শনিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৩

ব্লগ, ফেসবুক, ইউটিউব- আর সেন্সরশিপ

কাহিনী ধীরে ধীরে অন্য মোড় নিতে শুরু করেছে। ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ আওয়ামী লীগের জন্য শাপে বর না বরে শাপ এই নিয়ে আত্মচিন্তন শুরু হয়েছে। বাম আর লীগ পন্থীদের কাদা ছোড়াছুড়িতে গণজাগরণ মঞ্চের অবস্থা এখন কোমর ভাঙা সাপের মতো। বেঁচে আছে তবে ছোবল দেয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে। বেঁচে আছে বোঝানোর জন্য চলছে ‘স্মারক লিপি’র খেলা।


সরকারের কাছে এখন এই মঞ্চ বেজায় অপ্রয়োজনীয় একটি ঝামেলা। ভোটের বাক্সে কিছু ভোট এনে দিতে পারত ভেবে একাত্মতা ঘোষণা করেছিল। এখন সেই আশার গুড়ে বালি। এখন এই মঞ্চকে সমর্থন দেয়া মানে ‘নাস্তিক’ ‘ধর্মবিদ্বেষী’দের সমর্থন দেয়া। মুসলমান অধ্যুষিত এই দেশে এমন একটি রাজনৈতিক অবস্থান নিজের পায়ে কুড়াল মারার সামিল। তাই সরকারের ‘ইউ টার্ন’ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দুর্দান্ত দক্ষতায় তাঁরা দেখাতে ব্যস্ত, তাঁরা এই ব্লগারদের সঙ্গে কতটা দ্বিমত পোষণ করে। বেশ কিছু ব্লগ বন্ধ, ব্লগার গ্রেপ্তার এবং খুব সম্ভবত; সামনে আসছে কিছু নতুন আইন।

ব্লগ কিংবা ফেসবুকের ওপর তদারকি করার বেশ কিছু বাস্তব সমস্যা আছে। আপনি চাইলেই কারো একজনের ছবি ব্যবহার করে, তাঁর নাম দিয়ে ফেসবুকে একটা আইডি খুলতে পারেন। যার নামে খুলছেন সে হয়তো জানেই না, তাঁর নাম আর ছবি ব্যবহার করে আরেকটা আইডি খোলা হয়েছে। এরপর সেই নকল আইডি ব্যবহার করে যে কেউ সেই প্রথম লোক সেজে যেকোনো কিছু লিখে ফেসবুকে ছড়িয়ে দিতে পারে। দোষ পড়বে আসল লোকের ঘাড়ে। আর এই দ্বিতীয় ব্যক্তি যদি হ্যাকার হয় তবে খুব সহজেই সেই প্রথম ব্যক্তির ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে, তাঁর আসল অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করে যা খুশি তার স্ট্যাটাসে লিখতে পারে।

এখন সমস্যা দেখা দেবে, কাকে শাস্তি দেবেন? কীভাবে প্রমাণ করবেন তার অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়নি। কিংবা তার ছবি ব্যবহার করে আরেকজন এই কাজ করছে না। নেটওয়ার্ক বিশেষজ্ঞরা হয়তো ব্যাপারটা বের করতে পারবেন, কোন কম্পিউটার ব্যবহার করে এই কাজ হয়েছে। সেক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, দেশে রয়েছে প্রচুর সাইবার ক্যাফে, যেখানে আপনি এই কাজ সারতে পারেন।

ফেসবুক আর ব্লগে কি সারাক্ষণ গালিগালাজ আর ধর্মকে কটাক্ষই করা হয়? যারা এই নিয়ে চিৎকার করে গলা ফাটাচ্ছেন তাঁদের অনেকেই হয়তো জীবনে কখনও ফেসবুক ব্যবহারই করেননি। ব্লগে লেখালেখি কিংবা ইন্টারনেট ব্যবহারও আদৌ করেছেন কীনা সন্দেহ। চিলে কান নেয়ার মতো, কোথাও শুনেছে ব্লগে ধর্মকে কটাক্ষ করা হয়েছে, ব্যাস মিছিলে নেমে পড়েছে। কে করেছে কিংবা কটাক্ষ করে কী লিখেছে তা তাঁরা নিজেরাও জানে না।

ফেসবুকের ব্যবহার একটা সময় পর্যন্ত ছিল আড্ডা কিংবা গল্প গুজবের মাধ্যম। মনের কথা, রাগের কথা কিংবা মজার কিছু বলার একটা জায়গা। একসময় তা হয়ে উঠল প্রতিবাদের জায়গা। সরকার, বিরোধী দল কিংবা যেকোনো অপশক্তিকে কটাক্ষ কিংবা ব্যঙ্গ করতে কেউ পিছপা হত না। কথায় যুক্তি থাকলে জুটে যেত ফ্রেন্ড, ফলোয়ার, সাবস্ক্রাইবার। আর না থাকলে নিজেই বলত আর নিজেই দেখত। এই সুযোগ অনেক রাজনৈতিক নেতাও নিয়েছেন। শেয়ার বাজার কারসাজি করতেও এই ফেসবুক ভূমিকা রেখেছে। আর সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে এই গণজাগরণ মঞ্চ।

ব্লগের ব্যাপারটাও অনেকটা সেরকম। কোনো কোনো ব্লগে মডারেশন আছে, অর্থাৎ আপনার লেখা পছন্দ হলে প্রকাশিত হবে, পছন্দ না হলে হবে না। আর অনেকগুলো সরাসরি প্রকাশিত হবে। এখানেও যে যা খুশি লিখতে পারে। প্রকাশিত হওয়ার পরে, যদি তা আপত্তিজনক হয় তবে তা অপসারণও সম্ভব। যা অনেক সময় করা হয়। এখানেও কাউকে আপনি জোর করে পড়াচ্ছেন না। একজন পাঠক চাইলে পড়বে, না চাইলে পড়বে না। আকর্ষণীয় কিছু না লিখলে দেখা যাবে আপনার লেখা দুএকজন ছাড়া কেউ পড়ছে না।

ফেসবুক, ব্লগ কিংবা ইউটিউব চলতে থাকলে এখানে সরকার, বিরোধী দল কিংবা ধর্ম নিয়ে ব্যবসাকারী যে কারোরই যেকোনোদিন মুখোশ উšে§াচন হয়ে যেতে পারে। ফলে এই মুক্তচিন্তার মাধ্যমগুলো বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। খুব অবাক হব না, যদি সংসদ সদস্যদের জন্য বিনা শুল্কে গাড়ি আমদানির মতো এই বিষয়েও সকলের একাত্মতা দেখা যায়। অচিরেই এই সব মাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপ কিংবা প্রতিটি ব্লগে একজন বাধ্যতামূলক সরকারি মডারেটর বসানোর নিয়ম চালু হবে বলেই মনে হচ্ছে।

সরকারের বর্তমান কার্যকলাপ দেখে মনে হচ্ছে এই মুক্তচিন্তার বহিঃপ্রকাশকে তারা অশনি সংকেত হিসেবে দেখছে। এতদিন এদের কার্যকলাপ সরকারকে সুবিধাজনক অবস্থায় রেখেছিল দেখে এদের উৎসাহ দিতে সরকার পিছপা হয়নি। এখনও যখন সরকারকেও এঁরা কটাক্ষ করতে ছাড়ছে না তখন তো আর চুপ করে বসে থাকা যায় না। তাই অতি দ্রুত এই সমস্যার সমাধান জরুরি। আর সমস্যা সমাধানে যে কাজটি করা হবে তা হচ্ছে, এই ফেসবুক আর ব্লগ চিরতরে বন্ধ করে দেয়া। এসবই যত নষ্টের গোঁড়া। এসব থাকলেই লেখালেখি হবে। আর লেখালেখি হলেই কেউ না কেউ আজেবাজে কিছু লিখবে (আসলে রাজনীতিবিদদের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে লিখবে)।

ইউটিউব নিয়ে তৈরি হওয়া সমস্যায় সরকার এই রাস্তায়ই পা বাড়িয়েছিল। কিছু ধর্ম ব্যবসায়ীদের শান্ত করতে। ফলাফল? শান্ত তাঁরা হয়েও ছিল। কারণ খবরটা তখন বেশ গরম ছিল। এরপর? ইউটিউব বন্ধ করে আবার খুলে দিতে হয়েছে। যে ভিডিওর কারণে এই সিদ্ধান্ত সেই ভিডিওটা তো এখনও আছে ইউটিউবে। এখন সেসব ধর্ম ব্যবসায়ীরা কিন্তু চুপ হয়ে আছেন। কারণ খবরটা এখন খুব একটা গরম নেই। এ নিয়ে মিছিল-মিটিং করলে এমন কোনো কাভারেজ পাওয়া যাবে না। রাজনৈতিক লাভও হবে না।

এখন যেহেতু গরম খবর ব্লগ আর ফেসবুক। তাই এখন তাঁরা লেগেছেন ব্লগ আর ফেসবুকের পেছনে। মেরুদণ্ডহীন এই সরকার ফেসবুক কিংবা ব্লগের ক্ষেত্রেও হয়তো এমন কিছু একটা সিদ্ধান্ত নেবে। এবং যথারীতি ধর্মব্যবসায়ীদের শান্ত করা হবে। হয়তো রাজনীতিবিদরা নিজেরাও নিশ্চিন্ত হবে, ‘যাক, আমাদের কটাক্ষ করার আর কেউ থাকল না।’


Source: http://www.amadershomoy2.com/content/2013/04/06/news0096.htm

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন