মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০১৩

প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইতে বিজয়ী হওয়া ভিন্ন বিকল্প নেই

শেখর দত্ত
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে দেশের অভ্যন্তরে অভাবিত সব ঘটনা ঘটে চলেছে। এসব ঘটনার মধ্যে যেমন জাতির প্রত্যাশাকে বিপুলভাবে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম সৃষ্টিশীল-উদ্দীপনাময়-ঐতিহ্যবহনকারী-সম্ভাবনাময়-অগ্রযাত্রার সঞ্চালক ঘটনাবলী রয়েছে; তেমনি এর বিপরীতে ধ্বংসকারী-হতাশাজনক-প্রতিক্রিয়াশীল-ঐতিহ্য বিনাশকারী-সম্ভাবনা বিনষ্টকারী-প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী ঘটনাবলীও রয়েছে। এটা কারোরই অজানা নেই যে, জাতীয় জীবনে এমনটা সবসময়েই অন্তঃসলিলা ফল্গুনদীর মতো বয়ে চলে। তবে গণজাগরণ যখন জাতীয় জীবনে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে, ক্রমে বেগবান হতে থাকে এবং রূপ পাল্টায়, তখন তা সুস্পষ্টরূপে প্রত্যক্ষ করা যায়। প্রসঙ্গত, তরঙ্গমালা যেমন একবার স্ফীত হয়ে আছড়ে পড়ে আবার উল্টো টানে পেছনে চলে যায়, ঠিক তেমনি আচরণ করে গণজাগরণের ঢেউও। এখানে দুই ঢেউয়ের পার্থক্য হচ্ছে, সমুদ্রের জোয়ারের ঢেউ আগু-পিছু টান হয় ক্ষণস্থায়ী, তাই অগ্রসর হওয়াটাই জোয়ারের বৈশিষ্ট্যরূপে অনুভূত হয় না। কিন্তু গণজোয়ারের আগু-পিছু টান কখনো হয় তাৎক্ষণিক আবার কখনো বা সময় নিয়ে সংঘটিত হয়।
বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে ঘটনাবলী প্রত্যাশাকে বিপুলভাবে যেমন জাগিয়ে তুলছে, তেমনি এর বিপরীতমুখী টানও লক্ষণীয় হয়ে উঠছে। রাজনীতির স্বতঃসিদ্ধ একটি কথা হচ্ছে, প্রগতির পেছনে পেছনে আসে প্রতিক্রিয়া, জাগরণের আলোর পেছনে ধেয়ে আসে অন্ধকার। বলার অপেক্ষা রাখে না সাম্প্রতিক দিনগুলোতে এমন ধরনের বিপরীতমুখী ঘটনাই আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে ঘটে চলেছে। উল্লিখিত বিষয়াবলী নিয়ে আলোচনা খুবই জরুরি ও প্রাসঙ্গিক। কারণ তরঙ্গমালা যখন বিপরীতমুখী টান দেয়, তখন সব কিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে বা যাবে বলে যাতে মনে না করা হয়।

বিদ্যমান বাস্তবতায় উপরোল্লিখিত বিষয়ে যে বিষয়টা প্রথমেই বিবেচ্য তা হলো গণজাগরণের তরঙ্গমালার সমুখ পানে ধেয়ে চলা ঢেউয়ের বৈশিষ্ট্য যেখানে সংঘবদ্ধ-অহিংস রূপ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, সেখানে পেছনের টান জনবিচ্ছিন্ন-চোরাগোপ্তা হামলা-সহিংস-তা-ব রূপ নিয়ে আবির্ভূত হচ্ছে। একটু লক্ষ করলে আরো অনুধাবন করা যাবে যে, সামনের ঢেউ সুস্পষ্ট দাবি ও লক্ষ্য সামনে রাখছে কিন্তু পেছনের টান সবই অস্পষ্ট ও কুয়াশাচ্ছন্ন রাখছে। চোরাগোপ্তা-গণবিচ্ছিন্ন সহিংসতা ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে গেলেও প্রতিক্রিয়ার শক্তি এখন এক কথা বলছে তো পরক্ষণে আরেক কথা বলছে। এখন এক ধরনের কাজ করছে তো পরক্ষণে অন্য ধরনের কাজ করছে। এজন্যই বলা হচ্ছে যে, গণজাগরণের বিপক্ষ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সাপ হয়ে দংশন করছে আবার ওঝা হয়ে ঝাড়ফুঁক দিচ্ছে। নিতান্ত অন্ধ ও অন্ধকারের ব্যক্তি-গোষ্ঠী-দল ব্যতীত সংবাদ পাঠক কার না জানা যে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিরীহ সংখ্যালঘু পরিবারগুলো, যারা এখনো গণজাগরণের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত হয়নি, তাদের বাড়িঘরে এবং পবিত্র ধর্মস্থান মন্দিরগুলোতে অতর্কিতে এসে আগুন দিয়ে চলেছে প্রতিক্রিয়ার শক্তি। এর মধ্যে কোথাও বিএনপির ক্যাডার-সন্ত্রাসীরা ছিল জামাতের সঙ্গে আর কোথাও বিএনপির পরোক্ষ সহযোগিতা ও উসকানি দিয়ে তা সংঘটিত করেছে। এমনটা ঘটলেও জামাত ও বিএনপি একই সুরে বলছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এসব নাকি করা হচ্ছে। আরো বিস্ময়কর বিষয় হলো যে, বিএনপি দলটির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা ও সহযোগিতায় ওই সব অনভিপ্রেত-জঘন্য-হৃদয়বিদারক ঘটনা সংঘটিত হলেও সেই দলের নেত্রী খালেদা জিয়াই লাজলজ্জার মাথা খেয়ে চলে যাচ্ছেন অগ্নিদগ্ধ মন্দির পরিদর্শনে। পত্রিকা পাঠে জানা যায়, নোয়াখালীর সন্ত্রাস কবলিত সংখ্যালঘু গ্রামে তা-ব চালানো হলো এমপি বরকতউল্লাহ বুলুর প্রত্যক্ষ মদদে। কিন্তু পরের দিনই সাধু সেজে পরিবার প্রতি ৫০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হলো সেই এমপিরই উদ্যোগে। বলাই বাহুল্য এক্ষেত্রে দুমুখো সাপের ভূমিকা নিচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল গণজাগরণ বিরোধী শক্তি।

কেবল উল্লিখিত ক্ষেত্রেই নয়, একটু খেয়াল করলেই এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, যখন তখন মুখোশ পরিবর্তন করে বহুরূপী বর্ণচোরা রূপ নিচ্ছে পেছনে টেনে ধরা ওই অপশক্তি। যেমন চোরাগোপ্তাভাবে হামলা হচ্ছে পুলিশের ওপর; পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে, পুলিশের সামনে পটকা ফুটানো হচ্ছে; যানবাহনে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জনবসতিতে আগুন দেয়া হচ্ছে। এসব যখন অন্ধকারের অশুভ শক্তি করতে উদ্যত হয়, তখন কী করবে পুলিশ? নিশ্চুপ বসে থাকবে? আঙুল চুষবে? তা-ব চালাতে দেবে? শান্তির বাণী বর্ষণ করবে? পুলিশের হাতে আইন রক্ষার জন্য অস্ত্র দেয়া হয়েছে কেন? তা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য? অপকর্ম-দুষ্কর্মের প্রতিক্রিয়ায় পুলিশ যদি কিছু করে তবে বলা হতে থাকে বাড়াবাড়ি। এমন কথাও তোলা হয় আমাদের রাষ্ট্রটি নাকি পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে গেছে। এটা ঠিক অপকর্ম-দুষ্কর্ম ঠেকাতে গেলে পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে বাড়াবাড়ি কিছু করতেই পারে। সে জন্য তা পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে গেছে বলে জিগির তোলা হচ্ছে কোন উদ্দেশ্যে? দেশ তো বিএনপি-জামাত জোট শাসনামলে হয়েছিল সন্ত্রাসী রাষ্ট্র আর এখনো চোরাগোপ্তা হামলা-অগ্নিসংযোগ করে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বানানোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দেশকে যেভাবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা করা হয়েছিল এখনো তেমনটাই করার চেষ্টা করা হচ্ছে। লক্ষ্য হলো ৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়া। দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত করা। এই অবস্থায় পুলিশের আইনানুযায়ী যথাবিহিত কাজ করা যথার্থ এবং তা দেশপ্রেমিক-গণতান্ত্রিক কর্তব্য। এটা ঠিক বাড়াবাড়ি সমর্থনযোগ্য নয়, তবে অন্য দেশে ৮ জন পুলিশকে হত্যা করা হলে, পুলিশের অস্ত্র লুট করা হলে পুলিশ কী করতো? ধারণা করি আরো বেশি অ্যাকশনে যেতো।

এক্ষেত্রে বলতেই হয় যে, দেশের ভেতরে যখন তা-ব চালানো হচ্ছে, তখন অদ্ভুত ধরনের একটা নিরপেক্ষ রাজনৈতিক অবস্থান ও নিরপেক্ষবাদী প্রচার চালানোর প্রচেষ্টা নেয়া হচ্ছে। তা-বের ঘটনা ঘটলে যদি পুলিশ অ্যাকশনে না যায়, তবে বলা হচ্ছে পুলিশ নিষ্ক্রিয়-অকার্যকর ছিল। এমনকি বলা হচ্ছে সরকার নেই বলে মনে হয় আর উল্টো যদি অ্যাকশনে যায় (বাড়তি থাকবেই) তবে বলা হচ্ছে দেশটা পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে গেছে। একইভাবে আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি যদি ওই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরোধিতায় প্রত্যক্ষভাবে রাস্তায়-মাঠে নামে, তখন বলা হয় ছবি ছাপানো হয় সরকারি দলের ‘ক্যাডার-সন্ত্রাসীরা’ নেমেছে আর যদি না নামে তবে বলা হয় জনতার পাশে ক্ষমতাসীনরা নেই। বাস্তবে নিরপেক্ষতা যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির জন্য শাঁখের করাতরূপে আবির্ভূত হয়েছে।

একইভাবে উল্লেখ করা চলে ‘নাস্তিক’, ‘মুরতাদ’ প্রভৃতি অভিধায় আখ্যায়িত করার প্রসঙ্গ নিয়ে। একটু খেয়াল করলেই এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে; ইতোপূর্বে স্বাধীন বাংলাদেশে এসব অবিধায় আখ্যায়িত করা হতো ব্যক্তি বা বিশেষ কোনো দলকে। প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী থেকে কবি শামসুর রাহমানÑ কে না ছিলেন এই সব অপশক্তির ভাষায় মুরতাদ! এখন ঠিক পাকিস্তানি আমলের মতো বিশাল গণজাগরণকেও বলা হচ্ছে নাস্তিক। ঊনসত্তরের নিরস্ত্র কিংবা একাত্তরের সশস্ত্র গণজাগরণকে পাকিস্তানি হানাদাররা যেভাবে যে ভাষায় চিত্রিত করতো ঠিক সেভাবে এখন করা হচ্ছে দেশের আনাচে-কানাচে প্রতিষ্ঠিত গণজাগরণ মঞ্চকে। গণজাগরণ মঞ্চ পবিত্র ধর্মের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনো কথা বলেনি বরং প্রথানুযায়ী সভার শুরুতে, জানা যায় ধর্মকে সুরক্ষা করেছে, আলেম-ওলামারা মঞ্চে এসে বক্তব্য দিচ্ছেন, তবুও এই মঞ্চকে বলা হচ্ছে নাস্তিকতাবাদী মঞ্চ। এতো মানুষ, এতো তরুণ তরুণী যদি নাস্তিক হয় তবে দেশে আস্তিক থাকে কতো জন? জনগণকে এভাবে নাস্তিক ও মুরতাদ বলে আখ্যায়িত করার দায়িত্ব তাদের কে দিয়েছে?

জামাতের নেতাদের দিয়ে অর্থ আনুকূল্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ইসলাম হেফাজতকারী প্রতিষ্ঠানকে সামনে আনা হচ্ছে, যেন জামাত ও বিএনপি ছাড়া আর অন্য কোনো ইসলাম হেফাজকারী দেশে নেই। প্রশ্ন হলো চোরাগোপ্তা হামলা নিরীহ জনগণের বাড়িঘরে-মন্দিরে অগ্নিসংযোগ কি ইসলাম হেফাজতের মধ্যে পড়ে? বিএনপি-জামাত শাসনামলে যখন ‘বাংলাভাইদের’ জঙ্গি কাজ-কারবার চলছিল তখন কোথায় ছিলেন এই হেফাজতকারীরা? যখন ১০ ট্রাক অস্ত্র চালান ধরা পড়ে, জনসভায় গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন প্রাণ হারায়, কিবরিয়া আহসানউল্লাহ মাস্টার প্রমুখদের হত্যা করা হয়, তখন কোথায় ছিলেন এসব হেফাজতকারীরা? ওই সময়ে হাওয়া ভবন পরিচালিত হত্যাকা- কি গণহত্যা নয়! তখন কোথায় ছিল এই অন্ধকারের শক্তি? বিস্ময়ের বিষয় হলো নারী নেতৃত্ব কিংবা বিরোধীদলীয় নেত্রীর বেশভূষাকে দেশের জনগণ কখনো অনৈসলামিক ও মুরতাদি কাজ বলেনি। কিন্তু ইসলাম হেফাজতকারীরা আগে কী বলতেন আর এখন কী বলেন তা দেশবাসী জানতে চায়। মওদুদের বাড়িতে মদ পাওয়া গেলেও তাকে নেতা মানতে হেফাজতকারীদের আপত্তি নেই। উল্টোদিকে ভাষা আন্দোলনের চেতনা যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হিসেবে দেশকে লক্ষ্যাভিমুখে অগ্রসর করে নিতে সচেষ্ট, সেই চেতনায় সমৃদ্ধি গণশক্তিকেই বলা হচ্ছে নাস্তিক, মুরতাদ। পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা ৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর রাজনৈতিক-সামাজিকভাবে কতোটা শেকড় গেড়ে প্রসারিত হয়েছে, তা এ থেকে কল্পনা করা চলে।

উল্লিখিতভাবে প্রগতির পেছন পেছন যখন প্রতিক্রিয়া অগ্রসর হচ্ছে তখন এটা কিন্তু স্মরণে রাখতেই হবে যে, নির্বাচন দ্রুতগতিতে সামনে চলে আসছে। দেশবাসী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেমন চায়, ঠিক তেমনি চায় সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। একটাকে অপরটার প্রতিপক্ষ করতে চায় না। কিন্তু এ দুই ইস্যুতেও চলছে উল্লিখিত ধরনের এদিক ওদিক ঠিক পেন্ডুলামের মতো অবস্থান গ্রহণ এবং প্রচার। বিএনপি বলছে, প্রথমত তারাও সকল দলের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের বিচার চায়। দ্বিতীয়ত, দল ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে। প্রশ্ন হলো ১৮ দলে যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ থেকে এ ধরনের অবস্থান গ্রহণ ও প্রচার করা কি অনৈতিক নয়? সকল দলের যুদ্ধাপরাধীদের নাম বিএনপি তো এখনই ঘোষণা করতে পারে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে পরিচালিত গণআদালত তো ক্ষমতায় না থাকা অবস্থায়ই নাম প্রকাশ করে বিচার শুরু করেছিল। বিএনপি-জামাতের ১৮ দলীয় জোটের তা করতে অসুবিধাটা কোথায়? আর কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে বিচার স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে এই জোট বলে না কেন? বিচার যখন চলছে, শাস্তি প্রদানের রায় যখন হচ্ছে তখনই তো তা বলার প্রকৃষ্ট সময়। চোর পালালে বুদ্ধি দিয়ে লাভ কি? সর্বোপরি জামাতকে সঙ্গে রেখে বিএনপি যদি ক্ষমতাসীন হয়, তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে নাকি তাদের গাড়িতে-বাড়িতে পতাকা উঠবে? জনগণকে ধোঁকা দেয়ার বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী ভূমিকা নিতে বিএনপি আসলেই ওস্তাদ!

[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: থএড়ইধপশ][জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: থএড়ইধপশ]একইভাবে সংলাপ ও সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ-অবাধ-গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়েও বিএনপি শুরু করেছে পেন্ডুলামের মতো অবস্থান পরিবর্তনকারী কৌশল। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া যখন বলেন, সংলাপ চাই না। খুনি সরকারের সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ নেই। তখন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আলোচনার প্রস্তাব সরকারকেই দিতে হবে। আসলে কোনটা চায় বিএনপি। সংলাপ নাকি একদফা? এক দফা হলে জনগণের নিরঙ্কুশ রায়ে নির্বাচিত সাংবিধানিক সরকার তো গরম লাইনে যাবেই। সর্বোপরি বিএনপি নির্বাচনের সময় নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলে ঠিকই, কিন্তু কোনো রূপরেখা তুলে ধরে না। কখনো বলে সরকারকেই এই রূপরেখা তুলে ধরে সংসদে বিল আনতে হবে। আবার কখনো বলে সংবিধানে পূর্বে যা ছিল তা-ই চায় বিএনপি। এই ধরনের দ্বিমুখী ধোঁকা দেয়ার সময় বিএনপি মনে রাখে না দেশের সর্বোচ্চ আদালত অনির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে কী রায় দিয়েছে। বিএনপি মনে করে দেশবাসী সব বোকা কিংবা চোখে-কানে ঠুলি পড়েছে। বস্তুতপক্ষে ক্ষণে ক্ষণে মুখোশ পরিবর্তন করে বহুরূপী-বর্ণচোরা হয়ে রাজনৈতিকভাবে অবস্থান পরিবর্তন করতে পারাটা বিএনপির নীতি-কৌশলের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠছে। গণজাগরণের মধ্যেও বিএনপি সুকৌশলে তা ব্যবহার করতে সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, গণজাগরণের তরঙ্গ যতো সমুখপানে ধেয়ে আসতে থাকবে, ততোই বিএনপির এতো চাতুর্যপূর্ণ কৌশল ব্যবহারের অনুপযোগী-অকার্যকর হয়ে উঠবে এবং এক সময় তা বুমেরাংরূপে আবির্ভূত হবে। নিজের সৃষ্টি করা অক্টোপাসে নিজেই জড়িয়ে পড়বে। যতোক্ষণ পর্যন্ত তা না হয় ততোক্ষণ পর্যন্ত এটা স্মরণে রাখতে হবে যে, গণজাগরণের তরঙ্গ সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেনি।

এ জন্যই গণজাগরণের শক্তিকে ক্রমে প্রসারিত ও সংহত করে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ভিন্ন বিকল্প নেই। এটা গণজাগরণের পক্ষের সকল দল সংগঠন শক্তি ব্যক্তিকে স্মরণে রাখতে হবে যে, সাগরের ঢেউকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যায় প্রকৃতি আর গণজাগরণকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিতে হলে চাই রাজনৈতিক-সাংগঠনিক নেতৃত্ব। প্রচার জোরদার করে প্রতিক্রিয়ার শক্তির মুখোশ উন্মোচন করা, লক্ষ্য সুস্পষ্ট করা এবং প্রত্যক্ষ গণবিরোধী কাজকে প্রতিহত করা ছাড়া কোনো গণজাগরণই সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারে না। তাই প্রয়োজন পড়ে সংগঠিত শক্তির। গণজাগরণ মঞ্চকে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। সরকার বলছে প্রতিরোধ কমিটি গঠন করার কথা। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে যেমন বিএনপি-জামাতের ১৮দলীয় জোট তেমনি হেফাজতে ইসলাম। ‘মঞ্চ ফঞ্চ’ বন্ধ করার যুদ্ধসম আহ্বানের বিপরীতে কিংবা হেফাজতবাদীদের ঘোষিত জেহাদের বিরুদ্ধে কিভাবে মঞ্চকে দেশব্যাপী ছাড়িয়ে দেয়া যায় তা এখন ভাবতেই হবে; নিতে হবে যথাযথ পদক্ষেপ। আর সরকারের উদ্যোগে প্রতিরোধ কমিটি ঘোষণা দিলেই গঠিত হবে কিংবা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে এমনটা ভাবারও অবকাশ নেই। পত্রিকা পাঠে জানা যায়, বগুড়াসহ কতক স্থানে কমিটি গঠিত হলেও তা সরকারি দলের দ্বন্দ্ব-বিভেদের কারণে কার্যকর হতে পারছে না। আর মেধাবী ছাত্র ত্বকী হত্যাকা-ের পর যা অবস্থা তাতে নারায়ণগঞ্জে তো কমিটি গঠনেই সমস্যা। সরকারি দলের দ্বন্দ্বের পরিণতিতে কিভাবে কতোটা শক্তি নিয়ে দাঁড়াবে ঘোষিত কমিটি তাও অনুমান করা যাচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তি যদি ক্ষমতায় থেকেও এসব সমস্যার সমাধান করে গজাগরণের বাধাগুলোকে অপসারণ করতে না পারে, তবে প্রতিক্রিয়ার শক্তি সুবিধা যে পেতেই থাকবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাধীনতা দিবস যখন সামনে তখন সংশ্লিষ্ট সকলকেই দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞতাপ্রসূত এ কথা স্মরণে রাখতে হবে যে, গণজাগরণ বিরোধী প্রতিক্রিয়ার শক্তি পেছন পেছন এসে প্রগতিমুখী গণজাগরণের শক্তিকে ছুরিকাঘাত করতে পারে। তাই শুরু যখন হয়েছে তখন প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিজয়ী হওয়া ভিন্ন বিকল্প নেই।

শেখর দত্ত : রাজনীতিক, কলাম লেখক।
ভোরের কাগজ : মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন