শুক্রবার, ২২ মার্চ, ২০১৩

জয় হবে জনতার

রাশেদ হাসান
ন্যায়সঙ্গত দাবিতে তরুণরা যতবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, বাঙালি ততবারই তাদের বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তর ও নব্বই সেই ইতিহাসেরই সাক্ষী। এবারও এই তরুণদের ডাকে বাঙালি আবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। ইতিহাস যদি সত্য হয়, এই ধর্মান্ধ পরাজিত শক্তিকে আবারও পরাজিত করে বাঙালি তার বিজয় ছিনিয়ে আনবেই। শাহবাগ আজ একটি চেতনার নাম। যে তরুণ প্রজন্ম একাত্তর দেখেনি, এমনকি নব্বইয়ের আন্দোলন যাদের অনেকের চোখের সামনে নেই, তারাই এমন এক তুলকালাম কাজ করে ফেলবে, কবে কে ভাবতে পেরেছিল?

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে প্রথম আন্দোলন শুরু করেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। মৃত্যুর আগে তার শেষ লেখায় নতুন প্রজন্মের তরুণদের এ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি। শহীদ জননীর মৃত্যুর পরও এ আন্দোলন চলতে থাকে দেশব্যাপী। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন রাজাকার, আলবদর ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজটি করে এসেছে দীর্ঘদিন ধরে।

তবুও আমাদের কাটাতে হয়েছে হতাশার দীর্ঘকাল। স্বাধীন বাংলার মাটিতে আমাদের দেখতে হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের সীমাহীন আস্ফালন। এ দেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছে রাজাকাররা। নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে ঘাতক গোলাম আযমকে। বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচিত হয়ে রাজাকারদের গাড়িতে আমরা উড়তে দেখেছি আমাদের প্রাণপ্রিয় লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা। ক্ষোভ, দুঃখ আর লজ্জায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে দেশপ্রেমিক প্রত্যেক মানুষের হৃদয়।

সম্প্রতি কাদের মোল্লার যাবজ্জীবনের রায় ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘদিনের চাপা ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে দেশপ্রেমিক মানুষের মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের বাংলার প্রত্যেক মানুষ এ রায় প্রত্যাখ্যান করেছে। ঢাকায় অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরামের তরুণরা শাহবাগে সংগঠিত করেছে বিক্ষুব্ধ জনতাকে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠন ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা যৌথভাবে গড়ে তুলেছে আন্দোলন। শাহবাগের উত্তাল জনস্রোত সারাদেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে। ছড়িয়ে পড়েছে আন্দোলন দেশের প্রতিটি রাজপথে। শুরু হয়েছে যেন আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ। সব শ্রেণী-পেশার মানুষ ছুটে এসেছে শাহবাগ, প্রেস ক্লাবসহ দেশের প্রতিটি অঞ্চলের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে শামিল হওয়ার জন্য, নিজেকে নতুন মুক্তিযুদ্ধে শামিল করার জন্য, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি ও জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানানোর জন্য।

কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতার আহ্বানে নয়, বরং দেশপ্রেমের মূল্যবোধে ডুবে গিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা বুকে নিয়ে নতুন প্রজন্মের ডাকে লাখ লাখ মানুষ ছুটে এসেছে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে। নতুন নতুন স্লোগান, গান রচিত হয়েছে। 'জয় বাংলা' স্লোগান আর কোনো দলের স্লোগান হয়ে থাকেনি। মুক্তিযুদ্ধের মতো আবারও সবার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে জয় বাংলা স্লোগান। শাহবাগের সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব চত্বর এবং পুরো দেশ যেন ফুঁসে উঠেছে ক্ষোভে-বিক্ষোভে। সবাই স্লোগান ধরেছে_ তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি। আরও উচ্চারিত হয়েছে_ ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার; ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, রাজাকারের ফাঁসি চাই।

গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে জনস্রোত দেখে ভীত হয়ে জামায়াত-শিবির ও বিএনপি অবশেষে এ আন্দোলনকে ইসলামের বিরুদ্ধে আন্দোলন হিসেবে অপপ্রচার করা শুরু করেছে। কিন্তু শাহবাগ, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবসহ দেশের কোনো গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে একটি শব্দও কখনও উচ্চারণ করা হয়নি। তাহলে লাখো-কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান, যারা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে অংশ নিয়েছে এবং সমর্থন জানিয়েছে, তারা কি সবাই নাস্তিক? প্রশ্ন জাগে মনে, যারা বায়তুল মোকাররম মসজিদের জায়নামাজে আগুন দেয়, যারা শহীদ মিনার ভাঙে, যারা আমাদের প্রাণপ্রিয় জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে দেয়, যারা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িতে আগুন দেয়, মন্দির ভাঙে, মানুষ হত্যা করে, পুলিশকে গুলি করে, ১০ জন আলেমকে হত্যার পরিকল্পনা করে তারা কি ইসলামের পক্ষে? তারা কি মুসলমান? তারা কি মানুষ? তারা যখন এ রকম ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, তখন ইসলাম ধ্বংস হয় না? একাত্তরের মতো আবার বাংলার মানুষ দেখেছে, শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে একটি ধর্মান্ধ গোষ্ঠী কতটা হিংস্র, কতটা বর্বর হয়ে উঠতে পারে। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য জামায়াত-শিবির চক্র স্থপতি রাজীব হায়দারকে নৃশংসভাবে খুন করেছে। এরপর তারা খুন করেছে আরও বেশ কয়েকজনকে। কিন্তু গণজাগরণের আন্দোলনকে তারা বন্ধ করতে পারেনি। কারণ, ন্যায়সঙ্গত একটি দাবিতে ঐক্যবদ্ধ তারুণ্যকে কখনোই খুন-হত্যা করে স্তব্ধ করা যায় না।

আন্দোলনের শুরুতে মানুষের মনে অনেক সন্দেহ ছিল, প্রশ্ন ছিল, আরও ছিল জিজ্ঞাসা। কাদের মোল্লার যাবজ্জীবনের রায়কে সরকারের আঁতাত বা আপসের রায় হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন অনেকেই প্রথম দিকে। পরে ট্রাইব্যুনালের আপিল-সংক্রান্ত আইন সংশোধন, গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, দায়িত্বশীল মন্তব্যে ধীরে ধীরে সরকারকে ঘিরে জনগণের মনের অনেক সন্দেহের মেঘ দূর হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতার বিষয়টি অনেকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে জনগণের কাছে। দেশের রাজনীতিতে যখন চলছে সহিংসতার দৌড়ঝাঁপের প্রতিযোগিতা, তখন গণজাগরণ মঞ্চের তরুণরা অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে জয় করে নিয়েছে দেশের মানুষের হৃদয়। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি এবং জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চে উদীচীসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা যখন প্রতিবাদী গণসঙ্গীতের মাধ্যমে দ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে চারদিকে, তরুণরা যখন স্লোগানে স্লোগানে বজ্রমুষ্টি তুলে ধরছে খোলা আকাশে, তখন অনেক সাধারণ মানুষ নিজের পরিচয় গোপন করে বাড়ি থেকে খাবার বানিয়ে আন্দোলনকারীদের জন্য বিলি করে গেছেন পরম মমতায়। এখানে ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়ে নারীরা এসেছেন, লাঠিতে ভর দিয়ে এসেছেন বৃদ্ধরা; অনেকে পুরো পরিবার নিয়ে চলে এসেছেন ফাঁসির দাবিতে। এ রকম স্বতঃস্ফূর্ত জনস্রোত একাত্তরের পর দেখেনি কেউ।

রাশেদ হাসান :আবৃত্তিশিল্পী ও চট্টগ্রামে গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন