রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৩

ডিজিটাল অপরাধ ও তার প্রতিকার

মোস্তাফা জব্বার
ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি দেশে যতোটা আলোচিত হয়েছিল তার চাইতে অনেক বেশি আলোচনার বিষয় এখন ডিজিটাল অপরাধ। বিশেষ করে ব্লগে ইসলাম ধর্মের অবমাননা, ফেসবুকে পেজ খুলে ইসলাম ধর্মের বিপক্ষে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারবন্ধের দাবিতে প্রচারণা, দেশকে তালেবানি রাষ্ট্র বানানোর স্বপক্ষে অপপ্রচার, আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ও অন্তত ৪ জন ব্লগার গ্রেফতার, মাহমুদুর রহমান ও ব্লগারদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা এখন চরমে। সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কমিটি গঠন, হেফাজতে ইসলাম ও গণজাগরণ মঞ্চ কর্তৃক পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ, রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ ও সাংবাদিকসহ সকলেরই এখন আলোচ্য বিষয় বাংলাদেশের ইতিহাসের ভয়াবহতম ডিজিটাল অপরাধ।
ডিজিটাল অপরাধকে ভিত্তি করে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস, হত্যা, গুম, আক্রমণ, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদির এতো ব্যাপকতা এর আগে এ দেশে কখনো দেখা যায়নি। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে টেলিভিশনের টক শো ও রাজনৈতিক পরিম-ল সর্বত্রই এর ব্যাপক আলোচনা। আমার ধারণা; দিনে দিনে ডিজিটাল অপরাধের পরিধি বাগবে এবং এই আলোচনার পরিধি আরো বাড়তে থাকবে। দিনে দিনে ডিজিটাল অপরাধ, তার প্রতিকার, প্রতিরোধ, তদন্ত, বিচার ও শাস্তির বিষয়গুলোও ব্যাপকভাবে আলোচিত হতে থাকবে। বিদ্যমান অবস্থা, প্রচলিত আইন এবং তার প্রয়োগের বাইরে আমাদেরকে ভাবতে হবে নতুন ডিজিটাল অপরাধ কেমন করে মোকাবেলা করতে হবে। এমনকি এখনই যে অবস্থায় আমরা বিরাজ করছি সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পথটাও আমাদেরকে খুঁজতে হবে। আমি মনে করি, বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব পাবার দাবি রাখে। পুরো প্রসঙ্গটিই অনুপুক্সক্ষ আলোচিত হতে পারে।

এতোদিন আমরা কেবল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মানুষেরা ইন্টারনেটের অপরাধ বা সাইবার ক্রাইম নিয়ে আলোচনা করতাম। কিন্তু এখন বিষয়টি তার মাঝে সীমিত নেই। মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট পিসি বা স্মার্ট ফোন থেকে শুরু করে ডেস্কটপ পিসি বা কম্পিউটার সিস্টেম পর্যন্ত বিস্তৃত সকল ডিজিটাল যন্ত্রের সাথে অপরাধের সম্পৃক্ততা তৈরি হয়েছে। শুধুমাত্র সাইবার ক্রাইম বলে এখন সকল অপরাধকে চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রচরিত ধরন-ধারণও বদলে গেছে। আর সেই কারণেই আমি ডিজিটার যন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অপরাধ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই।

বাংলাদেশে ডিজিটাল যন্ত্র : বাংলাদেশে কম্পিউটার আসে ১৯৬৪ সালে। তবে কম্পিউটার যন্ত্র এবং অন্যান্য ডিজিটাল যন্ত্রের সঙ্গে আমাদের জানাশোনা ’৮৭ সালের পর। ’৮৭ সালে আমাদের কম্পিউটারে বাংলা আসে আর মুদ্রণ ও প্রকাশনার জগতে ঘটে বিপ্লব। ধীরে ধীরে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যাংকে কম্পিউটারের প্রসার ঘটে। তবে আমাদের ডিজিটাল জগত গড়ে ওঠে মোবাইলের মনোপলি ভাঙা ও ইন্টারনেটের প্রসারের পর। বস্তুত ’৯৫ সালে ইন্টারনেট দুনিয়াজোড়া বিস্তৃত হবার সকল বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে। বাংলাদেশেও তখন অফলাইন ইন্টারনেট চালু হয়। তবে এ দেশে ’৯৬ সালের জুন মাসে আসে অনলাইন ইন্টারনেট। ’৯৭ সালে ভাঙে মোবাইলের মনোপলি। এই শতকের ২০০৭-০৮ সালের দিকে মোবাইল বা ইন্টারনেট দুই ধারাতেই বেশ ভালো গতির সঞ্চার হয়। তবে সবচেয়ে বেশি প্রসার হয় ২০০৯ সালের পর। ২০১৩ সালে মোবাইলের ব্যবহার ২০০৮-এর তুলনায় দ্বিগুণ এবং ইন্টারনেটের ব্যবহার বহু গুণ হয়ে পড়ে। এর পেছনে ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির যথেষ্ট অবদান রয়েছে।

২০০৮ সালের শেষে আসে ডিজিটাল বাংলাদেশের কর্মসূচি। ফলে এতোদিনে কম্পিউটারের জগৎটা ডিজিটাল জগৎ হয়ে গেছে। শুধুমাত্র ডিজিটাল যন্ত্রকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা প্রযুক্তি এখন সভ্যতার নিয়ামকে পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে ডিজিটাল জগৎ ও তার ওপর বিত্তি করে গড়ে ওঠা অপরাধের জগৎও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকে। দেশে এতোদিন পর্যন্ত ডিজিটাল জগতের অপরাধগুলো প্রধানত ব্যক্তিগত বিষয় ছিল। মাঝেমধ্যে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক সংস্থাগুলো ডিজিটাল অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হলেও বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হতে থাকে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পর থেকে। প্রথমে ২০১২ সালের ১৪ ডিসেম্বর সরকার ডিজিটাল অপরাধ বিষয়ক প্রথম মামলা করে। সেই মামলার আসামি হলেন আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। পরে এপ্রিল মাসে সরকার ৪ জন ব্লগারের বিরুদ্ধেও ডিজিটাল অপরাধের মামলা করে। সব কটি মামলাই আইসিটি এ্যাক্ট ২০০৬ (২০০৯ সালে সংশোধিত) এর আওতায় করা।

আমাদের নিজেদের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নির্ভর একটি সমৃদ্ধ দেশ এবং সারা দুনিয়ার জন্য একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার প্রত্যয় এরই মাঝে আমরা প্রকাশ করেছি। একদিকে একে আমরা বলছি তথ্যের মহাসরণি, অন্যদিকে নীল আকাশের সঙ্গে আমাদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক কর্মকা-কে যুক্ত করছি। আমার নিজের কাছে বিষয়টিকে খুব সঙ্গত ও মনোমুগ্ধকর মনে হয়। নীল আকাশের সঙ্গে যদি আমরা সাইবার জগৎটাকে তুলনা করি এবং আমাদের বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত ইন্টারনেটকে যদি নীল আকাশের গ্রহ, নক্ষত্র, তারা মনে করি তবে একে নিরাপদ রাখা আমাদের জন্য এক অতি আবশ্যকীয় কাজ বলে মনে হবে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ যেমন করে এই আকাশটাকে শেয়ার করি তেমনি সাইবার আকাশটাকেও আমরা শেয়ার করি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের সেই আকাশটা কি নীল রঙে মুগ্ধ করার মতো অবস্থাতে আছে? নীল আকাশে কি শকুনের পাখার শব্দ আমরা শুনছি না? একটি পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ, ভাসতে ভাসতে ভেলায় উড়ে বেড়ানোর মতো নীল ডিজিটাল আকাশ কি আমরা পাই? প্রতিদিন কি আমরা শকুনের থাবায় পড়ছি না। যাকে বলে সাইবার আকাশ তাতেই কি সাইবার অপরাধ আতঙ্ক সৃষ্টি করছে না? আমরা কি নিজের জন্য, নিজের সন্তানের জন্য, নিজের ব্যবসার জন্য, সমাজের জন্য বা রাষ্ট্রের জন্য শঙ্কিত নই?

ডিজিটাল অপরাধের আতঙ্ক : আমরাতো কোনো ছার, ডিজিটাল অপরাধ নিয়ে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। দিনে দিনে তারা এই ধারণা করছে যে, দুনিয়াতে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও মানুষের জীবনধারা ক্রমশ ডিজিটাল অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধশক্তি, এমনকি পরমাণু শক্তি পর্যন্ত ডিজিটাল অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে যেতে পারে বা তারা ডিজিটাল হামলার শিকার হতে পারে বলে মনে করা হয়। বিষয়টি অর্থগত বা শারীরিক শক্তির চাইতে অনেক বেশি মেধার শক্তি বলে এই আশঙ্কা এতোটাই প্রবল যে, তারা মনে করে আফগানিস্তানের পাহাড়ে বসবাসকারী কোন জঙ্গি বা মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের কোনো বালক পেন্টাগনে আঘাত হানতে পারে। এই অস্ত্রটি প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে তারাও যে পিছিয়ে নেই তার প্রমাণ রয়েছে। অন্যদিকে আমেরিকা এখন কেবলমাত্র অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করার কথাই ভাবছে না। তারাও ডিজিটাল আক্রমণ করছে। ইরানের পরমাণু শক্তির কম্পিউটারে ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টার সঙ্গে পেন্টাগন জড়িত বলে মনে করা হয়।

এক সময়ে ডিজিটাল অপরাধকে সাইবার ক্রাইম হিসেবে গণ্য করা হতো এবং তাকে মনে করা হতো যে সেটি কেবল কম্পিউটারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত একটি বিষয়। কেউ একটি ওয়েবসাইট হ্যাক করলো বা কেউ কারো মেইল একাউন্ট হ্যাক করলো, কারো ফেসবুক একাউন্টে কেউ একটি বকা দিলো বা ব্লগে একটি বাজে মন্তব্য প্রকাশিত হলোÑ তার নামই বুঝি সাইবার ক্রাইম ছিল। আমাদের মতো দেশে এখনো হয়তো সাইবার অপরাধ বলতে তেমনটিই বোঝানো হয়ে থাকে। কিন্তু তেমন অবস্থাটি দিনে দিনে আমূল বদলে যাচ্ছে। যতোই কম্পিউটারের ব্যবহার বাড়ছে, যতোই আমরা ইন্টারনেটে যুক্ত হচ্ছি, যতোই মোবাইল ফোন, স্মার্ট ফোন বা ট্যাবলেটের দিকে আমরা ঝুঁকছি ততোই ডিজিটাল অপরাধের জগৎ আমাদের কাছে অনেক বেশি দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।

এক সময়ে দেশের সাধারণ অবকাঠামো ও স্থাপনা, যেমন বিদ্যুৎ-গ্যাস, কলকারখানা বা যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের প্রযুক্তির সঙ্গে সাইবার অপরাধকে যুক্ত বলে বিবেচনা করা হতো না। কিন্তু এখন সম্ভবত সেই সময়টি পাল্টে যাচ্ছে। গত ৩০ জুলাই ১২ ভোর রাত ২-৩০ মিনিটে ভারতের অর্ধেক অংশ জুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। একে ন্যাশনাল পাওয়ার গ্রিড ফেইলার বলে মনে করা হয়। কিন্তু কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, এটি আসলে ডিজিটাল ক্রাইম। এমনি করে এটি প্রায় প্রমাণিত যে, ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমের কম্পিউারগুলো এক ধরনের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল যার মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশটির পারমাণবিক কার্যক্রম স্তব্ধ করে দেয়া। এ জন্য ইরানকে ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার কথা ভাবতে হচ্ছে। এস্তোনিয়া নামক একটি দেশের সব প্রশাসন সাইবার হামলায় স্থবির হয়ে পড়েছিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন দুনিয়াতে পরের যুদ্ধগুলো সাইবার যুদ্ধই হবে।

তবে দেশে দেশে যুদ্ধ হবার পাশাপাশি আমরা ব্যক্তিজীবনে কি নিরাপদ? দুনিয়াতে মানুষের ব্যক্তিজীবনেও এসব অপরাধ অহরহ ঘটছে।

বাংলাদেশে ডিজিটাল অপরাধ : ডিজিটাল জগতে ছোট খাটো অপরাধ ঘটে চলেছে এই প্রযুক্তির সূচনা থেকেই। কম্পিউটারের নেটওয়ার্কে হামলা, হার্ডডিস্ক ক্ষতিগ্রস্ত করা, ডাটা নষ্ট করা, হ্যাকিং করা বা মোবাইল ফোনকে অপরাধের কাজে ব্যবহার করাটা সমাজে চলেই আসছিল।

তবে সাম্প্রতিককালে ধর্ম ডিজিটাল অপরাধের একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে পরে আমরা আরো বিস্তারিত আলোচনা করবো। অন্যদিকে এই ধরনের অপরাধের বড় শিকার হচ্ছেন দেশের প্রখ্যাত মানুষরা। বহুদিন ধরেই আমাদের দেশের খ্যাতিমান মানুষদের নানাভাবে চরিত্র হননের শিকার বানানো হচ্ছে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে মিথ্যা ভিডিও এবং পোস্টার-ব্যানার বানিয়ে ফেসবুক, ব্লগ ও ইন্টারনেটের নানা শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এসব মিডিয়ায় লেখার সময় কেউ একবার কোনো আইনের তোয়াক্কাও করেনি। রাজনীতি নিয়ে ইন্টারনেটে লাগামহীনভাবে পক্ষে-বিপক্ষে প্রচারণা চালানোতো অতি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এমন ঘটনা একটি দুটি নয়, হাজার হাজার ঘটছে। এমনকি কোনো মানুষের বিরুদ্ধে প্রমাণহীনভাবে কুৎসা রটানো হচ্ছে। এতে নাম পরিচয় গোপন করে একজন মানুষ তার যা খুশি তাই লিখতে পারে এবং যারা এসব তথ্য প্রকাশ করেন তাদেরকে কোনো লেখা প্রকাশ করার জন্য কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। কেবলমাত্র লেখার কথাই বলি কেন, ইন্টারনেটে কুৎসিৎ কদাকার ভিডিও বা ছবি প্রকাশ করা বা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে এসব প্রস্তুত করে ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে। মেইল থেকে শুরু করে ফেসবুক পর্যন্ত সর্বত্র এইসব অপরাধ ছড়াচ্ছে।

ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০১৩

মোস্তাফা জব্বার : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট।
ভোরের কাগজ : রবিবার, ২১ এপ্রিল ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন