সমুদ্র হক ॥ বাঙালীর ঐতিহ্যের সংস্কৃতির শিকড় কতটা গভীরে তা চোখে আঙ্গুল
দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম। এই শিকড় উপড়ানো যে কোনভাবেই সম্ভব নয়
তা যুগে যুগে ইতিহাসের পেছনের পাতায় লেখা আছে। এ দেশের মাটির ওপর অনেক
জাতির অনেক দিনেরই লোভ আছে। কত বীর কত সেনা এসেছিল। বাঙালীর কাছে কেউ টিকতে
পারেনি। সকলেই জেনে গেছে এই মাটিতে যেমন সোনা ফলে তেমনই বজ্র ঝরে। এই
মাটির নিরীহ শান্ত মানুষ একবার ক্ষেপে গেলে কেউ তাদের ঠেকাতে পারে না।
দক্ষিণ এশিয়ায় এই বাংলাদেশ যুগে যুগে সম্প্রীতির বন্ধনের অনেক পরিচয় দিয়েছে
এবং টিকিয়ে রেখেছে। এই দেশেই সকল ধর্মের সকল বর্ণের মানুষ হৃদয়ের ভালবাসা
দিয়ে বাস করে। যেখানে ‘ফান্ডামেন্টালিস্ট’ দের কোন স্থান নেই।
বাঙালীর
সংস্কৃতির এই চিরঞ্জীব ধারা পূর্বসূরিরা যেমন লালন করেছেন তেমনই বংশ
পরম্পরায় প্রবীণরা তা তুলে দিয়েছেন প্রজন্মের পর প্রজন্মের হাতে। এই
প্রজন্ম সময় মতোই সেই সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার ব্রত নিয়ে মাঠে নামে।
প্রবীণদের দেখিয়ে দেয়া সেই আলোকিত পথ ধরেই এগিয়ে গিয়ে নতুন প্রজন্ম এই
আলোকিত পথকে রশ্মিতে ভরিয়ে দেয়। যে রশ্মিতে পুড়ে ছাই হয়ে যায় অন্ধকারের
বিষদাঁতের ড্রাকুলার ও কাল সাপ। ১৭৫৭ সালে পলাশীর সূর্যাস্তের পর
মুজিবনগরের (মেহেরপুর) আরেক আম্রকাননে বাঙালীর সূর্যোদয়ে সময় নিয়েছিল
প্রায় ২শ’ বছর। সেই সূর্যালোকের কলঙ্কিত অধ্যায় দূর করতে প্রজন্মের জেগে
উঠতে খুব বেশি দিন সময় নেয়নি। ইতিহাসের নিরিখে ৪২ বছর খুব বেশি সময় নয়।
বাঙালীর প্রজন্ম কোথায় পলাশী কোথায় রেসকোর্স ময়দান কোথায় আম্রকানন তার
খোঁজ রাখে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার বেছে নিয়েছে শাহবাগের চত্বর। প্রজন্মের
এই চত্বরে গণজাগরণের হৃদয়ের মঞ্চে যখন প্রজন্মের কাঁধে শিশু প্রজন্ম পতাকা
হতে উঠে রাজাকারের ফাঁসি দাবি করে ও সেøাগান দেয় তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা
মেঘনা যমুনা তখন পূর্বসূরি প্রবীণের ঠোঁটেও হাসির ঝলক বয়ে যায়। মনে ভাবে
এই তো চেয়েছিল তারা। কী না দেখাতে পারে আজকের প্রজন্ম! যে জামায়াত-শিবির
হরতালের ডাক দিয়ে হিংস্রতা নিয়ে আসে সেই হিংস্রতা কী ভাবে সংস্কৃতির
শক্তিশালী ধারায় বধ করে তার প্রমাণ দিল তাঁরা। কাল সাপের ঠোঁটে যারা চুমু
দেয় এতদিন হয়তো বুঝতে পারেনি কতটা ভয়ঙ্কর থাবার মুখোমুখি তারা । বর্তমান
প্রজন্ম তাঁদেরও বাঁচিয়ে দিতে বিষধরের ফণার টুঁটি চেপে ধরেছে। এরপরও যদি
কাল সাপের সঙ্গে সখ্যতা কেউ ছাড়তে না পারে তা হলে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে
কোন কিছু ঘটার দায় তাদেরই বহন করতে হবে। প্রজন্ম যেভাবে জেগেছে তাতে বিষধর
কাল নাগিনীদের ঠাঁই আর নেই। সরকারও বাধ্য হচ্ছে ড্রাকুলার কোবরাদের হাত
থেকে দেশের মানুষকে বাঁচাতে। প্রজন্ম চত্বরের গণজাগরণ মঞ্চে যারা আসছেন
তারাও বুঝতে পারছেন জামায়াত-শিবির নামের কোন আন্তর্জাতিক চক্রের মধ্যে
পড়েছে এ দেশের মানুষ। জামায়াত নামের দল যে দেশগুলোতে আছে সেখানকার কি
অবস্থা তাও জানা যায় এখন। এমনও ধারণা করা হয় একই পণ্যের নানা ব্রান্ডের মতো
জামায়াতেরই ব্রান্ড জেএমবি, হরকাতুল জেহাদ সহ অন্যান্য ফান্ডামেন্টালিস্ট
দল ছিল এবং এখনও নানা ছদ্মাবরাণে আছে। জামায়াত-শিবির দিনে দিনে কতটা বেড়ে
উঠেছে তার প্রমাণ দেয়ার দরকার পড়ে না। মানুষ তা জানে। অনেকেই বলাবলি করেন
জামায়াতিদের কিভাবে রুখে দেয়া যাবে! যারা প্রশ্ন করেন তাদের বেশিরভাগই
জামায়াত সমর্থন করেন না। দীর্ঘদিন জামায়াত শিবিরের উত্থান দেখে তারা অনেকটা
হতাশ হয়েই এমন কথা বলেন। তবে ৫ ফেব্রুয়ারির দিন কয়েক পর হতে তাঁদের এই
হতাশা দূর হতে শুরু করেছে। তারাও সংহতি প্রকাশ করে নিয়মিত যাচ্ছেন প্রজন্ম
চত্বরের গণজাগরণ মঞ্চে। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম ও তাঁর স্ত্রী নাজরিন
বললেন ‘আমরা আমাদের সন্তানদের গড়ে তুলতে ভুল করিনি। ওরাই এ যুগের
মুক্তিযোদ্ধা। আলোকিত পথেই ওরা হাঁটছে।’ বর্তমান প্রজন্মের তরুণ রুবাইয়াত
হাসান প্রজন্ম চত্বরে তাঁর দুই বছরের ভাইপো তেভিনকে কাঁধে তুলে নিয়ে হেসে
বললেন ‘জিজ্ঞেস করুন ও কি বলে!’ শিশু তেভিন শিশুর মতো উচ্চারণে বলল ‘তোমার
আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা/কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই..।’ মুক্তিযোদ্ধা
মেখানেইল দাস বললেন ‘এখনও শরীরের জোর কমেনি। ভাবনায় যা বুঝতে পারছি তাতে
বাঙালীর কলঙ্কের এই কীটকে শুধু রুদ্ধ করে দিলেই চলবে না এরা যেন ঘুন পোকা
হয়ে কোথাও প্রবেশ করতে না পারে সেই দায়িত্বও নিতে হবে এখনই।’ প্রজন্ম
চত্বরের জনস্রোতের সেøাগান ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে বাংলার ঘরে ঘরে
সুপারসনিকের চেয়েও কয়েক হাজার গুণ গতিতে পৌঁছে যাচ্ছে। বাংলার প্রতিটি ঘর
প্রতিটি আঙিনা হয়ে উঠেছে প্রজন্মের চত্বর। কার সাধ্য আছে তীব্র স্রোতের এই
বাঁধ ভাঙা জোয়ার ঠেকাতে পারে।
জনকণ্ঠ, মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০১৩, ৫ চৈত্র ১৪১৯
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন