রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৩

মৌলবাদী হলে এ রাষ্ট্রের প্রয়োজন নেই

মুনতাসীর মামুন
অপরিমিত কোন কিছুই জীবনচর্চার জন্য প্রীতিপদ নয়। পরিমিতিবোধ জীবনকে সুস্থ ও সুন্দর রাখে। এটি কোন আপ্তবাক্য নয়, বহু দিনের অভিজ্ঞতার ফল।
আমাদের দেশে এখন পরিমিতিবোধ লুপ্তপ্রায় শব্দে পরিণত হয়েছে। রাজনীতি, ধর্ম, সমাজ কোনখানেই পরিমিতি শব্দটির দেখা মিলবে না। রাজনীতিতে যাঁরা আছেন তাঁদের সবাই কখনও না কখনও ক্ষমতায় ছিলেন। সামরিক শাসকরা ছিলেন। কে পরিমিতবোধ দেখিয়েছেন? জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকার জন্য কয়েক হাজার সেনা খুন করিয়েছেন বিচারের নামে, বাংলাদেশের মৌল চরিত্রের বদল ঘটিয়েছেন এবং ধর্মকে রাজনীতিতে নিয়ে এসেছেন, ঘাতকদের ক্ষমতায় বসিয়েছেন, ঋণখেলাপীদের সৃষ্টি করেছেন। একাত্তরের ঘাতক শুধু নয়, বিভিন্ন শ্রেণীর ঘাতককে ছাড় দিয়েছেন। জাগপা নামে কয়েকটি ব্যক্তির পার্টির প্রধান শফিউল আলম প্রধানকে বঙ্গবন্ধু আমলে কয়েকজন ছাত্রকে হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন দেয়া হয়েছিল। জিয়া তাকে ছেড়ে দেন।
এরশাদ একই কাজ করেছেন। তবে জিনা, টাকা চুরিতে বাংলাদেশে কেউ তাকে এখনও হারাতে পারেনি। এসব ব্যভিচার আড়াল করতে তিনি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেন। বাঙালী তাকে ধরে নিল ইসলামের রক্ষক হিসেবে। অথচ এই বাঙালী ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য ১৯৭১ সালে প্রাণ দিয়েছিল।
বেগম জিয়ার দুই আমল দুর্নীতি, এথনিক ক্লিনজিং, ঘাতকদের ক্ষমতায় আসীন, প্রতিষ্ঠান বিনষ্ট করার সময়। তার আশপাশের লোকজন ঠগ, খুনী, বর্ণচোরা হিসেবে সমাজে পরিচিত। তার দুই পুত্র আন্তর্জাতিকভাবে দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তিনি হচ্ছেন ইসলামের রক্ষক। ‘ইসলাম বিপন্ন’ এই বুলি প্রায়ই তার মুখে শোনা যায়। অথচ জীবনচর্চায় ইসলামের কোন চিহ্ন আছে বলে তার কোন বন্ধুও বলবে না।
আওয়ামী লীগের দুই আমলেই দুর্নীতি হয়েছে, পরিমাণে কম হতে পারে, হয়েছে এবং হচ্ছে- এটি প্রধানমন্ত্রী ছাড়া সবাই কমবেশি জানেন। দুই আমলই, বিশেষ করে এই আমলে ধর্মবাজদের ও সামরিক বাহিনীকে তোষণ ছিল সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। পার্টিতে এবং সরকারে অযোগ্য লোকদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ বিশেষভাবে খ্যাত। বিশেষ করে ব্যক্তিটি যদি খানিকটা বিএনপি ও জামায়াত ঘেঁষা হয় তা হলে তো কথাই নেই। গোপালগঞ্জ হলে সব মাফ। এ কথা কারও মনে থাকে না, গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু জন্মেছেন বটে, কিন্তু সেখানে ‘মুফতি’ হান্নানের মতো পাষ-ও জন্মেছে, যে বঙ্গবন্ধুকন্যার হত্যার সঙ্গে জড়িত।
এসব কারণে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। ধর্মনিরপেক্ষ যে রাষ্ট্র গঠনের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা আজ প্রায় ধর্ম [ইতিবাচক অর্থে নয়] রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে। যেসব ঘটনা ইদানীং ঘটছে, তাতে কারও যদি সন্দেহ হয় ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। তাহলে বোধহয় দোষ দেয়া যাবে না।
পাকিস্তান আমলে ধর্মকে রাষ্ট্রীয় পোষকতা দেয়া হয়েছে। তারপরও বলব ধর্ম নিয়ে এত বাড়াবাড়ি হয়নি। তা সত্ত্বেও লড়াইটা হয়েছিল ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার জন্য। ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞাও বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন যা যুক্তিযুক্ত। ১৯৭১ সালে ধর্মের নামে এ রকম অধর্ম হওয়া সত্ত্বেও রাজনীতিবিদদের ধর্মের প্রতি মনোযোগ দিতে হয়েছিল। পাকিস্তানী মানস ১৯৭১ সালে মুছে ফেলা যায়নি। যে কারণে খুব সম্ভব ১৯৭৩ সালে ১৯৭১-এর অন্যতম পরিকল্পনাকারী ভুট্টো ঢাকা এলে বাঙালীরা রাস্তার দু’পাশে লাইন করে দাঁড়িয়েছিল, বঙ্গবন্ধুকে ওআইসিতে যেতে হয়েছে। সুতরাং জাতি হিসেবে ১৯৭১ সাল ছাড়া গর্ব করার কিছু আমাদের নেই এবং সেটিও থাকবে না, কারণ; ১৯৭১ সালে যারা যুদ্ধ করেছিলেন তাঁদের একটা বড় অংশ খুনী জামায়াতীদের সঙ্গে শুধু হাতই মেলাননি, তাদের সঙ্গে থেকে গর্ববোধ করছেন।
বঙ্গবন্ধু ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেননি। করতে দেনওনি। তিনিই বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান যিনি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। কেউ কোন আপত্তি করেনি। হয়ত ১০টি বছর ধারাবাহিকভাবে তিনি শাসন করতে পারলে ধর্মব্যবসাটা হতো না। ধর্মবোধটা থাকত।
ধর্মটাকে ব্যবসা হিসেবে প্রথম গ্রহণ করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। বলা নেই কওয়া নয়, তিনি আমাদের মুসলমান করাতে চাইলেন। যেমন, জামায়াত এখন কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগারদের মসজিদে নিয়ে তওবা করিয়ে মুসলমান বানাচ্ছে। সংবিধানের ওপর নিজের মুসলমানত্ব জাহির করার জন্য বিসমিল্লাহ বসালেন। যে লোকটি রক্তগঙ্গা বইয়ে ক্ষমতায় এলেন তিনিই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু করলেন। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেন এবং দেশটি যে পাকিস্তানে বা দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাস করে সে জন্য রাজাকার আলবদরদের ক্ষমতায় আনলেন।
এরশাদের মতো স্বৈরাচারী, ব্যভিচারী আটরশির পীর, আলবদর আবদুল মান্নান, মসজিদ নিয়ে এমন মাতামাতি শুরু করলেন যে, মাদ্রাসাভিত্তিক দল/গ্রুপ তার সমর্থক হয়ে উঠল। এরশাদ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে কাজটি করলেন, তাহলো রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে। এ রকম একটা খবিশ এ রকম একটা খচরামি করলেন কিন্তু দিব্বি এখনও রাজনীতি করে যাচ্ছেন। এ জন্য বলছিলাম বাঙালীর দিলে প্রবল সমস্যা আছে। এ জাতি ভ-ামি পছন্দ করে।
ইসলামবিরোধী যত কাজ আছে তার সব কিছু বিএনপি ও খালেদা জিয়া করেছেন। রাষ্ট্রীয় পোষকতায় তিনি জঙ্গীবাদের প্রসার ঘটিয়েছেন। অনবরত মিথ্যা বলেছেন। নিজে, পরিবার ও দল দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থেকেছে। তার সবচেয়ে বড় ধর্মবিরোধী কাজ জামায়াতকে ক্ষমতায় বসান এবং রাষ্ট্রীয় পোষকতায় বিরোধী দলের নেতাকে হত্যার চেষ্টা।
গত তিন দশক দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্ম শুধু পোষকতা পেয়েছে এবং ধর্ম যাতে, ‘অটুট’ থাকে বিভিন্নভাবে তার বন্দোবস্ত নেয়া হয়েছে। যেমন, রাষ্ট্রীয় ভবনগুলোর দেয়ালে আয়াতের অংশ, বিমানবন্দরে আরবী হরফে নাম, বক্তৃতা-বিবৃতির আগে যাতে সবাই শুনতে পায় সে রকমভাবে ‘বিসমিল্লাহ’ উচ্চারণ ইত্যাদি। গণমাধ্যমের দুই অংশেই পত্র-পত্রিকা এবং দূরদর্শনে ধর্ম সম্পর্কে একটি পৃষ্ঠা বা সøøট বরাদ্দ, এমপিদের হাজিরা দিতে হয় নিয়মিত ওয়াজ মাহফিলে। প্রাথমিক/মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বেশি নজর দিতে হয় মাদ্রাসায়। এর কিছু ব্যত্যয় হলেই চিৎকার ওঠে ধর্ম গেল ধর্ম গেল।
আওয়ামী লীগ বা মৃদু বাম দলগুলোকে সাধারণত ধরে নেয়া হয়- তারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করবে না বা করে না। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ধারকবাহক হিসেবে তাদেরই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু ধর্মব্যবসা ও ধর্ম বিভ্রান্তির টাইফুনে তারাও জেরবার। যে কারণে শেখ হাসিনা তাহাজ্জুদের নামাজ থেকে শুরু করে ধর্মকর্মের সব মানলেও তাকে ধরা হয় কম মুসলমান, কোন কোন ক্ষেত্রে শুধু হিন্দুদের রক্ষক হিসেবে। আর খালেদা জিয়ার সঙ্গে নিত্যধর্ম পালনে ঘাটতি থাকলেও তাকে মনে করা হয় সাচ্চা মুসলমান, মুসলমানদের রক্ষক- যিনি জিহাদ রক্ষা করবেন। ১৯৭৫ সালের পর থেকেই এই অবস্থা, তা নয়। সেই চল্লিশ দশক থেকেই অদ্ভুত এক মানসিক গড়ন তৈরি হয়েছে উপমহাদেশে। দ্বিজাতিতত্ত্ব যতই জোরালো হয়েছে ততই সে তত্ত্ব ধমনীতে একেবারে মিশে গেছে। সে কারণে হ্যাম খাওয়া, ইসলামের সঙ্গে অসম্পর্কিত, মদ্যপানে অভ্যস্ত, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হয়ে ওঠেন ইসলামের ধারক। আর গড়ের মাঠে এক দশক ঈদের নামাজে ইমামতি করা, সমসাময়িককালে সবচেয়ে বড় ইসলামী প-িত হিসেবে পরিচিত মাওলানা আবুল কালাম আজাদ সাধারণ্যে প্রতিভাত হন হিন্দুদের রক্ষক, অবুঝ মুসলমান হিসেবে।
মৌল এবং জঙ্গীবাদী এ ধারণা আরও ব্যাপ্ত হয়েছে ভোটের রাজনীতির কারণে। সামরিক শাসক, বিএনপি ও জামায়াতী নেতারা ভোটের কারণে, ধর্মব্যবসায়ী উগ্রপন্থী এই দলগুলোকে উসকেছেন এবং নিয়ত এই প্রক্রিয়া চালু রেখেছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা এর বিপরীতে তোষামোদের পন্থা অবলম্বন করেছেন। তারাও ‘বিসমিল্লাহ’ বলে সব বক্তৃতা শুরু করলেন, মাদ্রাসা ব্যবস্থাকে যতটা পারা যায় সুবিধা দিলেন এবং সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম অক্ষুণ্ণ রাখলেন। অবশ্য তাদের পক্ষের যুক্তি আজকের পরিপ্রেক্ষিতে একেবারে অগ্রাহ্য করা যায় না। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ দিলে আজ এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হতো যে, আওয়ামী লীগকে বিজেপি বলতেও কেউ দ্বিধা করত না। কারণ, নিয়ত ধর্ম ধর্ম করায় গ্রামীণ শিক্ষিত-অশিক্ষিত মহলেও এর প্রভাব পড়েছে। জামায়াত ও বিএনপির এবং মাদ্রাসাসেবীদের একটি অংশের আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্রোধের কারণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বাধীনতা এসেছে বা পাকিস্তান ভেঙ্গেছে। সুতরাং সবমিলিয়ে পরিস্থিতি একেবারে সরল নয়, বরং জটিল।
জামায়াত বা বিএনপির ইসলামপ্রীতি কেন ভ-ামি তার একটি উদাহরণ দিই। ব্ল্যাসফেমি আইন পাস করার জন্য আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই জোর দাবি ওঠে। বা তের দফার মতো দাবিগুলো উত্থাপিত হয়। বিএনপি দু’বার জামায়াত একবার ক্ষমতায় এসেছে কিন্তু ব্ল্যাসফেমি আইনের কথা তোলেনি, ইসলামী দলগুলো তাদের কাছে কোন ‘ইসলামী দাবি’ তোলেনি, বেলেল্লাপনাকেও এক ধরনের জায়েজ বলে ধরে নিয়েছে তখন। আওয়ামী লীগকে সব সময় এদের তোষণ করতে হয়েছে।
সাম্প্রতিককালে হেফাজতে ইসলামের কথা ধরা যাক। এটি এখন প্রমাণিত যে হেফাজতে ইমান বা হেফাজতে বাংলাদেশ না হয়ে হেফাজতে জামায়াতী ইসলামী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর প্রমাণ সাম্প্রতিককালে জামায়াতী ধরনের হিংস্রতা, জামায়াত-বিএনপির পক্ষে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান ও টাকা খাওয়া। সরকার তাদের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের আপোসরফা করতে চেয়েছে হেফাজত মানেনি। মানবেও না। কারণ, সরকারের আলোচনা প্রক্রিয়া ও নমনীয়তাকে তারা দুর্বলতা হিসেবে ভাবছে। ঢাকা অবরোধ কর্মসূচী একটি রাজনৈতিক কর্মসূচী। শেখ হাসিনা কৌশলী বক্তব্য রেখেছেন যে, মদিনা সনদ অনুসারে দেশ চলবে। ধর্মপ্রাণ মুসলমান হলে এ বক্তব্যে সন্তোষ প্রকাশ করত। কিন্তু লক্ষ্য করবেন হেফাজত ঘোষণা করেছে, শেখ হাসিনা তামাশা করছেন। বা অধিকাংশ ধর্ম-দল এতে সন্তোষ প্রকাশ করেনি। কারণ তারা ধর্মপ্রাণ নয়, ফন্দিবাজ মুসলমান।
আওয়ামী লীগের মাথায় একটি ভোটের হিসাব আছে যা দ্বিজাতিতত্ত্বের মতো অপরিবর্তনীয়। এই শব্দটি ব্যবহার করছি এ কারণে যে, স্বাধীন হওয়ার পরও রাজনীতিবিদরা এর চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। সেটি হলো বিএনপি-জামায়াত বিচ্ছিন্ন হলে আওয়ামী লীগের লাভ। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। বিচ্ছিন্ন হলেও জামায়াত কখনও নৌকায় ভোট দেবে না। কারণ সেটি মওদুদীবাদের বিরোধী। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগ পাকিস্তানকে হারিয়ে স্বাধীন হয়েছে, এটি তাদের কাছে এক ধরনের ধর্মদ্রোহিতার মতো। কওমীদের একাংশ ভোট দেবে না। ফন্দিবাজ মুসলমানদের যতই তোষণ করা হোক না কেন তারা ভোট দেবে না। আওয়ামী লীগ জেতে দোদুল্যমান ভোটাররা বিএনপির ওপর নাখোশ হলে। সংখ্যালঘু ভোটেও বিভক্তি এসেছে। গয়েশ্বর রায়রা এর প্রমাণ।
এ পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিকল্প এখন খোলা ছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি নিশ্চিত যে, জামায়াত আর কখনই আওয়ামী লীগে ভোট দেবে না। কারণ ১৯৭৫ সালের পর এই প্রথম শেষ বছর জামায়াতকে সাইজ করছে সরকার। তারা এখন দুর্বল। যুদ্ধাপরাধ বিচারে বিএনপি ছাড়া সবাই পক্ষে। এমনকি হেফাজতীরাও। হেফাজতকে এখন ভাল হওয়ার উপদেশ দেয়া শ্রেয় এবং বলে দেয়া ভাল- না হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কারণ হেফাজতবিরোধী সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রুপ খানকাহ শরীফ, আহলে সুন্নত, তরিকত প্রমুখ তরিকার যারা জামায়াতকে মুসলমান মনে করে না। এমনকি জামায়াতী ইমামের পেছনে নামাজ পড়াটাও নাজায়েজ মনে করে। হেফাজত জামায়াত বিএনপি জাতীয় পার্টি নারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। এতে তরুণরা বিক্ষুব্ধ। এ সমস্ত মিলে ভোটের পাল্লা জামায়াত-হেফাজতীদের বিরুদ্ধে। আশ্চর্য এই যে, আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলো এ সুযোগে এসব গ্রুপকে সংঘবদ্ধ করতে পারত।
এই সুযোগ না নিয়ে আওয়ামী লীগ কেমন যেন স্থাণু হয়ে গেছে। ধর্মীয় ফন্দিবাজদের তোষণের বদলে এদের তোষণ করা ভাল। ফন্দিবাজরা যদি টাকার বদলে কাজ করে, তাহলে এদের বিরুদ্ধ গ্রুপদেরই টাকা দেয়া শ্রেয়। কারণ ফন্দিবাজদের টাকার চাহিদা মেটান যাবে না। এ রকম একটা বিকল্প কেন আওয়ামী নেতৃত্ব নষ্ট করছে, তা একমাত্র সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বই বলতে পারবে।
একটি কারণ হতে পারে তাদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস। সরকারী নেতৃত্ব নির্ভরশীল গোয়েন্দা রিপোর্ট ও নিরাপত্তাকর্মীদের ওপর। গোয়েন্দা রিপোর্টই একমাত্র সঠিক তা নয়। এবং ডিজিএফআই সব সময় নিজের বিকল্প খোলা রাখবে। প্রধানমন্ত্রী ও সরকার এবং দলকে একমাত্র শর্তহীন সমর্থন দেবে সিভিল সমাজের একটি বড় অংশ যারা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে তাকে শুধু সজীব নয় ক্ষমতায় যেতে সহায়তা করে। সিভিল সমাজে কুশীলব থেকে দল ও সরকার মোটামুটি বিচ্ছিন্ন।
আরেকটি ধারণা কাজ করে সরকারে থাকলে যে, তারা যা বলছে বা যা শুনছে তা সঠিক। সঠিক হলে আওয়ামী লীগকে আজ এত বিপাকে পড়তে হতো না। এই ধারণাও কাজ করে যে, সিভিল সমাজের বড় অংশ যেহেতু আদর্শের প্রতি অনুগত সেহেতু তারা জামায়াত-বিএনপিতে ভোট দেবে না। সামনের নির্বাচন হতে পারে সহিংস। আওয়ামী লীগকে বাঁচাতেই হবে- এ দৃঢ়তা নিয়ে কেউ ভোট দিতে যাবে না এটি নিশ্চিত। আর ভোট দিতেই হবে এ গ্যারান্টি কেউ কাউকে দেয়নি।
তরুণরা যুদ্ধাপরাধ প্রশ্নে যেভাবে জেগে উঠেছিল তাও অতিকৌশলের কারণে ম্লান। হেফাজতের দাবি তরুণদের আরও বিক্ষুব্ধ করেছে। এই ভোট সংখ্যা নারী ভোট সংখ্যার সমান। এটি উপেক্ষা করে মৌলবাদীদের সঙ্গে যে কোন ধরনের সমঝোতা আত্মঘাতী।
সরকার ও আওয়ামী লীগ হেফাজতে জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতায় আগ্রহী। কিন্তু সেই সমঝোতা নিজের জমি ছাড়ার সমঝোতা হতে পারে না। সেটি ছাড়লে মৌলবাদকে শুধু প্রশ্রয় নয় আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংকে ধস নামবে। তৃণমূল ও মধ্য পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, তরুণ, নারী কেউ জমি ছাড় দিয়ে সমঝোতা মানবে না। যতই আপ্তবাক্য শোনান দলের অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে। সময় বদলেছে, বদলাচ্ছে- এটি যত দ্রুত নেতৃত্ব বুঝবেন তত ভাল।
অন্তিমে বলব, মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদ সব সময় আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে আজ এক বিধ্বংসী দৈত্যে পরিণত হয়েছে। হেফাজত এর উদাহরণ। আমাদেরও ইসলামের ঢাল ব্যবহার করতে হচ্ছে এবং ইসলামত্ব প্রচার করতে হচ্ছে। এভাবে দেশটি ক্রমেই মৌল-জঙ্গীবাদের দেশে পরিণত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ, ১৪ দল, সরকার সবার এখন বলা উচিত- যথেষ্ট হয়েছে আর নয়। দৈত্যকে বোতলে ঢোকানোর জন্য হেফাজত-জামায়াতবিরোধী মৌলানা, তরুণ ও নারীদের নিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত। যদি সরকার, ১৪ দল এ প্রশ্নে ছাড় দেয় তাতে ঘাবড়াবার কিছু নেই। আমাদেরই যার যার অবস্থান থেকে নামতে হবে। দেশটি শুধু আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলের নয়। এ দেশ মৌলবাদী দেশে পরিণত হলে এ দেশ থাকার কোন যৌক্তিকতা নেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন