শনিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৩

শান্তিশৃঙ্খলার হাতিয়ার সহনশীলতা

মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
মানবজীবনে সহনশীলতা একটি মহৎ, অনুকরণ এবং অনুশীলনযোগ্য বিশেষ গুণ। সহনশীলতা মানুষকে শেখায় কী করে অন্যের মতামত বা আচার-আচরণ সহজভাবে গ্রহণ করতে হয় বা সহ্য করতে হয় এবং ভিন্নধর্মাবলম্বী মানুষের সঙ্গে সম্প্রীতি ও সহানুভূতিশীলতার সঙ্গে এবং সহযোগিতার মনোভাব বজায় রেখে একসঙ্গে বা একই সামাজিক পরিবেশে শান্তিতে থাকতে বা বসবাস করতে হয়। তাই যুগের পরিবর্তিত পরিবেশ পরিস্থিতিতে সবার সঙ্গে নিজের মনমেজাজের ভারসাম্য রক্ষা করা, কালের আবর্তন বা সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে আগ্রাসী রূপান্তর না করে বরং সর্বাবস্থায়ই সুস্থির ও যুক্তিসংগত আচরণ রক্ষা করে চলা উচিত। সামাজিক জীবনে কাজকর্মে বিভিন্ন বাধা-প্রতিবন্ধকতা আসতেই পারে, সে কাজটি যদি হয় মহৎ, তাহলে সব বাধা ডিঙিয়ে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ও সহনশীলতা সহকারে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সহনশীলতার চেষ্টা করবে আল্লাহ তাকে সহনশীলতা অবলম্বনের শক্তি দান করবেন, আর সহনশীলতা হতে অধিক উত্তম ও ব্যাপক কল্যাণকর বস্তু আর কিছুই কাউকে দান করা হয়নি।’ (বুখারি ও মুসলিম)
সহনশীলতার ক্ষেত্র বহুধা বিভক্ত; পরিবারের মধ্যে সহনশীলতা, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সহনশীল আচরণ, পাড়া-প্রতিবেশীদের প্রতি সহনশীল হওয়া, কর্মক্ষেত্রে সহনশীল হওয়া এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দলমতের ক্ষেত্রেও সহনশীল হওয়া; এককথায় বলতে গেলে সব দিক দিয়ে সুস্থ-সামাজিক পরিবেশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে হলে সহনশীলতাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা ও গ্রহণ করতে হবে। সুতরাং এমন প্রচেষ্টা চালানো উচিত নয়, যা অন্য মানুষকে দুঃখ-কষ্টে নিপতিত করবে, অহেতুক বিপদ বয়ে আনবে; তবু সমাজে কাঙ্ক্ষিত শান্তিশৃঙ্খলা অর্জিত হবে না। অথচ সমাজে নানা রকম সহিংসতা, অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, হানাহানি ও বিপর্যয় একটার পর একটা লেগেই আছে। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ-আপদ ও নিরাপত্তাহীনতায় সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ তাআলা বিপদে ধৈর্য ধারণের কথা বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য-সহনশীলতা ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫৩)
পরিবারে সহনশীলতার অভাব থাকলে পারিবারিক সুখ-শান্তি ব্যাহত হয়। পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, অন্য কোনো আত্মীয়-স্বজন পরস্পরকে যদি মোটামুটিভাবেও না বোঝে বা বুঝতে না চায়, তার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম হবে পরস্পরের প্রতি অসহনশীল আচরণ; ফলে পরিবারের সুখ-শান্তি বিঘ্নিত হবে, মন খারাপ হবে এবং তা নানাভাবে পার্থিব জীবনকে কলুষিত করে পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতিমূলক মনোভাব এবং আচরণকে অনুকূলভাবে প্রভাবিত করে—যার প্রভাব হয় সুদূরপ্রসারী। এর প্রধান কারণ হলো এ ধরনের পরিবেশে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েরা ঘরের ও বাইরের জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বেশ অসুবিধার মধ্যে পড়ে। তারা আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর হয়ে পড়ে। আজকাল যুব সমাজের আচার-আচরণে কারও মধ্যে যে অস্থির, অশান্ত, দুর্বিনীত এবং বেপরোয়া ভাব ও সুশৃঙ্খল জীবন-যাপনের ব্যাপারে উদাসীনতা দেখা যায়, এর মূলে রয়েছে পরিবারে সহনশীলতার অভাবের মধ্যে বেড়ে ওঠা। অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনগণ উটের মতো সহনশীল ও নরম; যদি আকর্ষণ করা হয় তবে সে আকৃষ্ট হয়, আর যদি পাথরের ওপর উপবিষ্ট করানো হয়, তবে সে উপবিষ্ট হয়।’
সহনশীলতার অভাবের ফলে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই সম্পর্কের ক্ষেত্রে আন্তরিকতার অভাব দেখা দেয়। ফলে পরস্পরের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষের উদ্ভব হয়। পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যেও সহনশীলতার অভাবে ঝগড়া-বিবাদ বা হিংসা-বিদ্বেষের মনোভাবের ফলে সামাজিক শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় এবং শত্রুতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এসবের ফলে সাধারণভাবে ধীরে ধীরে সমাজের মধ্যে অস্থিরতা ও অশান্তি বেড়ে যায় এবং সুস্থ পরিবেশ হুমকির মধ্যে পড়ে। আজকাল বৃহত্তর অর্থে সমাজে যে অশান্তি ও অস্থিরতার ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে, এর মূলে রয়েছে সহনশীলতার অভাব। যার ফলে দুর্বলেরা বারবার সবলদের দ্বারা আক্রান্ত, নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে। অথচ পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সৎকর্মপরায়ণদের শ্রমফল নষ্ট করেন না।’ (সূরা হুদ, আয়াত: ১১৫)
বর্তমানে দেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে সহনশীলতা ও সহমর্মিতা নেই। এমনকি ছোট শিশু, কিশোর, তরুণ ও যুবকদের মধ্যে নেই পারস্পরিক সহনশীলতা ও সহমর্মিতা। সহনশীলতার অভাব ব্যাপকভাবে কর্মক্ষেত্রেও বিক্ষোভের এবং চাপা ক্ষোভের পরিবেশ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে এক বিরাট ভূমিকা পালন করে। এতে সহকর্মীদের মধ্যে সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বের পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে পড়ে, যার ফলে রেষারেষির ভাব এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিশোধমূলক কার্যক্রমের আশঙ্কা ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়। এসব ক্রমশ মানসিক শান্তির বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কর্মক্ষেত্রের অশান্তি পরিবারের মধ্যে সুস্থ সম্পর্কের ওপর অশুভ প্রভাব বিস্তার করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষকে সাবধান করে বলেছেন, ‘বিপদ ও পরীক্ষা যত কঠিন হবে তার প্রতিদানও হবে তত মূল্যবান। আর আল্লাহ যখন কোনো জাতিকে ভালোবাসেন তখন অধিক যাচাই ও সংশোধনের জন্য তাদের বিপদ ও পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। অতঃপর যারা আল্লাহর সিদ্ধান্তকে খুশি হয়ে মেনে নেয় এবং সহনশীলতা অবলম্বন করে, আল্লাহ্ তাদের ওপর সন্তুষ্ট হন। আর যারা বিপদ ও পরীক্ষায় আল্লাহর ওপর অসন্তুষ্ট হয় আল্লাহ্ও তাদের ওপর অসন্তুষ্ট হন।’ (তিরমিজি)
পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য সহনশীলতা একটি উত্তম হাতিয়ার। তবে বর্তমানে আমাদের দেশে রাজনীতির ক্ষেত্রে অসহনশীলতা দুর্বিষহ অবস্থান নিয়ে মানুষের মধ্যে অস্থির ও অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। দেশের আপামর জনসাধারণ এখন যতগুলো রাজনৈতিক দল আছে ততগুলো দলমত, জাতি-গোত্রের ভয়াবহ অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে সংঘাত, হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ফলে সুস্থ রাজনীতি দারুণ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিশৃঙ্খলা শুধু অশান্তিই ডেকে আনে। আর মানুষের দুষ্কৃতি ও অপকর্মের দরুন জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে। তাই আল্লাহ্ তাআলা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না। সুতরাং দেশে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ এবং শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রয়োজন অবিমিশ্র সহনশীলতা ও পারস্পরিক সমঝোতা। সহিংসতা ও সংঘাত এড়ানোর একমাত্র পথ সহনশীলতা। দেশের জনগণের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণে ও জাতির সেবায় মানবতার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার জীবনসংগ্রামে সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মপ্রাণ মানুষকে অত্যন্ত সহনশীল আচরণ করতে হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন