এ এম এম শওকত আলী
গত ১১ মার্চ ছিল প্রধান বিরোধী দলের সমাবেশ। ফেব্রুয়ারি-মার্চ সময়কালে কখনো সমাবেশ, কখনো বিক্ষোভ, মানববন্ধন এবং সব শেষে হরতাল। ১১ মার্চের দলীয় সমাবেশ জমে ওঠার আগেই কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণে তা পণ্ড হয়। এরপর রাজনৈতিক ইতিহাসের দ্বিতীয়বারের মতো একটি ব্যতিক্রমী পুলিশি অভিযান। প্রধান বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ককটেল তল্লাশি ও গণ-আটক। এর কিছুদিন আগে যেকোনো সমাবেশ বা হরতালের সময় এ দলের নেতাদের অবরুদ্ধ রাখার ঘটনাও দৃশ্যমান ছিল। ক্রমবর্ধমান এ সংঘাতপূর্ণ পরিবেশে প্রধান বিরোধী দলের একমাত্র উপায় ছিল সর্বোচ্চ আদালতে গিয়ে জামিনলাভ। এর আগের ঘটনায় প্রধান বিরোধী দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে একাধিক মামলায় শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টের আদেশে জামিনে মুক্তিলাভ করেই ১১ মার্চের সমাবেশে প্রথমে তাঁকে আটক করে ছেড়ে দেওয়া হয়, কিন্তু তারপর আবার আটক করা হয়। এ ঘটনা সম্ভবত ঘটে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তল্লাশি শেষ হওয়ার আগে। তল্লাশির এক পর্যায়ে প্রথমে দুইটি ও পরে সর্বমোট ১০টি ককটেল কার্যালয়ের ভেতরে পাওয়া যায়। একই সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের অফিস কক্ষের বন্ধ দরজার তালা হাতুড়ি দিয়ে ভাঙে পুলিশ। শেষ পর্যন্ত একে একে বিরোধীদলীয় শীর্ষপর্যায়ের নেতাসহ মোট ৭০, অন্য সূত্রে ২০০ জনকে আটক করা হয়। অনুমান করা সম্ভব যে এর ফলে সংঘাত বৃদ্ধি পাবে। কালের কণ্ঠের ১২ মার্চের প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী নয়াপল্টনে জামায়াতের কিছু নেতা বক্তৃতা দিলেও কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
১১ মার্চের পুলিশি অভিযান বহুবিধ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কয়েকটি টিভি মিডিয়ায় এ বিষয় নিয়ে একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক তাঁদের মতামত দিয়েছেন- এর মধ্যে একটি হচ্ছে প্রধান বিরোধীদলীয় শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আটক করাই ছিল এ অভিযানের মুখ্য উদ্দেশ্য। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে একাধিক বিশ্লেষক বলেছেন, এ ধরনের গণগ্রেপ্তারের মাধ্যমে প্রধান বিরোধী দলকে নিষ্ক্রিয় করাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। মনে করা হয়েছে, এর ফলে প্রধান বিরোধী দল আহূত আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যাবে। সেটা হবে কি না তা এখনই বলা সম্ভব নয়। এ ঘটনা ঘটেছে এমন এক সময়, যখন শান্তিপ্রিয় সব নাগরিক প্রধান দুই দলের মধ্যে সংলাপের কিছু কথা শুনেছিল। সে সংলাপ যে সহজে হবে না তা বোঝা যায়। ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা ইতিমধ্যে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তাতে ভিন্নতা থাকলেও সংলাপের পথ যে রুদ্ধ তা বোঝাই যায়। প্রধান বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের অপরাধী বলা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে, যাঁরা জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে তাঁদের সঙ্গে কোনো সংলাপ হতে পারে না। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী যাঁদের ১১ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁরা আইনের চোখে অপরাধী। ককটেল উদ্ধারের ভিত্তিতেই এ কথা বলা হয়েছে। অবশ্য আরো বলা হয়েছে, অভিযানের প্রাক্কালে এ দলের কর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ করে। এ ধরনের কোনো দৃশ্য অবশ্য কোনো টিভি মিডিয়ায় ওই দিন দেখা যায়নি। যা দেখা গেছে, তা হলো বিস্ফোরণের শব্দ ও ধোঁয়া। তবে এ কথা প্রমাণিত, ককটেল ছোড়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রধান বিরোধী দলের বক্তব্য হলো, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব যখন সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন সমাবেশ ভেঙে যায়। অর্থাৎ সমাবেশ পণ্ড করার জন্য কে বা কারা ককটেল বিস্ফোরণ করে। বিষয়টি অবশ্যই তদন্তসাপেক্ষ। তবে কিছু টিভি মিডিয়ার আলোচকের মতে, পুলিশের ভাষ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়।
আলোচকদের মতে, যেকোনো রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে তল্লাশি ও নেতাদের আটকের ঘটনার কোনো পূর্ব নজির নেই। এ মতের সূত্র ধরে আরো কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। প্রধান প্রশ্নটি ছিল- পুলিশি অভিযানের কোনো প্রয়োজন ছিল কি না? হরতালের সময় অতীতে ককটেল বিস্ফোরণের বহু নজির রয়েছে। কিন্তু কখনো কোনো দলের কার্যালয়ে পুলিশ এ ধরনের অভিযান চালায়নি। পাল্টা এক আলোচকের বক্তব্য ছিল কোনো দলের নেতা-কর্মীরা যদি অপরাধমূলক আচরণ করে, তাহলে পুলিশ কী করবে? আলোচক আরো বলেন, ২০০৫ সালে পুলিশ এ ধরনের একটি অভিযান করেছিল। প্রতি-উত্তর ছিল অতীতের কোনো ঘটনা দিয়ে বর্তমানকে বিচার করা যায় না। এক পর্যায়ে আলোচনার উপস্থাপক উদ্ভূত অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির উত্তরণের বিষয়টির গুরুত্ব আরোপ করেন। কিছু আলোচক সুশাসনের প্রকট অভাবের বিষয়টিও বলেন। আলোচকদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু সব কিছুর ঊধর্ে্ব যে বিষয়টি দৃশ্যমান তা হলো দেশব্যাপী অশান্তি ও ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা।
এ পরিবেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সহিংস ঘটনা একেবারেই থামেনি বা থামানো সম্ভব হয়নি। সাতক্ষীরাসহ জয়পুরহাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় সহিংসতার ঘটনার কথা সবাই জানে। এখন কিছু জেলা শহরেও বিজিবি শান্তি রক্ষার জন্য নিয়োজিত। কিন্তু জেলা শহরের বাইরে কী হবে? স্বল্পসংখ্যক থানা পুলিশ দিয়ে পূর্ণ শান্তি বজায় রাখা সম্ভব নয়। সরকার এর জন্য উপজেলা কমিটি গঠন করেছে। কমিটি আলোচনা ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। প্রত্যক্ষভাবে শান্তি রক্ষা করা সম্ভব নয়। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এ কথা প্রমাণ করে। সে আন্দোলন ছিল দেশের বৃহত্তর স্বার্থে। বর্তমানে সে অর্থে অতীতের আন্দোলনের সমতুল্য না হলেও বাহ্যিকভাবে কিছু মিল রয়েছে। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে ইউনিয়ন পরিষদসহ সরকারি কিছু স্থাপনা ধ্বংস করা হয়। মৌলিক গণতান্ত্রিক প্রথায় নির্বাচিত ওই স্তরের নেতাদের বাড়িও আক্রমণ করা হয়। বর্তমানে উপজেলা পরিষদসহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে। যেমন নন্দীগ্রাম উপজেলা পরিষদ। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পল্লী বিদ্যুৎ সংস্থার বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম। নন্দীগ্রামে এখন ওই অঞ্চলের অধিবাসীদের উপযুক্ত সেবা প্রদান করতে পারছেন না উপজেলায় নিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তারা। শিবগঞ্জের পল্লী বিদ্যুৎ সংস্থা এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ফলে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ওই অঞ্চলের ৩৫ হাজার কৃষক বোরো চাষ করতে পারবে না। সার্বিকভাবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি না হলেও বোরো চাষে ব্যর্থ দরিদ্র কৃষকের ক্ষতি কে পূরণ করবে? এ বিষয়ে সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়েরও প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে বাঁশখালীসহ দেশের উত্তর অঞ্চলের কয়েকটি গ্রামে। হাইকোর্ট পুনর্বাসনের আদেশ দিয়েছে। এ আদেশ পালনের কোনো খবর সংবাদপত্রে দৃশ্যমান নয়। এ সম্প্রদায়ের মানসিক ক্ষতি সর্বাধিক। এদের উপাসনালয় ভাঙা বা জ্বালানোর ঘটনা একাধিক। এ ঘটনা মাঝে-মধ্যে এখনো হচ্ছে। সার্বিকভাবে তারা অত্যন্ত আতঙ্কের মধ্যে জীবনযাপন করছে। সহিংসতা যেমন সমাধানের পথ নয়, ঠিক একইভাবে মামলার পর মামলা করাও সমাধানের পথ নয়। কারণ উদ্ভূত অশান্ত ও আতঙ্কময় পরিবেশের প্রধান কারণ রাজনৈতিক মতবিরোধ।
১২ মার্চ টিভি মিডিয়ায় একটি ব্রেকিং নিউজ দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের একজন মুখপাত্র বলেছেন, আইনগত জটিলতা না থাকলে প্রধান বিরোধী দলের নেতাদের যত সম্ভব মুক্তি দেওয়া হবে। ওই দিনের আরেকটি সংবাদ ছিল প্রধান বিরোধীদলীয় এক নেতার উক্তি। তাঁর মতে, ওই দলের কার্যালয়ে পুলিশি অভিযান রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত ও আইনসিদ্ধ হয়নি।
ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্রের বক্তব্যে প্রতীয়মান হয়, প্রধান বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গণ-গ্রেপ্তারের বিষয়ে আইনগত জটিলতার বিষয়ে নিশ্চিত না হয়েই তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পক্ষান্তরে জটিলতা থাকলে তাঁদের মুক্ত করার বক্তব্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ১১ মার্চে টিভিতে দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ বক্তব্যে প্রধান বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের প্রত্যক্ষভাবে অপরাধী বা ক্রিমিনাল বলা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত প্রধান বিরোধী দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ আর দুই নেতাকে মুক্তি দেওয়া হয়। বাকি ১৫৪ জনের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে মামলা হয়। তাঁরা সবাই এখন কারাগারে। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশি অভিযান, ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতাসহ অন্য সব মহল নিন্দা করেছে। মিডিয়ায় এ নিয়ে সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে। এতে দুই দলের মধ্যে ব্যবধান আরো বৃদ্ধি পাবে। প্রকাশিত ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী এবং প্রধান বিরোধী দলের বক্তব্য এ কথা প্রমাণ করে। মন্ত্রী বলছেন, সংলাপে বসতে সরকার প্রস্তুত। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলছেন, সরকারই সংলাপ চায় না। 'হ্যাঁ' ও 'না'র দ্বন্দ্বে সংলাপ এখনো ঝুলে আছে। অথচ দেশের বিরাজমান অশান্তি ও আতঙ্ক দূর করার জন্য বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চলমান অশান্ত ও আতঙ্কময় পরিবেশে যোগ হয়েছে এক নতুন মাত্রা। চট্টগ্রামে গণজাগরণ মঞ্চ ও হেফাজতে ইসলাম একই জায়গায় সমাবেশ ডাকায় বন্দরনগরীতে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। শেষ পযন্ত দুই পক্ষই এ কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছে। তবে ভবিষ্যতে এটা যে হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশি অভিযানের অব্যবহিত পরই এ দল আরো দুই দিন অর্থাৎ ১৮ ও ১৯ মার্চ হরতাল করবে। শর্তযুক্ত এ হরতালের কারণ গ্রেপ্তারকৃত সব নেতা-কর্মীর মুক্তি। মুক্তির বিষয়টি এখন আর সরকারের আওতাভুক্ত নয়। কারণ জামিন ও রিমান্ডের শুনানি ২০ মার্চ ধার্য করা হয়েছে। প্রায় সব দলই একটি বিষয়ে একমত। তা হলো হরতাল একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ দুইজন নেতাকে মুক্তি দিয়েও কোনো ফল হয়নি। কারণ দাবি হলো সব নেতা-কর্মীর নিঃশর্ত মুক্তি। ভবিষ্যতে ঘন ঘন হরতালের ফলে বিরাজমান অশান্ত ও আতঙ্কের পরিবেশ থেকে জনগণ সহজে মুক্তি পাবে না। দুই দলের মধ্যে সংলাপ অচিরেই হওয়া প্রয়োজন।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
Source: http://www.kalerkantho.com/index.php?view=details&type=gold&data=news&pub_no=1184&cat_id=2&menu_id=20&news_type_id=1&index=0#.UUTt8jfVebc
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন