শামশাদ আহ্ম্মেদ
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় আমি জগন্নাথ কলেজ ইউনিটের ভাষা আন্দোলন
কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলাম। সেন্ট্রাল কমিটিতেও কলেজ থেকে
প্রতিনিধিত্ব করি। এ কারণে জগন্নাথ কলেজের ছাত্রদের ওপর বাড়তি দায়িত্ব পড়ত।
তখন ঢাকা কলেজে ছাত্ররাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। তবে এ প্রতিষ্ঠানের
অনেক ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কথা এ প্রসঙ্গে
বলতে পারি। ১৯৬৯-এর গণআন্দোলনে চাকরি করা অবস্থায় নিজেকে জড়িয়ে ছিলাম। এটা
ছিল জীবনের আরেক স্মরণীয় অধ্যায়। ১৯৭১ সাল আমাদের পরাধীন দেশে জীবনযাপনের
স্বপ্ন পূরণের বছর। কিন্তু এ জন্য এমন ভয়ঙ্কর সময় অতিক্রম করতে হবে, ভাবতে
পারিনি। স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকসেনাদের স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় সংঘটিত
হত্যা, গণনির্যাতন ও লোমহর্ষক বর্বরতা দেখেছি।
গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ৪২ বছর পর এখন বিচার শুরু হয়েছে। অপরাধ করেছে অনেকে। বিচার হচ্ছে কেবল কয়েকজনের, যারা নিজেরা শুধু অপরাধ করেনি, এর সংগঠক হিসেবেও কাজ করেছে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা আবদুল কাদের মোল্লার মামলায় একাধিক গুরুতর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণের পরও ফাঁসির দণ্ড না হওয়ায় নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, যার পরিণতিতে শাহবাগ চত্বরে হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর সুশৃঙ্খল প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। এদের কোনো দল সংগঠিত করে এনে সেখানে বসায়নি। আমি ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ ও ১৯৭১ সালের জাগরণের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি_ কেউ চাইলেই এ ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। তরুণ প্রজন্ম ঘোষণা দিয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের প্রত্যাশিত বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা ঘরে ফিরবে না। তাদের এই দৃপ্ত অঙ্গীকার রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। দিনরাত্রির আরাম-আহার ও ঘুমের তোয়াক্কা না করে তারা একনাগাড়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, যা অভূতপূর্ব ও অকল্পনীয়। সেই সঙ্গে তারা সমাজের সর্বস্তরের জনসাধারণের সক্রিয় সমর্থন লাভ করেছেন। ঘরে না ফেরার কথাটা প্রতীকী। তারা নিজেদের ঘরে যাচ্ছে। আরও অনেকের ঘরে যাচ্ছে। এভাবে বাড়িয়ে চলেছে নিজেদের শক্তি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিএনপি শাহবাগ আন্দোলনের শুরুতে একেবারে নিশ্চুপ ছিল। পরে ১৮ দলীয় জোটে জামায়াতিদের অন্তর্ভুক্ত রেখেও দোলায়মান চিত্তে একদিকে সমর্থন জানায়, অন্যদিকে বিবৃতি দিচ্ছে শাহবাগ আন্দোলন সম্পর্কে বিষোদ্গার করে। সবশেষে খালেদা জিয়া বিবৃতি দিয়ে সরাসরি জামায়াতের পক্ষ নিয়েছেন। তরুণ প্রজন্মকে ঢালাওভাবে নাস্তিক বলছেন। এটা একেবারেই দুর্ভাগ্যজনক।
কথায় বলে, 'আপন দোষের অন্ত নাই পরের দোষ কত দিব ভাই'। দলীয়করণের অভিযোগ তোলা হচ্ছে। এটা ঠিক যে, এ আন্দোলনে যে কোনো দল-মতের লোক অংশ নিতে বাধা নেই। কিন্তু যেদিন এ আন্দোলন দলীয়করণ করা সম্ভব হবে, সেদিন অবশ্যই দুর্বল হয়ে পড়বে এবং নিস্তেজ হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে যা দেখছি, শাহবাগ আন্দোলনকে দলীয়করণের প্রশ্নই ওঠে না। বরং আন্দোলন এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও আনাচে-কানাচে। জাতীয় ঐক্যের মোহনা আজ শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর। সেখানে জমায়েত কখনও বেশি, কখনও কম। কিন্তু তার কণ্ঠ সর্বত্র ব্যাপ্ত। কে তাদের থামাবে?
বিএনপি নেত্রীর প্রতি বিনম্র পরামর্শ, মানবতাবিরোধীদের তালাক দিয়ে প্রজন্ম চত্বরের জনসমুদ্রের কাছে আসুন ও বিচারকার্যে সমর্থন জানিয়ে সক্রিয় অংশ নিন। বিচারে ভুল-ত্রুটি নজরে এলে সেটা বলুন এবং তা দূর করার পরামর্শ দিন। বিচার কেন ভণ্ডুল করতে চাইছেন? এখন যে পথে চলছেন, সে ধারায় চলতে থাকলে জনগণ শুধু আপনাদের ঘৃণা করে ক্ষান্ত থাকবে না, ১৮ দলীয় জোট নিয়ে জনরোষে আপনারা নিঃশেষ হয়ে যাবেন।
ইদানীং আবার দেখা গেছে, নির্বাচিত সরকার পতনের আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিরোধী নেতা বিদেশিদের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করছেন। সম্প্রতি ঘুরে এলেন সিঙ্গাপুর। এসেই শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের জোরালো নিন্দা!
আপনাদের কুকীর্তি সর্বসাধারণের কাছে ধরা পড়ে গেছে। এখনও সময় আছে জামায়াতপ্রীতি ত্যাগ করে খোলামনে প্রজন্ম চত্বরে লাখো আবালবৃদ্ধবনিতার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা দিন। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানো কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশের নীতি নয়। আপনারা এতে সাড়া পাবেন না। যত শিগগির আপনাদের সুমতি হয় ততই মঙ্গল।
শামশাদ আহ্ম্মেদ :ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক
সমকাল | মঙ্গলবার |
১৯ মার্চ ২০১৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন