সোমবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৩

কূট রাজনীতিতে উদ্দীপনা হারিয়েছে শাহবাগ

মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
নিউইয়র্ক থেকে: এমন যদি হয়, প্রধানমন্ত্রী তার সমস্ত প্রোটোকল ভেঙে ছুটে গেছেন বিরোধী দলীয় নেত্রীর বাড়িতে অথবা বিরোধী দলীয় নেত্রী ছুটে এসেছেন প্রধানমন্ত্রীর দফতরে, তারা দুজনে বসে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান খুঁজছেন, দেশকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন- এই প্রত্যাশা তরুণ প্রজন্মের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিক, পটুয়াখালী থেকে নির্বাচিত সরকার দলীয় সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনির।


রনি বলেন, বাংলাদেশে আমরা অতীতেও এমনটা দেখেছি। দুই নেত্রী এক হয়ে ক্রান্তি লগ্নে গভীর দুরাবস্থা থেকে দেশকে উদ্ধার করেছেন। গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম হয়েছে তাদেরই হাতে। তাই, এমন প্রত্যাশা অবশ্যই অবাস্তব কিছু নয়। 

বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এ সব কথা বলেন গোলাম মাওলা রনি। সম্প্রতি, নিউইয়র্কে ঘুরে যান সরকার দলীয় এই এমপি। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন।

বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা থেকে উত্তরণের বিষয়ে কথা বলছেন ও জনমত গঠনের চেষ্টা করছেন এই তরুণ প্রজন্মের এই মেধাবী রাজনীতিক।

বাংলানিউজকে রনি বলেন, “বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন একটি ঘূর্ণিঝড় চলছে। এক ঘূর্ণাবর্তে পড়েছে দেশ। কেউ জানে না এর শেষ কোথায়! দৈবাৎ কোনো কিছু ঘটে গেলেই এর থেকে উত্তরণ সম্ভব।”

তিনি বলেন, “আমরা কেউ জানি না এ সঙ্কটের গন্তব্য কোথায়? তবে সমাধান একটি একটি হতেই হবে নিশ্চিত করে জানি। তবে সে সমাধান কোনপথে আমরা তা জানি না।”

রনি বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর কথা কেন বলছি? কারণ, প্রধানমন্ত্রীই এখন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। প্রধানমন্ত্রীর দফতর ক্ষমতার নিউক্লিয়াস হিসেবে কাজ করছে। তিনি চাইলেই যে কোনো কিছু করা সম্ভব।”

তিনটি পথে দেশের সঙ্কট উত্তরণ সম্ভব বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের এই তরুণ সাংসদ। এক- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদিচ্ছা, দুই- প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে যারা আছেন তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতা এবং তিন- জনগণের মধ্যে ভালো ও সঠিক নেতৃত্ব নির্বাচনের আগ্রহ।”

তিনি বলেন, “জনগণকে মন্দকে মন্দ এবং ভালোকে ভালো বলার ক্ষমতা ও যোগ্যতা অর্জন করতে হবে এবং সেটা বলতে হবে।”

তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বের কাছে ভবিষ্যত নেতৃত্ব কতটা নিরাপদ?

এ প্রশ্নের জবাবে অনেকটা হতাশার সঙ্গেই এই নেতা বলেন, “নতুন প্রজন্মের যারা নেতৃত্বে এসেছেন, তারা অনেকটা করুণানির্ভর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগুচ্ছেন। ফলে, তাদের কাছ থেকে জাতি নিকটভবিষ্যতে ভালো কিছু আশা করতে পারছে না। ফলে, আগামী ২০ বছর বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বন্ধ্যা সময় যাবে।”

রনি বলেন, “আমরা তরুণরা যারা রাজনীতিতে আছি, তারা অনেক কিছুই হতে চাই; এমনকি জাতিকে নেতৃত্বও দিতে চাই। কিন্তু, তার জন্য যে ত্যাগ-তিতীক্ষা ও কর্মঠ রাজনীতির চর্চা প্রয়োজন, তার কোনোটাই করতে চাই না।”

তিনি বলেন, “আমরা সবকিছুই রেডিমেড পেতে চাই। আমাদের মধ্যে মন্ত্রী হওয়ার আগ্রহ প্রবল; কিন্তু মন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে ভয় পাই। কেবল ভরসা করে থাকি নেত্রী বা আরও উচ্চ পর্যায়ে যারা আছেন, তার করুণার জন্য!”

“সকল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা কিছুই করতে পারছি না”, এমন মত দিয়ে রনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু যে বয়সে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠেছিলেন, জিয়াউর রহমান যে বয়সে রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন, আমরা যারা তরুণ বলে এখনো পরিচিত, তারা সে বয়স পার করে যাচ্ছি। কিন্তু, আমরা একটি দল গঠন তো দূরের কথা নিজের এলাকার স্বল্পসংখ্যক মানুষকেও নিজের রাজনৈতিক মত ও পথে আনতে পারছি না। জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়া তো দূরের কথা, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত থাকছি।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের রাজনীতির তৃতীয় প্রজন্ম প্রথম প্রজন্মের কোনো একজন নেতারও যোগ্যতা ধারণ করতে পারেনি এবং সেভাবে নিজেদের গড়ে তুলতেও পারেনি। ফলে, রাজনীতিতে একটি বড় ধরনের বন্ধ্যার সময় আসবে সেটাই স্বাভাবিক”, বলেন গোলাম মাওলা রনি।

তিনি বলেন, “এই বন্ধ্যাত্ব একসময় কেটে যাবে। কিন্তু সেজন্য সময় লাগবে। একেবারে নতুন প্রজন্ম থেকে রাজনীতিতে আসলে সে বন্ধ্যাত্ব কেটে যাওয়া সম্ভব।”

নতুন প্রজন্মের প্রসঙ্গে আলোচনায় উঠে আসে শাহবাগ আন্দোলনের কথা। এখানে নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা অংশ নিয়ে রাজকারের ফাঁসির দাবিতে গণজাগরণ সৃষ্টি করেছে।

এই প্রসঙ্গে গোলাম মাওলা বলেন, “শাহবাগের ঘটনাকে আমি গণজাগরণও বলবো না বা কোনো আন্দোলনও বলবো না। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়ার সিকোয়েন্স মাত্র।”

শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে রাজনীতিকরা যা করেছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই মন্তব্যই খাটে বলে উল্লেন করেন রনি।

তিনি আরও বলেন, “যে উদ্দীপনা ও চেতনা নিয়ে শাহবাগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা পুরোপুরিই আজ বিনাশ হয়ে গেছে। আর সেটা হয়েছে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতির কারণে। এর নেতৃত্বে যোগ্যতার ঘাটতির কারণে।”

রনি মত দেন, “আন্দোলনটি দানা বেঁধে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই অতীতে যেসব এ ধরনের বড় বড় আন্দোলন হয়েছিল, সেগুলোর যারা নেতৃত্বে ছিলেন, নতুন আন্দোলনকারীদের উচিত ছিল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে করণীয় নির্ধারণ করা। কিন্তু এই আন্দোলন থেকে এ মূল উদ্যোক্তরা তেমন কোনো উদ্যোগ নেননি।”

শাহবাগে সাধারণ মানুষের একটি বিশাল অংশগ্রহণ ছিল, তাকে স্বতঃস্ফূর্ত বলেই মত দেন গোলাম মাওলা রনি। তবে এই আন্দোলন জনপ্রিয়তা পাওয়ার পেছনে এর অহিংস ও কিছুটা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধরনকেই প্রধান কারণ বলে মনে করেন তিনি।

শাহবাগ থেকে যেসব দাবি তোলা হয়েছে, তার সবগুলোই ভিত্তিহীন বলে মত দিয়েছেন গোলাম মাওলা রনি।

তিনি বলেন, “কাদের মোল্লার ফাঁসি দাবি করলেই তাকে ফাঁসি দেওয়া যায় না। কাদের মোল্লার ফাঁসি না হলে শাহবাগ ছাড়বেন না, আয়োজকদের সেই ঘোষণাই এই আন্দোলনের শক্তিকে স্তিমিত করেছে।

শাহবাগে সাধারণ মানুষের যে উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ তাকে এর আয়োজকরাই খাটো করে দিয়েছেন, যখন তারা দাবি দাওয়ার মধ্যে আরও অনেক রাজনৈতিক বিষয় যোগ করেছেন।”

তিনি বলেন, “মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে যে শক্তি দেখা গিয়েছিল, একজন ব্লগারের হত্যার কারণে আবার রাজপথ দখল করে আন্দোলন করতে গিয়ে তা স্তিমিত করা হয়েছে। আমি মনে করি, শাহবাগের আন্দোলনকারীরাই এই আন্দোলনটিকে নিজ হাতে হত্যা করেছে। আসলে আমরা একটি অস্থির জাতি। তাই, প্রমাণিত হয়েছে শাহবাগ আন্দোলন।”

কেন আন্দোলনটি এমন করুণ পরিণতি পেলো, এমন প্রশ্নে রনি বলেন, “এটি আমাদের কূট রাজনীতির চাল। আমি মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলোই চায়নি আন্দোলনটি টিকে থাকুক। তাই, তাদের কূট কৌশলেই আন্দোলনটি মরে গেছে। আর সাধারণ মানুষ যারা এই আন্দোলনে তাদের চেতনা-বোধ থেকে অংশ নিয়েছিলেন, তারা ওই কূট রাজনীতির শিকার হয়েই উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলেছেন।”

তিনি বলেন, “দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে এখন ভুত-প্রেতের বিশ্বাস ঢুকে পড়েছে। নেতারা কাজ করে জনপ্রিয়তা অর্জনের চেয়ে হাতে আংটি পরে ভাগ্য গড়তে চান। অনেকেই তৃণমূলে যোগাযোগ রাখেন না বরং নেত্রীর আশেপাশে থেকে কৃপা অর্জনের চেষ্টা চালান। আর সে কারণেই রাজনীতির ভবিষ্যত অন্ধকার!”

তিনি বলেন, “নতুন প্রজন্মের যারা রাজনীতিক, তারাও কোনোই সম্ভাবনা তৈরি করতে পারছেন না। দেশবাসীকে দেখাতে পারছেন না কোনো আশার আলো! সবচেয়ে বড় কথা, আমরাও আমাদের ঘিরে একটি দেয়াল তৈরি করে ফেলেছি। ফলে, আমরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। আর সে কারণে, আমরা যে ভুল করছি তা আমাদের বলার কেউ নেই। যাদের ঘিরে আমরা থাকি, তারা আমাদের ভুল কখনোই ধরিয়ে দেবেন না। কারণ, তাদের ভয়, পাছে ভুল শুধরে আমরা বড় হয়ে যাই। আর যে জনগণ আমাদের ভুল ধরিয়ে দিতে পারবেন, তাদের কাছ থেকে আমরা দূরে থাকি।”

এ অবস্থায় করণীয় কি জানতে চাইলে গোলাম মাওলা রনি বলেন, “সংগঠিত পরিবর্তন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক শক্তিগুলোর যে মনোভাব দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে তাদের পরিকল্পনার যতটুকু আমরা জানি, তাতে ইতিবাচক পরিবর্তন এখনই সম্ভব নয়। একটাই পথ, কোনো দৈব দুর্ঘটনা। এমন কোনো ঘটনা ঘটে যাবে, যা দেশের খোলনলচে পাল্টে দেবে।”

তা হলে আপনিও তো সেই দৈব ঘটনায় বিশ্বাস করলেন, এই মন্তব্যে সরকার দলীয় এই জনপ্রিয় এমপি বলেন, “এমন দৈব ঘটনা আমরা অতীতেও দেখেছি। দুই নেত্রী এক হয়ে আন্দোলন করে গণতন্ত্র ফিরিয়েছেন। এখন দুই নেত্রী একমত হয়ে হয় বলবেন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে, নয় তো তারা বলবেন গণতন্ত্র রক্ষায় আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়। আসুন, আমরা জাতি হিসেবে আরও উন্নত হই।

বাংলাদেশের জন্য এইটুকু দৈব ঘটনায় বিশ্বাস করতে আমার ভালোই লাগবে”, বলেন গোলাম মাওলা রনি। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন