শনিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৩

যুদ্ধাপরাধের বিচার ইকোনমিস্ট, আইকম্যান ও অপপ্রচার

শেখ হাফিজুর রহমান
ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা দি ইকোনমিস্ট-এর ২৩ মার্চ প্রকাশিত সংখ্যায় বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের ওপর একটি নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছে। ওই নিবন্ধের যে ইংরেজি শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, সেটি বাংলা করলে দাঁড়ায়—‘বাংলাদেশে ন্যায়বিচার: অন্য ধরনের অপরাধ, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক ও রাজনৈতিক পদ্ধতিকে কালিমালিপ্ত করছে’। শিরোনামটি দেখেই যেমন আন্দাজ করেছিলাম নিবন্ধটি একতরফা, পুরোটা পড়ার পর বুঝতে বাকি রইল না যে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবির যে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে, সেই প্রোপাগান্ডার একটি পরিশীলিত রূপ হচ্ছে ইকোনমিস্ট-এ প্রকাশিত নিবন্ধটি। এই নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশের ব্যাপারে সাংবাদিকতার নীতিমালা কতটা পালিত হয়েছে, সে ব্যাপারেও প্রশ্ন তুলতে চাই।


নিবন্ধটি শুরু হয়েছে আইকম্যানের মামলা দিয়ে। আইকম্যানের মামলাটিকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে একটি আদর্শ মামলা হিসেবে উপস্থাপন করে এর আলোকে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। অ্যাডলফ আইকম্যান (Adolf Eichmann) ছিলেন হিটলারের নাৎসি বাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং নির্বিচারে ইহুদি হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের একজন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পর তিনি এক দেশ থেকে আরেক দেশে পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। ১৯৬০ সালে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ তাঁকে আর্জেন্টিনা থেকে অপহরণ করে ইসরায়েলে নিয়ে যায়। এখন প্রশ্ন হলো, মোসাদ অন্য একটি সার্বভৌম দেশ থেকে আইকম্যানকে অপহরণ করে যেভাবে নিজের দেশে নিয়ে গিয়ে তাঁকে বিচারে সোপর্দ করল, ওইভাবে যদি কোনো শক্তিশালী দেশের গোয়েন্দা সংস্থা যুদ্ধাপরাধী বা আন্তর্জাতিক অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অন্য দেশ থেকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে তার দেশে বিচার করে, তাহলে কি চুক্তিভিত্তিক ও প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন মুখ থুবড়ে পড়বে না? তখন ইকোনমিস্ট কী বলবে? জামায়াত-শিবির এবং তাদের পক্ষের ব্যারিস্টার মওদুদ ও খন্দকার মাহবুবরা তখন কোন আন্তর্জাতিক মানের কথা বলবেন?

১৯৬১ সালের ১১ এপ্রিল জেরুজালেমের ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে আইকম্যানের মামলার (Attorney General of Israel vs Adolf Eichmann) শুনানি শুরু হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ১৫টি অভিযোগ আনা হয়, যার মধ্যে ছিল যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, নির্বিচারে ইহুদি হত্যা ইত্যাদি। ইসরায়েলের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন ইসরায়েলের তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল এবং আইকম্যানের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন জার্মানির একজন বিখ্যাত আইনজীবী। ১৯৬১ সালের ১১ ডিসেম্বর তিনজন বিচারক আইকম্যানের বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে আইকম্যান ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্টে একটি আপিল দায়ের করেন {Adolf Eichmann vs. Attorney General of Isreal, Supreme Court of Isreal, ILR 36 (১৯৬২) চ. ২৭৭}। আইকম্যান ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশে সবকিছু করেছেন বলে তাঁকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করেন। সুপ্রিম কোর্ট আইকম্যানের সব যুক্তিতর্ক খারিজ করে দেন এবং তাঁর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।

ইকোনমিস্ট-এর ভাষ্য অনুযায়ী, আইকম্যান মামলার বিচারটি ছিল প্রকাশ্য, ওতে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করা হয়েছিল এবং ওই বিচারে আইনের ‘যথাযথ প্রক্রিয়া’ বা ‘Due Process’ অনুসরণ করা হয়েছিল। কিন্তু অপহরণ করে আইকম্যানকে বিচারে সোপর্দ করা? সেটা কোন আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে করা হয়েছিল? এখন যদি বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা বাচ্চু রাজাকারকে অন্য দেশ থেকে অপহরণ করে এনে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে বা চৌধুরী মাঈনুদ্দীনকে ব্রিটেন থেকে অপহরণ করে এনে তাঁকে বিচারে সোপর্দ করে, তাহলে ইকোনমিস্ট কী বলবে?

বিদ্যমান বাস্তবতা ও প্রেক্ষিত বিবেচনায় না নিয়ে দুই দেশে অনুষ্ঠিত দুটি বিচারের তুলনা করে সিদ্ধান্ত টানা সুবিবেচনার পরিচয় বহন করে না। এবং এই কাজটিই ইকোনমিস্ট করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আইকম্যান নির্বিচারে হাজার হাজার ইহুদি হত্যা করেছিলেন এবং সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ব্যাপারে পুরো ইসরায়েল ছিল এককাট্টা। আগ্রহী ব্যক্তিরা আইকম্যানের মামলার রায় পড়লে সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হতে পারবেন। বাংলাদেশে ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত সত্য হচ্ছে, গোলাম আযম ও নিজামীরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে ৩০ লাখ লোক হত্যা করেছিলেন এবং দুই লাখ নারীকে অসম্মান করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের বিচার যখন চলছে, সেই বিচার বানচাল করার জন্য জামায়াত-শিবির সারা দেশে তাণ্ডব চালাচ্ছে। আর যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য বিএনপি তার পুরো শক্তি নিয়োগ করেছে।

ইকোনমিস্ট-এ প্রকাশিত নিবন্ধের তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে—সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করছে, ট্রাইব্যুনালের প্রকাশ্য আলোচনার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে এবং অভিযুক্তের পক্ষের সাক্ষী কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ অভিযোগগুলোর পক্ষে ইকোনমিস্ট কোনো তথ্য-প্রমাণ হাজির করেনি, যা সাংবাদিকতার নীতিমালার পরিপন্থী। ওই অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে, একটি মামলায় ট্রাইব্যুনালের সভাপতি পদত্যাগ করেছেন এবং এমন তিনজন বিচারক অভিযুক্তকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন, যাঁরা সব সাক্ষীর কথা শোনেননি। উল্লেখ্য, স্কাইপ কথোপকথনের কারণে একটি ট্রাইব্যুনালের সভাপতি পদত্যাগ করলে অভিযুক্ত এবং জামায়াত-বিএনপির আইনজীবীরা বিচারের প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করার কথা বলেন। কিন্তু বিচারের দীর্ঘদিনের প্রথা অনুসরণ করেই সভাপতির পদত্যাগের পর পুনরায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর আইনসংগতভাবেই ওই মামলার রায় প্রদান করা হয়। এ ব্যাপারে ইকোনমিস্ট যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তা আইন ও বিচারের নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

ইকোনমিস্ট-এর নিবন্ধের তৃতীয় অনুচ্ছেদে এসে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পর্কে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে এবং তথ্যের ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত টেনেছে তা একতরফা। এই তথ্য ও সিদ্ধান্তের ভাষার সঙ্গে জামায়াতের তথ্য ও সিদ্ধান্তের সাদৃশ্য রয়েছে। ইকোনমিস্ট যে আইকম্যান মামলার নিরিখে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচারকে তুল্য মূল্য করেছে, সেই মামলার শুনানি সমাপ্ত হয়েছিল আট মাসে। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তিন বছরের বেশি সময় ধরে কেন চলছে? নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে নয় মাসে বিচারকার্য সম্পন্ন করে ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং চারজনকে ১০ থেকে ২০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। তাহলে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে দীর্ঘায়িত করে বিচার বানচালের চেষ্টা কি হচ্ছে না? সাঈদীর মামলায় তদন্ত কর্মকর্তাকে ৪৮ কার্যদিবস জেরা করেছেন সাঈদীর আইনজীবীরা। গোলাম আযমের ছেলে এক মাস ধরে সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। জামায়াত-শিবির হরতাল ডাকছে আর গোলাম আযম, নিজামীদের আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনালে এসে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম মুলতবি করতে বলছেন। এভাবে বিচারকে বিলম্বিত করে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে নস্যাতের চেষ্টা চালাচ্ছে জামায়াত-শিবির ও তার সহযোগীরা।

ইকোনমিস্ট তার নিবন্ধের কোথাও উল্লেখ করেনি যে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন অনুযায়ী স্বচ্ছতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলছে। বিচারে ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ঘাটতির অভিযোগ উঠেছে, কিন্তু সেগুলো গুরুতর কিছু নয়। স্কাইপ কথোপকথনের যে ঘটনা ঘটেছিল, তার জন্য সংশ্লিষ্ট বিচারপতি পদত্যাগ করেছেন। আর ইচ্ছাকৃতভাবে ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে যাঁরা অভিযোগ তুলছেন, তাঁরা তা করছেন বিচারকে নস্যাৎ করার জন্য। আইকম্যানের মামলায় কি ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়নি? আইকম্যান ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্টে যে আপিল করেন, এতে আইকম্যানের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনা করে বলা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর কৃত কর্মকাণ্ডের বিচার করার এখতিয়ার ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের নেই। কেননা, সেই সময় ইসরায়েল রাষ্ট্র ও এই আদালতের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। এ ছাড়া যে আইনের অধীনে তাঁর বিচার চলছে, তার কোনো ভিত্তি নেই। (প্রিয় পাঠক, জামায়াত ও বিএনপির আইনজীবীরা ’৭৩ সালের আইন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পর্কে যে কথা বলছেন, তার সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছেন?) কিন্তু আইকম্যানের সব যুক্তি খারিজ করে দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট তাঁর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।

আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে, ইকোনমিস্ট একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। পত্রিকাটি রিগ্যান ও মার্গারেট থ্যাচার জামানার সমর্থক ছিল। পত্রিকাটি ভিয়েতনামে মার্কিন আক্রমণকে সমর্থন করেছিল। সেই ইকোনমিস্ট বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকও হয়ে যেতে পারে। (যদিও শেষ অনুচ্ছেদে ইকোনমিস্ট বলেছে যে ইকোনমিস্ট-এর জামায়াত বা তার পৃষ্ঠপোষকদের জন্য কোনো সহানুভূতি নেই। যেন ঠাকুরঘরে কে রে? আমি কলা খাই না!) তাতেও আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি আশা করব, ইকোনমিস্ট সাংবাদিকতার ন্যূনতম নীতিমালা অনুসরণ করে ভবিষ্যতে নিবন্ধ প্রকাশ করবে। আর নিবন্ধের ছবি ও পঞ্চম অনুচ্ছেদে শাহবাগের সর্বস্তরের মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে যেভাবে ব্যঙ্গ করা হয়েছে, সেই অধিকার নিশ্চয়ই ইকোনমিস্টকে কেউ দেয়নি।

 শেখ হাফিজুর রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও অপরাধবিজ্ঞান গবেষক। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন