সোমবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৩

লন্ডনে ১৮ দলের সংবাদ বর্জন সাংবাদিকদের

সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
মাইক্রো বিজনেস পার্ক কমিউনিটি সেন্টার থেকে: যুক্তরাজ্যে জামায়াত কর্মীদের হাতে সাংবাদিক আহত ও লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে লন্ডনে বাংলা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সর্বস্তরের সাংবাদিকদের এক প্রতিবাদ সভায় ১৮ দলের সংবাদ বর্জনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে আহত ও লাঞ্চিত হন চ্যানেল আই ইউরোপের নারী রিপোর্টার শাহ এমি হোসেন, যার প্রতিবাদে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।


রোববার লন্ডন সময় দুপুরে পূর্ব লন্ডনের মাইক্রো বিজনেস পার্ক কমিউনিটি সেন্টারে চ্যানেল আই ইউরোপ আয়োজিত এক সাংবাদিক সমাবেশে সর্বসম্মতভাবে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। চ্যানেল আই ইউরোপের কর্ণধার রেজা আহমেদ ফয়সল চৌধুরী শুয়েবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ১৮ দলের সংবাদ বর্জনের ঘোষণা দেন এটিএন বাংলা ইউরোপের প্রধান নির্বাহী হাফিজ আলম বকস।

এসময় যুক্তরাজ্যের সবগুলো টিভি চ্যানেলের মালিক, সংবাদকর্মীসহ প্রিন্ট, অনলাইন ও রেডিওতে কর্মরত সর্বস্তরের সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।

সভায় প্রতিটি সংবাদ মাধ্যমের পক্ষ থেকে চ্যানেল আই’র নারী রিপোর্টার শাহ এমি হোসেনের উপর হামলার তীব্র নিন্দা প্রকাশ করে বলা হয়, “সাংবাদিক নির্যাতনের কার্যকর প্রতিবাদ হচ্ছে না বলেই আজ সাংবাদিকদের উপর নির্যাতনের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে সংবাদ কর্মীরা নিরলসভাবে কাজ করলেও নিজ দলের কিছু সন্ত্রাসী কর্মীর হাত থেকে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দিতে সংশ্লিষ্ট দলের নেতারা বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন। এটি রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকে কখনও কাম্য হতে পারে না।”

ফেইসবুকে খণ্ডিত ভিডিও ফুটেজ আপলোড করে একজন নারী সাংবাদিক সম্পর্কে অশ্লীল মন্তব্য প্রচারের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তারা বলেন, “যারা এটি করছে তারা সভ্য সমাজের অংশ হিসেবে নিজেদের দাবি করতে পারে না।”

সভায় বক্তব্য রাখেন চ্যানেল এস এর চেয়ারম্যান আহমেদুস সামাদ চৌধুরী, এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী হাফিজ আলম বকস, এনটিভি ইউরোপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোস্তফা সরোয়ার বাবু, বাংলানিউজের সৈয়দ আনাস পাশা, এনটিভির আব্দুল আউয়াল মামুন, শাহনেওয়াজ রকি, বাংলা টিভির আব্দুল কাইয়ুম, চ্যানেল নাইনের নুরুল ইসলাম শাহীন, সাপ্তাহিক জনমতের ইসহাক কাজল, হামলায় আহত চ্যানেল আই রিপোর্টার শাহ এমি হোসেন প্রমুখ।

সভার সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী হাফিজ আলম বকস ঘোষণা করেন, “শাহ এমি হোসেনের ওপর আক্রমণকারীদের প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা ও আমাদের সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পেলে আমরা ১৮ দলের কোনো কর্মসূচিতে আর রিপোর্টার পাঠাবো না। কারণ প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে আমাদের রিপোর্টারের নিরাপত্তা আমাদেরই দেখতে হবে।”

১৮ দলের ব্যানার ব্যবহার করে জামায়াতের উগ্র কর্মীরা সাংবাদিক নির্যাতনের এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “জামায়াত-বিএনপিসহ ১৮ দলের নেতাদের পক্ষ থেকে আমাদের সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং বৃহস্পতিবারের ঘটনার সঙ্গে জড়িত কর্মীদের প্রকাশ্যে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত আমরা ১৮ দলের আর কোনো খবর প্রচার করবো না।”

এর আগে বক্তব্য রাখতে গিয়ে চ্যানেল এস-এর চেয়ারম্যান আহমেদুস সামাদ চৌধুরী বলেন, “নিরপেক্ষভাবে সব দলের খবর প্রচার করতে গিয়ে কতো যে কষ্ট আমাদের করতে হয়, তা রাজনৈতিক দলের নেতারা জানেন না। তাদের দলের কর্মসূচি জনগণের কাছে পৌঁছাতে গিয়ে আমাদের সংবাদ কর্মীরা হামলার শিকার হন, এটা খুবই দুঃখজনক।” এমি হোসেনের ওপর হামলার সুষ্ঠু বিচার না পেলে ১৮ দলের সংবাদ বয়কটের পক্ষে মত দেন তিনি।

এনটিভির মোস্তফা সরোয়ার বাবু বলেন, “নিজ দলের কর্মসূচি যদি মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছাতে চায় রাজনৈতিক দলগুলো, তাহলে সংবাদ কর্মীদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও তাদের দিতে হবে। নাহলে সংবাদ কর্মীদের দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়।”

বাংলানিউজের লন্ডন প্রতিনিধি সৈয়দ আনাস পাশা বলেন, “রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের আমরা সমাজের সচেতন অংশ বলেই মনে করি। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, কোনো সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দলের কর্মী হতে পারে না। সংবাদ কর্মীদের ওপর যারা হামলা করে, তাদের রাজনৈতিক কর্মী হওয়ার যোগ্যতা নেই। এদের সম্পর্কে দলগুলোর নেতাদের সতর্ক হতে হবে।”

ইউকেবিডি নিউজের সম্পাদক সোয়েব কবীর বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটেনে সাংবাদিকদের উপর হামলার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এর প্রায় সবগুলোই ঘটেছে ১৮ দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা। এ বিষয়ে ১৮ দলের নেতাদের অবশ্যই নজর দেওয়া উচিত।”

জামায়াত কর্মীদের হামলায় আহত চ্যানেল আইয়ের নারী সাংবাদিক শাহ এমি হোসেন বলেন, “আমি বিশ্বাস করতে পারিনি লন্ডনের মত জায়গায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হামলার শিকার হবো। এর আগেও আমার উপর হামলার চেষ্টা হয়েছে বেথনালগ্রিন আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে। একজন নারী সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালনে যেখানে সবার সহযোগিতা পাওয়ার দাবি রাখি আমি, সেখানে একটি রিপোর্ট প্রচার হওয়ার আগেই মিথ্যা অভিযোগ তুলে আমার ওপর আক্রমণ করা হয়। মোবাইলে আমার উপর আক্রমণের খণ্ডিত অংশ রেকর্ড করে ফেইসবুকে প্রচার করা হয়। আমার সম্পর্কে অশ্লীল সব মন্তব্য ছড়ানো হয় সাইবার ওয়ার্ল্ডে। একজন নারী সাংবাদিক সম্পর্কে এ ধরনের অশালীন অপপ্রচার যারা চালায়, তারা সভ্য সমাজের অংশ কিনা আমার সন্দেহ আছে।”

উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে যুক্তরাজ্য ১৮ দলের এক কর্মসূচির সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে জামায়াত কর্মীদের হামলার শিকার হন চ্যানেল আইয়ের রিপোর্টার শাহ এমি হোসেন। কর্মসূচির সংবাদ সংগ্রহ শেষে এমি যখন তার রিপোর্টের জন্যে ‘পিটিসি’ রেকর্ড করার চেষ্টা করছিলেন, তখনই তার পাশে থাকা জামায়াতের কয়েকজন কর্মী ‘সঠিক নিউজ হচ্ছে না’ বলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা এমিকে রেকর্ডকৃত সব ফুটেজ মুছে ফেলতে বলে ও অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকে। এসময় জামায়াত কর্মীরা এমির হাতের ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় ও তাকে আঘাত করে। তারা চ্যানেল আইসহ সব মিডিয়াকে হলুদ মিডিয়া, নাস্তিক মিডিয়া ইত্যাদি বলে গালি দিতে থাকে। তাদের আক্রমণে এমির হাত কেটে রক্তাক্ত হয়ে যায়। ঘটনার এক পর্যায়ে আক্রমণকারীরা এমির হাতের ক্যামেরা ভেঙ্গে ফেলে ও তাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে।

শেষ পর্যন্ত পুলিশ এসে এমিকে আক্রমণকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন