সোমবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৩

নাস্তিক্যবাদ নির্মূলের জেহাদী রাজনীতি

মোঃ মহিউদ্দিন মজুমদার মাসুম
উত্তাল আন্দোলনের এ পর্যায়েও আস্তিক নাস্তিকের স্বরূপ বা সংজ্ঞা খুব বেশী সংখ্যক মানুষ জানেন কিনা সন্দেহ । কারন জানলে আন্দোলনে এতটা সহিংসতা ছড়াত না । বিজ্ঞ আলেম সমাজ ও মহাবিজ্ঞ রাজনীতিবিদরা অন্ততঃপক্ষে বিষয়টি পরিস্কার ভাবে জানেন, রাষ্ট্র পরিচালনা ও ধর্ম চর্চায় নাস্তিকরা কোন প্রতিবন্ধক নয় । পরকালেও যে নাস্তিকদের ফাঁসি বা দেশান্তরী কেন করলেন না এর জন্য জবাব দিহি করতে হবে তেমনটাও না, উপরন্ত অভিযুক্তদের আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে যুদ্ধাংদেহী বক্তব্য ইসলামকে খাটো করার জন্য কৈফিয়ত চাইলে জবাবটা কি হবে জানি না । তবে ইসলামের সাধারন জ্ঞান ও ভদ্রতা জ্ঞানে মনে হয়, আলোচনার প্রস্তাবটি গ্রহন করলে ইসলাম মহিমান্বিত হত এবং আন্দোলনকারীরা যুক্তিশীল উদার ও সহনশীল মানুষিকতার জন্য প্রশংসা পেতেন ।


রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে রাজনীতিবিদদের কাছে জানতে ইচ্ছে করে এক) আস্তিক নাস্তিক নির্ধারণের দায়িত্ব কি রাষ্ট্রের ? দুই) নাস্তিকরা কি রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর ? তিন) নাস্তিক বিতর্কটি শুধু কি ইসলাম ধর্মালম্বীদের জন্য ? চার) অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে নাস্তিক কি থাকতে পারে ? নাস্তিক সব ধর্মের ক্ষেত্রেই নাস্তিক নয় কি ? আমার জিজ্ঞাসার জবাব রাজনীতিবিদরা কিভাবে দিবেন জানি না । আমার বিবেচনায় ধর্ম যেহেতু ব্যাক্তির ব্যাক্তিগত বিশ্বাসের বিষয় । তাই ব্যাক্তিটি আস্তিক কি নাস্তিক তা নির্ধারণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয় এবং বিশ্বের কোন রাষ্ট্র এ ধরনের দায়িত্ব পালন করে না , পার্সপোটেও তা উল্লেখিত হয় না । এটা ব্যাক্তির একান্ত ব্যাক্তিগত বিশ্বাসের বিষয় । ব্যাক্তিগত ধর্ম বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাধ্যমে যেহেতু আস্তিকতা নাস্তিকতা প্রকাশ পায় সেহেতু এটা রাষ্ট্রের জন্য উপকারী বা ক্ষতিকর নয় । তবে আস্তিক নাস্তিক উভয়েই ক্ষতিকর পর্যায়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারে যদি অন্যের ধর্ম বিশ্বাসকে তুচ্ছ্য-তাচ্ছিল্য বা অবমাননা মূলক প্রচার প্রপাগান্ডায় জড়িয়ে পড়ে । আর আস্তিক নাস্তিক সব ধর্মেই থাকতে পারে, তার ব্যাক্তিগত বিশ্বাসের ওপর ভর করে ।

প্রশ্ন ওঠতে পারে -এক) ধর্মের অবমাননা কি শুধু ইসলাম ধর্মের হচ্ছে ? দুই) অন্য ধর্মের অবমাননায় ইসলামের কি কোন ভূমিকা নাই ? তিন) রাষ্ট্র কি ধর্ম নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সমস্যা গুলোর সমাধান করবে ? এই প্রশ্ন গুলোর উত্তরে বিবেকবান মানুষ মাত্রই বলবেন- ধর্মের অবমাননা অবশ্যই হচ্ছে তবে, ইসলাম ধর্মেরটা হচ্ছে কাগজে কলমে আর হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের হচ্ছে কাগজে কলমে ও বাস্তবে তাদের মন্দির মঠ তীর্থ স্থান ও আবাসস্থল ভাংচুর ও পুঁড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে । ইসলামের সুমহান ঐতিহ্য বলে ইসলাম অন্য ধর্মাবলম্বীদের স্বার্থও সংরক্ষন করে কিন্তু বিস্মিত হয়েছি হেফাজতে ইসলামের নীরবতায় । হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবিনামার কোথাও স্থান পায়নি সদ্য নির্যাতন কবলিত হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরা । আর রাষ্ট্র শক্তের ভক্ত নরমের যমের ন্যায় আচরণ করছে । কাগজ কলমে অর্থাৎ ব্লগে ইসলাম ধর্ম অবমাননায় দায়ে চারজন ব্লগারকে এ্যারেষ্ট ও বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে পাঠিয়েছে । এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এরা নাস্তিক এবং এদের ব্লগে ইসলাম ধর্মানুভূতিকে আঘাত দিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেছে অথচ আস্তিক দাবিদার শিবিরের ব্লগ এবং আমার দেশ পত্রিকায় পবিত্র কাবার গিলাফকে প্রতরণামূলক ভাবে সাঈদী মুক্তির আন্দোলনের ক্যাপশনে উপস্থাপন করেছে, যা প্রতারণা ও ধর্মানুভূতিকে আঘাত দেয়ার শামিল । কিন্তু সরকার এক্ষেত্রে নীরবতার মাধ্যমে সম্পূর্ণ একপেশে আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন । বাংলাদেশে হিন্দু বৌদ্ধ সহ অন্য ধর্মালম্বীদের অবমাননা কাগজে কলমেরটা বাদই দিলাম বাস্তবে মন্দির মঠ ও বসত বাড়ি গুড়িয়ে দেয়ার জন্য সরকার কয়জনকে এ্যারেষ্ট ও রিমান্ডে পাঠিয়েছে । এটা স্পষ্ট, অন্ততঃপক্ষে বর্তমান সংকটে রাষ্ট্র তার সাংবিধানিক দায়িত্ব ধর্ম নিরপেক্ষ অবস্থানটা রক্ষা করতে পারেনি ।

স্বভাবতঃই এহেন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল গুলি প্রতিবাদ প্রতিরোধে মুখর হওয়ার কথা ছিল অমুসলিম অর্থাৎ হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মের সুরক্ষায় । কারন রাষ্ট্রে এই মুহূর্তে অবমাননা ও লাঞ্চনার শিকার হচ্ছে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের ধর্ম ও ধর্ম বিশ্বাস । কিন্তু আমরা দেখছি ওল্টো হাতে গোনা কয়েকজন ব্লগারের কাগজে কলমে ইসলাম ধর্মের অবমাননায় রাষ্ট্রে প্রতিবাদের ঝড় ওঠেছে । হেফাজতে ইসলাম নামক একটি সংগঠন রাজধানীতে বিশাল সমাবেশ করেছেন এবং সমাবেশ থেকে ১৩ দফা দাবিনামা উপস্থাপন করেছেন, যেখানে ব্লাসফেমী আইন, নারী নেতৃত্ব ও নারী পুরুষ অবাধ বিচরণ, কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষনা, ভাস্কর্য ধবংস করা, প্রচলিত নারী নীতি ও শিক্ষা নীতি বাদ করা ও রাষ্ট্রকে ইসলামী আইনে পরিচালনার দাবিনামা । অবাক ও বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্রে বর্তমানে সরকার ও বিরোধী দলের প্রধান হচ্ছে নারী অথচ বিরোধী দলের প্রধান নারী নেত্রী হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনে নৈতিক সমর্থণ দিয়ে প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছেন এবং সরকার প্রধান নারী প্রধানমন্ত্রীও দাবি গুলো বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন । তৃতীয় প্রধান দল জাতীয় পার্টিও সমর্থণ জানিয়ে সমাবেশে প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে এবং পার্টির প্রধান এরশাদ রীতিমত জেহাদী বক্তব্য দিয়ে বললেন- ইসলামে হাত দিলে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে । যারা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছে, আমরাও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছি । আরও বললেন-এরা দেশকে দুই ভাগে ভাগ করেছে, একদিকে মুসলমান অন্যদিকে নাস্তিক । আর বিরোধী নেত্রী বললেন- আগামী নির্বাচন হবে নাস্তিকদের পক্ষে বিপক্ষের শক্তির মধ্যে । এ বাংলার মাটিতে নাস্তিকদের ঠাঁই হবে না । আরও বললেন- শাহবাগ সরকার সমর্থিত নষ্ট তরুন ও নাস্তিকদের চত্বর । শাহবাগে তারা নাচ গান ও অপকর্ম করছে ।

হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনে রাজনীতিবিদদের সমর্থণ সূচক বক্তব্য বিবৃতিকে বিশ্বাসে আনলে মনে হবে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদয়িক চেতনা হারিয়েছে, সরকার ও বিরোধী প্রধান নারী নেত্রীরা রাজনীতি থেকে অবসর নিবেন এবং বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক তালেবানী রাষ্ট্রে পরিণত হবে । কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তা মনে করেন না । কারন রাজনৈতিক দল গুলি হেফাজতে ইসলামের ভোটকে নিজেদের পক্ষে নেয়ার জন্য এটি একটি ছল-চাতুরী মাত্র ।

যাহোক, রাজনীতির এই চৈতালী সংঘর্ষ উৎকন্ঠা উদ্বিগ্নতা নিরশনের উপায় নিয়ে সমাজ ও রাজনীতি সচেতন বুদ্ধিজীবিরা কমবেশী সবাই বলছেন, সংকট মোকাবেলার একমাত্র এবং প্রধান উপজীব্য বিষয় পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষতার প্রশ্নে প্রধান দুই দল বা জোটের মধ্যে আলোচনা ও কার্যকরী সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া । এ থেকে সহজেই বুঝা যায় আমাদের রাজনীতিবিদরা নাস্তিক সমস্যাকে প্রধান করে এনেছেন মূলতঃ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কৌশল হিসেবে । ধর্মকে ভালবেসে, ধর্ম সম্পর্কে পান্ডিত্যের অবস্থান থেকে, ধর্ম কেন্দ্রিক রাষ্ট্র নির্মানের অবস্থান থেকে, কোনটাই নয় । তাই দুঃখ ও ঘৃণা থেকে বলছি, এতে ধর্ম ও দেশ কোনটাই উপকৃত হচ্ছে না । প্রকান্তরে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মধ্যকার সম্প্রীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের অর্থনীতি ধবংস হচ্ছে, রাজনীতি হারাচ্ছে নীতি আদর্শের নৈতিকতা ।
সময় এসেছে প্রচলিত ঘুনে ধরা রাজনীতিকে না বলার, সময় এসেছে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের রুখে দাঁড়াবার, রাজনীতি ও ধর্মকে জগাখিচুরী পাকিয়ে ঘোলাটে পরিবেশ তৈরীকারকদের প্রতিবাদ প্রতিরোধে তারুণ্যের গণজাগরণে শরীক হওয়ার ।

মোঃ মহিউদ্দিন মজুমদার মাসুম
প্রবাসী, জাপান

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন