রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৩

জামায়াত রক্ষার চেষ্টা । হেফাজতের শক্তির পেছনে জামায়াত আর সরকারের নমনীয়তা

মোশতাক আহমদ
ইন্টারনেটে ইসলাম ও মহানবী (সা.)-কে অবমাননা করা হচ্ছে- এমন অভিযোগে মাঠে নামলেও সরকারের তদন্ত কমিটিকে সহায়তা না করার নীতি নিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। অভিযোগ উঠেছে, সংগঠনটি জামায়াত-শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই মূলত কাজ করছে এবং এ ক্ষেত্রে তারা সরকারের নমনীয়তার সুযোগ নিচ্ছে। এদিকে আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলাম আন্দোলনে নামার পর থেকে জামায়াত-শিবির রাজপথে একক কর্মসূচি দেওয়া বন্ধ রেখেছে। সর্বশেষ গতকাল শনিবার জামায়াত হেফাজতে ইসলামের আমিরের পক্ষে একটি বিবৃতিও দিয়েছে।

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলনরত গণজাগরণ মঞ্চকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে এখন মাঠে রয়েছে হেফাজতে ইসলাম। তাদের অভিযোগ, গণজাগরণ মঞ্চে ব্লগাররা ইসলাম ও মহানবী (সা.)-কে লক্ষ্য করে কটূক্তি করছে। এরই মধ্যে গত বুধবার সরকার একটি কমিটি গঠন করে জানায়, সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ফেসবুকসহ ইন্টারনেটের কোনো সাইটে ব্লগ লিখে ইসলাম ও মহানবী (সা.)-কে লক্ষ্য করে কটূক্তি করার ঘটনা ঘটে থাকলে তাদের শনাক্ত করা হবে। হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতেও ব্লগারদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অপতৎরতার অভিযোগ এনে তা বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মাঈনুদ্দিন রুহী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা সরকারের এ কমিটি প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ এ কমিটিতে ইসলামী বিশেষজ্ঞ কোনো আলেম-ওলামা নেই।' তবে হেফাজতে ইসলামের এমন আচরণকে অগণতান্ত্রিক ও সম্পূর্ণ মনগড়া বলেছেন বাংলাদেশ ফেতনা প্রতিরোধ কমিটির নেতারা। তাঁরা বলছেন, হেফাজতে ইসলাম যদি সত্যিই নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তি চায়, তাহলে তাদের উচিত ছিল সরকারের তদন্ত কমিটিকে সহায়তা করা। কিন্তু তারা তা না করে তাদের পরিকল্পনা মতো কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে।

সাঈদীর মুক্তি দাবি : জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের দৃশ্যত কোনো সম্পর্ক না থাকলেও গত শুক্রবার চট্টগ্রামে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে জামায়াত নেতা সাঈদীর মুক্তির দাবি তোলা হয়। চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের সামনে আয়োজিত সমাবেশে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নেতা আনোয়ার হোসেন রাব্বানী বলেন, আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে বিচারের নামে প্রহসন করে ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাঁকে মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন চলবে।

এ ছাড়া হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাঈনুদ্দিন রুহী ও সংগঠনের আমির শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফের ছেলে মাওলানা আনাছ মাদানী বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের শরিক দল ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা। জানা যায়, চট্টগ্রামে হেফাজতে ইসলামের সমন্বয়কারী হিসেবে ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা মাওলানা রুহীই চট্টগ্রামে হেফাজতে ইসলামের সব কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাই বিভিন্ন মহলে অভিযোগ উঠেছে, ইসলাম রক্ষা আন্দোলনের নেপথ্যে জামায়াত-শিবিরকেই রক্ষার চেষ্টা করছে হেফাজতে ইসলাম।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফেতনা প্রতিরোধ কমিটির চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের বাসিন্দা মুফতি মাসুম বিল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিভিন্ন কারণে হেফাজতে ইসলামের কার্যক্রম আর ইসলামের হেফাজতের কাজে নেই। তারা মূলত জামায়াত-শিবিরকে হেফাজত করতে চায়।'

তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মাঈনুদ্দিন রুহী কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁদের সঙ্গে জামায়াতের কোনো সম্পর্ক নেই; তাই জামায়াতকে বাঁচাতে তাঁদের আন্দোলন করার প্রশ্নই আসে না।

এদিকে গণতান্ত্রিক ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মাওলানা মাসউদুর রহমান বিক্রমপুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর মুক্তির দাবি প্রমাণ করে, তারা এখন হেফাজতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তিনি বলেন, 'মহানবী (সা.)-এর অবমাননাকারীদের শাস্তির দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হলো, তাতে একজন যুদ্ধাপরাধীর মুক্তি দাবি করা পক্ষান্তরে মহানবী (সা.)-কেই অবমাননা করার শামিল।'

জামায়াতের বিবৃতিতে সমর্থন : হেফাজতে ইসলাম আন্দোলনে নামার পর থেকে জামায়াত-শিবির রাজপথে একক কোনো কর্মসূচি দেওয়া বন্ধ রেখেছে। তারা বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ব্যানারে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই মধ্যে জামায়াত হেফাজতে ইসলামের আমিরের পক্ষে বিবৃতিও দিয়েছে। গতকাল শনিবার জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান এক বিবৃতিতে হেফাজতে ইসলামের আমিরের বিষয়ে কটূক্তির নিন্দা জানান।

বিবৃতিতে জামায়াত সেক্রেটারি বলেন, 'হেফাজতে ইসলামের আমির ও চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতামিম সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমে দ্বীন আল্লামা শাহ আহমদ শফী সম্পর্কে শাহরিয়ার কবির গত ১৫ মার্চ মোমেনশাহী প্রেসক্লাবে যে বিষোদগারপূর্ণ এবং অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন, এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। ইসলাম ও আলেমসমাজ সম্পর্কে তাঁর সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ থাকলে তিনি আল্লামা শাহ আহমদ শফী সম্পর্কে এ ধরনের রুচিহীন মন্তব্য করে এ দেশের আলেমসমাজ ও তৌহিদী জনতার মনে আঘাত দিতে পারতেন না।'

সরকারের নমনীয়তা : শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ চট্টগ্রামে সমাবেশের ডাক দিলে একই স্থানে পাল্টা সমাবেশ ডাকে হেফাজতে ইসলাম। পুলিশ প্রশাসন গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশকে নিরাপত্তাদানের দিকে না গিয়ে উল্টো ১৪৪ ধারা জারি করে। হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান না নিয়ে ডিসি-এসপিসহ চট্টগ্রামের স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন নমনীয়ভাবে অনুরোধ জানায়। এ সুযোগে সংগঠনটি শেষ পর্যন্ত তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। এরই মধ্যে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকারসহ একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হলে পুলিশ ফেনী থেকে তাদের ঢাকার দিকে ফিরিয়ে দেয়। শাহবাগের প্রতিনিধিদল চট্টগ্রামে হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করার আগ্রহ দেখালেও সংগঠনটির নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। বরং তারা বলেন, আল্লাহ-রসুলের দুশমনদের সঙ্গে ওলামা-মাশায়েখদের কোনো আলোচনা হতে পারে না।

গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল স্মরণে নৌকা সমর্থকগোষ্ঠী নামক সংগঠনের এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীও নমনীয়তার অভিযোগ ওঠার বিষয়টি উল্লেখ করেন।

জামায়াতের টাকায়ই হেফাজতে ইসলাম চলে- এমন অভিযোগও আছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মাঈনুদ্দিন রুহী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা কোনো সংগঠনের টাকায় চলি না। জনসাধারণই আমাদের প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তা করে। তা ছাড়া আমাদের সংগঠন চালানোর টাকা আমরাই সংগ্রহ করি।'

বর্তমান সরকারের আমলে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে চট্টগ্রামে হেফাজতে ইসলামের যাত্রা শুরু হয়। ধর্মহীন শিক্ষানীতি, নারীনীতি ও সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস উঠিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ওই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি সংগঠনটি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে মহাসমাবেশের আয়োজন করে। কিন্তু প্রশাসন সমাবেশের অনুমতি না দেওয়ায় সহিংসতা ঘটে এবং কর্মসূচি পণ্ড হয়ে যায়। ওই সময় হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ গুলিবিদ্ধ হন। এরপর থেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল সংগঠনটির কার্যক্রম। কিন্তু ব্লগার রাজীব হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর বিরুদ্ধে ইসলামবিরোধী লেখালেখির অভিযোগ তোলা হলে আন্দোলনে নামে হেফাজতে ইসলাম। তারা আগামী ৬ এপ্রিল নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তির দাবিতে দেশের সব জেলা থেকে ঢাকা অভিমুখী লংমার্চ কর্মসূচিরও ঘোষণা দিয়েছে।

সংগঠনের এক নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, এতে বাধা এলে লাগাতার হরতাল কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তাভাবনা রয়েছে তাঁদের।

Source: http://www.kalerkantho.com/?view=details&type=gold&data=news&pub_no=1184&cat_id=1&menu_id=13&news_type_id=1&index=1

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন