বুধবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৩

হেফাজতে ইসলামের লংমার্চে কে লাভবান হবে?

আবুল মোমেন
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ৬ এপ্রিলের ঢাকামুখী লংমার্চের কর্মসূচি নিয়ে দেখা যাচ্ছে, জনমনে আশঙ্কার মেঘ জমেছে। উত্কণ্ঠিত সরকারও। লোকজনের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, অনিশ্চয়তাবোধ থেকে চাপা উত্তেজনায় ভুগছেন সবাই।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ সম্ভবত এই প্রথমবার রাজপথে বড় আকারের প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করতে যাচ্ছে। যে ১৩ দফা দাবি উত্থাপন করে তারা ঢাকামুখী লংমার্চের কর্মসূচি দিয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগ নিয়ে অতীতেও বিভিন্ন ইসলামি দল প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করেছে।

তবে ১৩ দফা দাবি তুলে ধরা হলেও এবার তাদের আন্দোলনে উত্তেজনা ছড়ানোর মূল কারণ—দেশের কোনো কোনো ব্লগে ইসলাম ও মহানবী (সা.) সম্পর্কে কটূক্তির প্রচারণা। এসব অবিমৃষ্যকারিতা যেকোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকেই আহত, বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ করবে, তাতে সন্দেহ নেই। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করাও গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু এবারের কর্মসূচিকে বড় আকারে আয়োজন এবং কিছুটা আক্রমণাত্মক রূপ দেওয়ার পেছনে হেফাজতে ইসলামের দিক থেকে তিনটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, হেফাজতে ইসলামের নেতারা সম্ভবত মনে করছেন, ইসলাম সম্পর্কে অবমাননাকর যেকোনো প্রবণতা বন্ধ করার জন্য অঙ্কুরেই শক্ত অবস্থান নেওয়া দরকার; দ্বিতীয়ত, পুরোনো যেসব দাবি নিয়ে তাঁরা সরকারের কাছে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন, সেগুলোকে নতুনভাবে সামনে এনে সরকারের এই নাজুক অবস্থায় চাপ বাড়িয়ে তা আদায় করেও নিতে চান তাঁরা; তৃতীয় কারণটি হতে পারে, এই সুযোগে ইসলামি আন্দোলনের প্রধান ধারা হিসেবে নিজেদের অবস্থান দাঁড় করানো। এটুকুতে জনমনে আশঙ্কার কারণ ঘটেনি বলেই মনে হয়।

জনগণ শঙ্কিত এ কারণে যে ব্যাপক জমায়েতের আয়োজন করতে যাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম। তাদেরই ভাষায় যা ৫০ লাখ, এর মধ্যে অত্যন্ত সহজেই ইসলামের নামে যারা জঙ্গিবাদী কার্যকলাপ চালিয়ে নতুনভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে, তারা ঢুকে পড়তে পারে। এ রকম ভাবনার আরও কারণ হলো, জামায়াতে ইসলামী ইতিমধ্যেই এ ধরনের নাশকতামূলক কার্যকলাপে লিপ্ত রয়েছে, অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচির প্রতি প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সমর্থন জানিয়েছে, যাদের বর্তমানে একমাত্র কর্মসূচি হচ্ছে, যেকোনোভাবে সরকারের পতন ঘটানো।

আমরা দেখছি, বিএনপি এ কারণে মাঠে প্রায় সর্বাত্মকভাবে পুলিশ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত জামায়াত-শিবিরকে সহযোগিতা দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার যে কাজ তারা করছে, তা-ও বস্তুত জামায়াতকে সহায়তা দেওয়ার কাজই করছে। হেফাজতে ইসলামের নেতারা কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ফলে জনমনে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে, হেফাজতের ঢাকামুখী লংমার্চ যদি সত্যিই বড়সড় আন্দোলনে রূপ নেয়, তাহলে তাদের এতকালের সহনশীল রূপটি থাকবে না। ইতিমধ্যেই এটা পরিষ্কার যে বিএনপি ও জামায়াত তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিকে কাজে লাগাবে।

বড়সড় সমাবেশ থেকে অল্পকিছু সংঘবদ্ধ মানুষের পক্ষে বোমা ফাটানো, ভাঙচুর চালানো বা অন্য যেকোনো হিংসাত্মক নাশকতার কাজের সূত্রপাত করা কঠিন কিছু নয়। একবার শুরু হলে তা থামানো হবে কঠিন। কিছু ঘটার আগে কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা অর্থাত্ শান্তিপূর্ণ সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু রাজপথের আন্দোলনে হিংসাত্মক কিছু ঘটলে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর পক্ষে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে বল প্রয়োগ ছাড়া বিকল্প পথ থাকে না। তাতে হতাহতের ঘটনা ঘটে, যা আবারও প্রতিহিংসা, হানাহানি ও অশান্তির জন্ম দেয়, সরকারকে বিতর্কিত করে ফেলে, বাহিনীর মনোবলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

আমরা ঠিক জানি না, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নেতারা তাঁদের ৬ এপ্রিলের কর্মসূচির সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে, বিশেষত এর ঘোষিত বিশালতার সুযোগ নিয়ে জামায়াত-শিবিরের আক্রমণাত্মক ভূমিকা বা নাশকতার সম্ভাব্যতা নিয়ে তাঁরা কী ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছেন। যেকোনো পরিস্থিতি ও পরিণতির জন্য কেবল সরকারকে দায়ী করে বসে থাকার সুযোগ নেই। বিশেষত সরকারের দিক থেকে বারবার আলোচনা ও সমঝোতার চেষ্টা চালানো হয়েছে, যাতে হেফাজতে ইসলামের নেতারা তাঁদের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু আজকে দায়িত্বশীল এবং দেশপ্রেমিক নাগরিকদের সবাইকেই তো দায়িত্ব নিতে হবে।

বাংলাদেশ বর্তমানে স্মরণকালের সবচেয়ে গভীর সংকটকাল অতিক্রম করছে। চারদিকে সংঘাতের ও বিরোধের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে। এ সময় সচেতন নাগরিকদের অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে।

আমরা যদি বাংলাদেশকে মানি, তবে মুক্তিযুদ্ধকে মানতে হয়, আর তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টিও মানতে হয়। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে বিএনপি এমন সময়ে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে রাজনীতির ওপরই গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু জাতি ফেব্রুয়ারি থেকে শাহবাগের সমাবেশের সূত্রে এই একটি ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠেছিল, বিএনপির অনেক নেতাইও প্রথমে এর বাস্তবতা মেনে নিয়েছিলেন। অথচ খালেদা জিয়া দেশ ও স্বাধীনতার পক্ষের এ জাগরণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দলীয় ও ক্ষমতার রাজনীতিকেই গুরুত্ব দিলেন। জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের সময়কার রাজনৈতিক অবস্থানের ভুল কখনো স্বীকার করেনি। তাদেরই নেতৃত্বাধীন আলবদর-আলশামস-রাজাকার বাহিনী মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় গ্রহণ করেনি। তারা ভুল স্বীকার করেনি বা কৃতকর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেনি, ক্ষমা চায়নি। ফলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের কোনো বিকল্প থাকে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ও রায় প্রদানের এ সময় জামায়াত প্রায় একাত্তরের মতোই রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ইতিমধ্যে কেবল সাঈদীর রায় ঘোষিত হওয়ার পর সহিংসতায় ১৩৭ জন নিহত হয়েছে। তার মধ্যে সাতজন পুলিশ, ৭০ জন নিরীহ সাধারণ মানুষ, ৪৪ জন জামায়াত-শিবিরের কর্মী ও সমর্থক। তিন মাসে হরতালকে কেন্দ্র করে জামায়াত-বিএনপির কর্মীরা কয়েক হাজার গাড়ি পুড়িয়েছেন। রেলসম্পদ বিনষ্ট করেছেন প্রায় ২০ কোটি টাকার। কেবল কানসাটেই ২০০ কোটি টাকা মূল্যের বিদ্যুেকন্দ্র সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে। এটা প্রতিবাদের গণতান্ত্রিক রীতি নয়। আর থেকে থেকে সংখ্যালঘু হিন্দুদের মন্দির ও বসতবাড়িতে যে আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, তাকেও তো প্রতিবাদের ভাষা বলা যাবে না। প্রতিবাদ যখন রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পদহানি, সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের দিকে গড়ায়, তখন পুলিশের পক্ষে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। দেখা যাচ্ছে, জামায়াত চাইছে সরকারকে সরাসরি নিজেদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে ফেলতে। তাই চট্টগ্রাম, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ আরও কোনো কোনো জেলার নির্বাচিত কিছু উপজেলায় দুর্গ গড়ে তুলেছে তারা। এসব এলাকায় অপরাধীদের ধরতে পুলিশ অভিযান চালিয়েও প্রবেশ করতে পারেনি, সশস্ত্র বাধার সম্মুখীন হয়েছে। জামায়াত-শিবির তাদের সশস্ত্রভাবে মোকাবিলা করেছে। এভাবে সরকারকে সংঘাতে জড়িয়ে গ্রামবাসীর সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে তারা। রাষ্ট্র যতই পুলিশি ব্যবস্থা কড়া করবে, ততই সাধারণ মানুষের ভোগান্তিও বাড়বে। আর তাতে সরকারের সমালোচনা বাড়বে, লাভবান হবে জামায়াতই।

জামায়াত কেবল যেসব দলীয় নেতা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত ও বিচারাধীন, তাঁদেরই বাঁচানোর কাজ করছে না, এভাবে টিকে গেলে তারা একাত্তরের অবস্থানকেও সঠিক হিসেবে ধরে রেখেই রাজনীতি চালিয়ে যাবে। বিএনপি অতীতে জামায়াতকে পুনরুজ্জীবনে ও পুনর্বাসনে সহায়তা দিয়েছে। আজ কি সেই ধারাবাহিকতাতেই জামায়াতকে রক্ষার কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে? কিন্তু আজ নতুন পরিস্থিতিতে ইতিহাস আবারও নির্মিত হচ্ছে রাজপথে। ফলে বাংলাদেশের অস্তিত্বে যারা বিশ্বাস করে, তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব এই সংগ্রামে নিজেদের সঠিক ভূমিকাটি গ্রহণ করা।

হেফাজতে ইসলামের নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী, তাঁরা জামায়াতবিরোধী, তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়েও তাঁদের আপত্তি নেই। এই ভাবধারার ইসলামি সংগঠনকে দেশবাসী স্বাগতই জানাবে। আর তাই তাঁদের কাছে দেশের অত্যন্ত কঠিন এই ক্রান্তিকালে মানুষের প্রত্যাশা হবে, তাঁরা নাজুক পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে দেবেন না। এমন কিছু করবেন না যাতে জামায়াত-শিবির ও যুদ্ধাপরাধীরা লাভবান হয়। এমন কিছু করবেন না যাতে সমাজে উত্তেজনা ও অস্থিরতা বেড়ে যায়।

তাঁদের মূল দাবি, ব্লগে ইসলাম ও নবী (সা.)-এর অবমাননাকারীদের শাস্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দেওয়ার পর কার্যত তাঁদের লংমার্চ কর্মসূচির মূল দাবি মেনে নেওয়াই হলো। দাবি পূরণ হওয়ার পরে লংমার্চ কার্যত আর দাবি আদায়ের কর্মসূচি থাকে না। তাহলে দেশের এই নাজুক সময়ে এত ঝুঁকিপূর্ণ এ কর্মসূচি কেন তাঁরা চালিয়ে যেতে চাইছেন?

ধর্মপ্রাণ ধর্মভীরু এ মুসলিমপ্রধান দেশে নাস্তিক দমনের অজুহাত তুলে কেন এবং কার স্বার্থে তাঁরা প্রায় আগুন নিয়ে খেলার মতো এ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন, তা সবার মনে প্রশ্ন তুলে ধরছে।
 আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন