। আমরা এও মনে করতে পারি যে, ২০০৬ সালে নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ খেলাফত মজলিসের সঙ্গে যে চুক্তি করেছিল, তা হেফাজতের ১৩ দফা থেকে আকারে ছোট হলেও মর্মবস্তুর দিক থেকে ভিন্ন নয়, অনেক দাবি আসলে একই। এসব সত্ত্বেও গণজাগরণ মঞ্চের সমর্থকদের একাংশ যে আওয়ামী লীগের কাছ থেকেই আশা করেছে, তা-ও আমরা ভুলে যেতে পারি না। তাঁরাই এখন এই বলে এখন ক্ষোভ প্রকাশ করছেন যে ‘আগামী নির্বাচনে দেখা যাবে’। কিন্তু নির্বাচনের সময় যে সম্ভাব্য দুটো বিকল্প তাঁদের সামনে থাকবে, সেই দুই বিকল্পের মধ্যে কাকে তাঁরা বেছে নেবেন? এর বাইরে বিকল্প একেবারে থাকবে না, আমি তা বলছি না। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যতগুলো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে, তাতেও তো অন্য বিকল্প ছিল। কিন্তু ফলাফলের দিকে তাকিয়ে বলুন যে আদৌ এর বাইরে কতজন নাগরিক ভোট দিয়েছেন।
এখন থেকে আট-নয় মাস পরে যখন এই ক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের সামনে একটা জোট বেছে নেওয়ার সুযোগ আসবে, তখন তাঁরা কী সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটা তাঁদের বিবেচনায় না থাকলেও আওয়ামী লীগের নেতারা ভালো করেই জানেন। একেই দলের নেত্রী শেখ হাসিনা ‘বাস্তবতা অনুসরণ’ করার কথা বলেছেন। হাসিনা স্পষ্ট করেই সম্প্রতি দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বলেছেন ‘ইমোশন দিয়ে আন্দোলন ও রাজনীতি হয় না। এর জন্য বাস্তবতা অনুসরণ করতে হয়।’ আওয়ামী লীগ যে এই বাস্তবতাকে উপলব্ধি করেছে এবং অনুসরণ করছে, তা না বোঝার কোনো কারণ নেই। তাদের এই ‘বাস্তবতা’ অনুধাবনের পরিণতি দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বইতে না হলেও দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে যে বইতে হবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
আওয়ামী লীগের এই আচরণে ক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা যতই ‘এর জন্য আওয়ামী লীগকে মাশুল গুনতে হবে’ বলে হুঁশিয়ার করছেন, তাঁদের এই হুঁশিয়ারিতে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ দেখি না। যদি নির্বাচনের অঙ্কে এই ক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের কোনো বিকল্প আশ্রয় থাকত, তাহলে আওয়ামী লীগ ‘দুই নৌকায় পা’ দেওয়ার আগে ভেবে দেখত। ফলে আজকে যাঁরা আওয়ামী লীগের আচরণে হতাশ, তাঁদের বিবেচনা করা দরকার, কীভাবে এই বিকল্প সৃষ্টি করা যায়। সে রকম কোনো বিকল্প সৃষ্টির চেষ্টা বা সম্ভাবনা দেখা দিলে আওয়ামী লীগকে দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে তারা দেশের জন্য ক্ষতিকারক সিদ্ধান্ত নেবে কি না। সেই বিকল্প তৈরিতে গণজাগরণ মঞ্চের অভিজ্ঞতা যে কাজে লাগবে, তা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন