মঙ্গলবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৩

মতিঝিল জমায়েতের সঙ্গে শাহবাগ সমাবেশের পার্থক্য

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী
গত শনিবার (৬ এপ্রিল) সকালে, বাংলাদেশে তখন দুপুর, ঘুম থেকে উঠেই টেলিভিশন ও টেলিফোন দুটোই সামনে নিয়ে বসেছি। হেফাজতে ইসলামের লংমার্চ বা ঢাকা সমাবেশ কতটা সফল হলো সেটা দেখাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। শাহবাগের জাগরণ মঞ্চের দুজন সমর্থক-বন্ধুর সঙ্গে প্রথমেই কথা বলেছি। তাঁরা দুজনেই অকপটে বললেন, বিশাল সমাবেশ। মতিঝিলের শাপলা চত্বরের এই জমায়েত শাহবাগের সমাবেশের চেয়েও বড় হয়েছে।

টেলিভিশনে নিজের চোখেও এই বিশাল সমাবেশ দেখেছি। ঢাকার চারদিক থেকে আগত মিছিলের বক্তাদের বক্তৃতা ও স্লোগানও শুনেছি। রীতিমতো রাজনৈতিক স্লোগান ও বক্তৃতা। কথা ছিল, এটা হবে 'ইসলাম রক্ষার' কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে অরাজনৈতিক শান্তিপূর্ণ সমাবেশ। কিন্তু শনিবারে মতিঝিলগামী একটি মিছিল মহাখালীর কাছে বিনা উসকানিতে গণজাগরণের একটি মঞ্চের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের সভামঞ্চ ও চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করে। মতিঝিল জমায়েত শেষ হওয়ার পরও এই জমায়েতের একটি দল শাহবাগ সমাবেশের ওপর হামলা চালাতে ছুটে গিয়েছিল। শাহবাগ সমাবেশ অবশ্য এই হামলা প্রতিহত করে হামলাকারীদের তাড়া করে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়।
মতিঝিলের জমায়েত অনেক হুমকি-ধমকি দিলেও সার্বিক অর্থে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে, এটাই সবচেয়ে বড় খবর দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে। নইলে মতিঝিলের মিছিল ও মঞ্চ থেকে যেভাবে উসকানিমূলক রাজনৈতিক বক্তব্য ও স্লোগান দেওয়া হয়েছে, অনুরূপ পাল্টা স্লোগান ও বক্তব্য নিয়ে শাহবাগ সমাবেশ থেকে রাস্তায় মিছিল বেরিয়ে এলে বড় রকমের শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা ছিল।
এই শান্তিভঙ্গ আরো এক কারণে ঘটতে পারত, যদি বিএনপি ও জামায়াতের উসকানিতে এই জমায়েত মতিঝিলে আরো কিছুদিন অবস্থান করত এবং শাহবাগ আন্দোলন বানচাল করার জন্য লাগাতার হরতালের ডাক দিত। আমার কানে এসেছে, খবরটা কতটা সঠিক জানি না, হেফাজতের মধ্যে যেসব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নেতা-কর্মী আছেন, যাঁরা জামায়াতের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন- অর্থাৎ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি থেকে বাঁচানোর চেষ্টায় ব্যবহৃত হতে চান না, তাঁদের চাপেই হেফাজত শেষ পর্যন্ত হার্ড লাইনে যেতে পারেনি। গেলে সরকারও হার্ড লাইনে যেত। জাগরণ মঞ্চের জোয়ার এখন একটু স্তিমিত হলেও আবার উত্তাল হয়ে উঠত। এই কনফ্রনটেশন হেফাজতিদের জন্য কল্যাণকর হতো না। এটুকু বোঝার মতো সুবুদ্ধি তারা দেখিয়েছে। জমায়েতের মঞ্চ থেকে ১৩ দফা দাবি জানিয়ে এবং ৮ এপ্রিল হরতাল ডেকেই আপাতত তারা বিরত হয়েছে। তবে সন্ত্রাস থামেনি।
জামায়াত ও বিএনপি তাদের সন্ত্রাস থেকে বিরত থাকতে দেবে তা মনে হয় না। বিএনপি ৮ এপ্রিলের সঙ্গে লেজ মিলিয়ে তাদের পূর্বঘোষিত ১০ এপ্রিলের সমাবেশ বাতিল করে দুই দিন হরতাল ডেকেছে। হেফাজত হরতাল ডেকেছে ৮ এপ্রিল সোমবার। কিন্তু আগের দিন ৭ তারিখেই তারা ঢাকায় ১০টি গাড়ি ভাঙচুর করেছে। হরতালের দিন এক স্থানে রেললাইন উপড়ে ফেলেছে। স্পষ্টই বোঝা যায়, হেফাজতের সাইনবোর্ডের আড়ালেও এই ধ্বংসাত্মক ও নাশকতামূলক কাজ বিএনপি-জামায়াতের।
গত শুক্রবার হেফাজতিদের মতিঝিল জমায়েত থেকে ১৩টি দাবি মানার জন্য সরকারকে আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে। আমি দাবিগুলো পাঠ করে বিস্মিত হয়েছি। আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখলের পর তালেবানরা তাদের কর্মসূচির বিবরণ দিয়ে যে ইশতেহার প্রকাশ করেছিল এবং বিশ্বময় প্রচার করেছিল, হেফাজতের ১৩ দফা সেই তালেবানি কর্মসূচির প্রায় হুবহু প্রতিলিপি।
এই দাবিগুলো স্পষ্টতই নারী অধিকারের বিরোধী। আধুনিক, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের বিরোধী। এসব দাবি মানলে বাংলাদেশকে তার হাজার বছরে সংস্কৃতি, সভ্যতা, ভাষা ও সমাজ-প্রগতি বিসর্জন দিয়ে মধ্যযুগে ফিরে যেতে হবে। এগুলো ইসলাম ধর্মসম্মত দাবিও নয়। ইসলামের নাম ভাঙিয়ে আইয়ামে জাহেলিয়াত তথা অন্ধকার যুগে ফিরে যাওয়ার দাবি।
ধর্ম ও ধর্মান্ধতা এক কথা নয়। সৌদি আরবে ইসলাম ধর্মের খোলস পরিয়ে খ্রিস্টানদের মধ্যে চরম গোঁড়া ও রোমান ক্যাথলিসিজমের মতো সৌদি বাদশাহদের স্বার্থে যে ফ্যানাটিক ওহাবিজমের প্রবর্তন করা হয়, তারই আরো কট্টর প্রতিক্রিয়াশীল রূপ উপমহাদেশের মওদুদীবাদ। আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতায় ওই মওদুদীবাদ বা পলিটিক্যাল ইসলামের জন্ম। জামায়াত এই পলিটিক্যাল ইসলামের সন্তান, যার ধ্বংসাত্মক চেহারা আমরা এখন বাংলাদেশে দেখছি (আমি হেফাজতের ১৩ দফা দাবি নিয়ে আলাদাভাবে আলাদা প্রবন্ধে আলোচনা করব)।
হেফাজতের ১৩ দফা দাবি পাঠ করে বাংলাদেশের যেকোনো ধর্মপ্রাণ শিক্ষিত মুসলমানও শিহরিত হবেন। এগুলো মোটেই ধর্মীয় দাবি নয়, উগ্র ধর্মান্ধ একদল মানুষের সমাজ ও সভ্যতার সর্বপ্রকার বিকাশবিরোধী দাবি। বিএনপি ও এরশাদ সাহেবের জাতীয় পার্টি, দুটি দলই দাবি করে তারা আধুনিক গণতান্ত্রিক দল এবং অসাম্প্রদায়িকও। এই দুটি দলই হেফাজতের মতিঝিল মঞ্চে অংশ নিয়েছিল এবং তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। এখন খালেদা জিয়া ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কাছ থেকে দেশবাসীর জানা দরকার, তাঁরা এই ১৩ দফা দাবি সমর্থন করেন কি না? এই দুটি দল থেকেই এ সম্পর্কে প্রকাশ্য ঘোষণা আসা উচিত।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারেরও এই দাবিগুলো সম্পর্কে মনোভাব স্পষ্ট নয়। বর্তমান সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু আওয়ামী লীগার নন। তিনি সাহস করে ১৩ দফার প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর একজন আওয়ামী লীগার। তিনি বলেছেন, 'হেফাজতের দাবিগুলো তিনি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখছেন।' এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্পর্কে কাদের সিদ্দিকীর অভিযোগগুলোই কি তা হলে সত্য? আমাকে ঢাকার এক প্রধান বুদ্ধিজীবী টেলিফোনে বলেছেন, তিনি মতিঝিলে হেফাজতের মহাসমাবেশ দেখে ভয় পাননি। তিনি ভয় পাচ্ছেন, এই সমাবেশের মোকাবিলায় আওয়ামী লীগসহ দেশের গণতান্ত্রিক বড় দলগুলোর নতজানু ভূমিকা দেখে।
হেফাজতের মতিঝিল জমায়েত সম্পর্কে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা, যাঁদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তাঁরা দুই দল দুই ধরনের মনোভাব পোষণ করে। এক দল বলেছে, সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করেই এই সমাবেশ হয়েছে। তাই তারা বড় কোনো অঘটন না ঘটিয়েই আপাতত চলে গেছে। অন্য দল বলছে, এটা কেবল হেফাজতিদের জমায়েত হলে কথা ছিল না। কিন্তু এই হেফাজতিদের মধ্যে একটা বড় অংশই জামায়াতি। সরকার যদি হেফাজতিদের কিছু কিছু ছাড় দিয়ে কোনো সন্ধি করে থাকেও, জামায়াতিরা তা মানবে না। তাদের ইস্যু কোনো ইসলামী দাবিদাওয়া নয়, তাদের লক্ষ্য ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি থেকে রক্ষা করা। সুতরাং সেই লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত যেকোনো ধর্মীয় ছুতানাতায় সংঘর্ষ ও সন্ত্রাস ঘটানো থেকে তারা নিবৃত্ত হবে না এবং হয়নি। মতিঝিলের সমাবেশ শেষ পর্যন্ত কোথায় গড়াবে- তা বুঝতে কারোই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
আমার নিজেরও ধারণা, মতিঝিল জমায়েত একটি ধর্মীয় দাবিদাওয়াভিত্তিক অরাজনৈতিক সমাবেশ নয়। তাদের আসল এজেন্ডা জাগরণ মঞ্চকে প্রতিহত করা এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করা। সুতরাং হেফাজতকে জামায়াতিদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য সরকার শাহবাগের চেতনাকে জাগ্রত রাখার চেষ্টা না করে যদি হেফাজতিদের সঙ্গে কোনো সন্ধি করে থাকে, তা কোনো কাজ দেবে না; বরং সাধারণ মানুষের কাছে সরকারের ক্রেডিবিলিটি নষ্ট করবে। সন্ধি দ্বারা যে সন্ত্রাস বন্ধ হবে না, তার প্রমাণ তো পাওয়া যাচ্ছে।
মতিঝিল জমায়েত যে অরাজনৈতিক সমাবেশ নয়, তা শুরু থেকেই প্রকাশ পেতে শুরু করে। বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোট বহু আগেই এই জমায়েতের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে। শুক্রবারের সমাবেশে বিএনপির প্রতিনিধি দলও এসে আসন গ্রহণ করেছে। সমাবেশে স্লোগান দেওয়া হয়েছে, 'ভারতের দালালেরা হুঁশিয়ার'; 'চলো চলো শাহবাগ চলো'; 'শাহবাগ গুঁড়িয়ে দাও-পুড়িয়ে দাও' ইত্যাদি।
দুই দিন আগে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। এক ছাত্রলীগ নেতাও সম্ভবত গুরুতর আহত। ঢাকার মহাখালীতে একটি জাগরণ মঞ্চ ধ্বংস করা হয়েছে। গত শনিবার প্রেসক্লাবের সামনে এক পুলিশ কর্মকর্তার ওপর পানির বোতল ছুড়ে মারা হয়েছে। যদিও হেফাজতি মিছিলের প্রেসক্লাবের সামনে যাওয়ার কথা ছিল না, অনুমতিও ছিল না।
এখন প্রশ্ন, এই ছোট ও বিক্ষিপ্ত ঘটনাগুলো বড় সংঘর্ষের সূচনা ঘটাবে কি না! আমার আশঙ্কা, সরকারের যদি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি না থাকে, তাহলে বড় ধরনের সন্ত্রাস ও সংঘর্ষের জন্য দেশের মানুষকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এই সন্ত্রাস ও সংঘর্ষ জাগরণ মঞ্চ বা ২৭টি সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠনের আন্দোলন থেকে ঘটানো হবে না। ঘটানো হবে হেফাজতের সভা-সমাবেশ থেকেই। পেছনে থাকবে জামায়াত ও বিএনপি।
এ ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা দেখে মনে হচ্ছে, তারা 'বরের ঘরের পিসি এবং কনের ঘরের মাসি' থাকতে চায়। তবে এ ক্ষেত্রে বরের ঘরের মাসি হওয়ার দিকেই আওয়ামী লীগ সরকারের বেশি প্রবণতা। কনফ্রনটেশন এড়ানো সরকারের সদিচ্ছা বলে অনেক মনে করেন। কিন্তু সেই কনফ্রনটেশন শেষ পর্যন্ত সরকার এড়াতে পারবে কি না, আমার সন্দেহ আছে। হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক ইসলামী আন্দোলন হলে কথা ছিল না। কিন্তু শুরু থেকেই তারা জামায়াত ও বিএনপির রাজনৈতিক খপ্পরে পড়ে গেছে।
দেশের রাজনীতিতে সুস্পষ্টভাবে মেরুকরণ বা পোলারাইজেশন ঘটে গেছে। মোটা দাগে এই মেরুকরণকে বলা হয় স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষের মেরুকরণ। এই মেরুকরণে আওয়ামী লীগকে স্বাধীনতার পক্ষের প্রধান নেতৃস্থানীয় দল বলে সবাই মনে করে এবং মেনে নিয়েছে। এখন সহসা যেকোনো কারণেই হোক, আওয়ামী লীগ সরকার এই দুই মেরুকরণের বাইরে দ্বৈত ভূমিকা গ্রহণ করতে চাইলে তা দলটির ও দেশেরও সর্বনাশ করবে।
আমাদের বাঙালিদের একটা বড় দুর্বলতা, আমরা হুজুগে মাতার জাতি। সহজেই ইস্পাতের মতো গরম হয়ে উঠি এবং সহজেই শীতল হয়ে যাই। শাহবাগ চত্বরের জাগরণের সময় যাঁদের অতি উত্তেজিত হতে দেখেছি, তাঁদের অনেকেই এখন মতিঝিল চত্বরের বিশাল হেফাজতি সমাবেশ দেখে ততোধিক শীতল হয়ে পড়েছেন। তাঁদের একজনকে টেলিফোন করতেই তিনি পরম আক্ষেপের সুরে বলেছেন, নাহ, দেশটা তালেবান হয়ে যাচ্ছে। দেখেছেন, মতিঝিলের (৬ এপ্রিল) জমায়েত শাহবাগের সমাবেশের চেয়েও বড়।
বন্ধুকে বলেছি, আপনি যত তাড়াতাড়ি হতাশ হয়েছেন, আমি তত তাড়াতাড়ি হতাশ হতে রাজি নই। আপনি শাহবাগ ও মতিঝিলের পার্থক্য কি লক্ষ্য করেছেন? শাহবাগ সমাবেশ ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে স্বতঃস্ফূর্ত গণসমাবেশ। তাতে টুপিধারীরা যেমন ছিলেন, তেমনি টুপিহীন বিশাল জনতাও ছিল। ছিল আবাল-বৃদ্ধবনিতা। এক দিন-দু দিন নয়, মাসাধিককাল তারা আন্দোলনের মাঠে অবস্থান করেছে। আট বছরের শিশুও এই আন্দালনে প্লাকার্ড হাতে এসে দাঁড়িয়েছে।
বন্ধুকে আরো বললাম, শাহবাগের পাশাপাশি মতিঝিল জামায়েতের দিকে তাকিয়ে দেখুন। কিছু জিনসের শার্ট-প্যান্ট পরিহিত জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার ছাড়া টুপি ও পাগড়িবিহীন আর কোনো সাধারণ মানুষ দেখছেন কি? এই জমায়েতে সাধারণ মানুষ- বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের আধুনিক শিক্ষিত তরুণদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এই জমায়েত প্রধানত মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রদের। দেশে এখন মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্রদের সংখ্যা দিনের পর দিন বেড়ে গিয়ে ৫০-৬০ লাখে দাঁড়িয়েছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় ও সেই ব্যবস্থাপনার বাইরে লক্ষাধিক মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। অধিকাংশ মসজিদ-মাদ্রাসা এখন জামায়াতিদের নিয়ন্ত্রণে। জামায়াত ও মৌলবাদী দলগুলোর পাওয়ার বেজ বা শক্তিকেন্দ্র এখন এই মসজিদ-মাদ্রাসা। ইচ্ছে করলেই তারা এই মসজিদ মাদ্রাসার সাহায্যে কয়েক লাখ লোক জড়ো করতে পারে। দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে তারা তাই করেছে।
মনে রাখতে হবে, শাহবাগ চত্বরের সমাবেশ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত আমজনতার সমাবেশ। এই সমাবেশ ঘটানোর জন্য কোনো দল বা শিবির বিপুল অর্থ ব্যয়ে দীর্ঘ প্রস্তুতি চালায়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নারী-শিশু-বৃদ্ধ-নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। অন্যদিকে মতিঝিলের সমাবেশ ধর্মের নাম ভাঙিয়ে, পূর্ব ঘোষণা দিয়ে ও দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে, অঢেল অর্থ ঢেলে তবেই করা সম্ভব হয়েছে। সরকার এই সমাবেশে আন্তরিকভাবে বাধা দিতে চাইলে, প্রিয়েম্ভটিভ অ্যাকশন নিলে (যেমন নিয়েছিল সাবেক বিএনপি সরকার আওয়ামী লীগের ঢাকা অবরোধ বানচাল করার জন্য এবং করেছিলও) কী হতো আমি জানি না। আওয়ামী লীগ সরকার তা নেয়নি। তারা শুরু থেকেই হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতা করার চেষ্টা করেছে।
এই হেফাজতি সমাবেশ ঘটায় একটা ভালো প্রতিক্রিয়া দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যুবসমাজের মধ্যে আবার শাহবাগ স্পিরিট জেগে উঠেছে। এই জাগরণের বৈশিষ্ট্য, তারা আক্রান্ত হয়েও এখন পর্যন্ত শান্তি বজায় রেখেছে। মতিঝিল জমায়েত যতই বিরাট ও মিলিট্যান্ট হোক, চূড়ান্ত জয় হবে আমজনতার এবং একাত্তরের চেতনারই। এই ব্যাপারে আমি স্থির নিশ্চিত।

লন্ডন, ৮ এপ্রিল, সোমবার, ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন