মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০১৩

গো. আযমের অপরাধ ইতিহাসে নজিরবিহীন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ যুক্তিতর্কে (আর্গুমেন্ট) বলেছেন, জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের আলোকবর্তিকা ছিলেন, যা পৃথিবীর ইতিহাসে নজীরবিহীন। বাতিঘর (লাইটহাউস) যেভাবে জাহাজকে দিকনির্দেশনা দেয়, তেমনি একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংশ্লিষ্ট কর্মকা- পরিচালনায় দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন গোলাম আযম। অন্যদিকে তার আইনজীবীকে ফের জরিমানা করেছে ট্রাইব্যুনাল। এবার ট্রাইব্যুনালে অনুপস্থিত থাকায় ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার এ টাকা ২০ মার্চের মধ্যে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের কাছে জমা দিতে হবে। তা না হলে যুক্তিতর্ক ক্লোজড করা হবে। অন্যদিকে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের ২১তম সাক্ষী আবুল বশরের জেরা করা হয়েছে। আজ পরবর্তী সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ করা হবে। চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই আদেশ প্রদান করেছে। ট্রাইব্যুনালে অন্য দু’সদস্য ছিলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক।

একই অভিযোগে বিএনপি নেতা আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে ১৩তম সাক্ষী ডা. কাজী এজাজ আহমেদের জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়েছে। জবানবন্দী শেষে সাক্ষীর জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় মামলার কার্যক্রম আগামী ২০ মার্চ পর্যন্ত মুলতবি করা হয়। একই ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের পক্ষে ২০ মার্চ ৫ম ও শেষ সাফাই সাক্ষীকে হাজিরের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ওই দিন সাক্ষী হাজির করতে না পারলে সাফাই সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত ঘোষণা করে মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন করা হবে। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ সোমবার এ আদেশ প্রদান করেছে। ট্রাইব্যুনালে অন্য দু’সদস্য ছিলেন বিচারপতি মোঃ মজিবুর রহমান মিয়া ও জেলা জজ মোঃ শাহিনুর ইসলাম। অপরদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলীকে এ্যাটর্নি জেনারেলের মর্যাদায় পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।
আলোকবর্তিতার মতো অপরাধ ॥ প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ বলেছেন, জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম গোলাম আযম ১৯৭১ সালে একটা লাইটহাউসের মতো ছিলেন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় যত ভয়াবহতা হয়েছে, সবই হয়েছে তাঁর নির্দেশনায়। গোলাম আযম তখন জামায়াতের প্রধান ছিলেন। আর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছিল জামায়াতের সদস্যদের দিয়েই। বাতিঘর (লাইটহাউস) যেভাবে জাহাজকে দিক-নির্দেশনা দেয়, তেমনি একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংশ্লিষ্ট কর্মকা- পরিচালনায় দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন গোলাম আযম। চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ ৫ম দিনের মতো যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ এসব তথ্য তুলে ধরেন।
তুরিন আফরোজ বলেন, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় যত ভয়াবহতা হয়েছে, সবই হয়েছে গোলাম আযমের নির্দেশনায়। গোলাম আযম তখন ছিলেন জামায়াতের প্রধান। আর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছিল জামায়াতের সদস্যদের দিয়েই। প্রসিকিউটর ট্রাইব্যুনালে বলেন, একজন বেসামরিক ব্যক্তি হয়েও জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির গোলাম আযম নিরস্ত্র বাঙালী নিধনে ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’ পালন করেন।
পরে প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘের হাতে যখন অস্ত্র তুলে দেয়া হয়, তখন তারা একটি আধা-সামরিক বাহিনী (আলবদর) হিসেবে কাজ করে। গোলাম আযমের সেই সময়ের ভূমিকা আজ পুরো জাতির কাছে পরিষ্কার। তিনি রেডিওতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন, রাওয়ালপিন্ডি, করাচীসহ বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ‘অখ- পাকিস্তান’ রক্ষার নামে সমাবেশ করেছেন। তাদের বিভিন্ন সংগঠন চালানোর জন্য যেসব টাকা আসত, সেসব টাকার রসিদ আসত গোলাম আযমের নামে। পুরো একাত্তরে তার যেসব চিঠি আমরা দেখতে পাই, সেসব চিঠিতে দেখা যায়, তিনি বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। নীতি নির্ধারণ করেছেন, অপারেশন নিয়ন্ত্রণ করেছেন, অর্থনৈতিক ক্ষমতাও তার হাতেই ছিল। কে রাজাকার হবে, কাকে রাজাকার হিসেবে রিক্রুট করা হবে, কাকে রাজাকারের আইডি দেয়া হবে- সবই হতো তাঁর নির্দেশে।
যুক্তিতর্ক শেষে সাংবাদিকদের বিফ্রিংয়ে ড. তুরিন আফরোজ বলেন, আমি আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইনে গোলাম আযমের ভূমিকার কথা যুক্তিতর্কে তুলে ধরেছি। প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি, একাত্তর সালে তিনি ছিলেন সুপিরিয়র। পুরো জামায়াত, যা ছিল একটি রাজনৈতিক দল- কিভাবে একটি মিলিশিয়া বাহিনীতে পরিণত হয়ে গেল? তুরিন আফরোজ আরও বলেন, গোলাম আযম বেসামরিক ব্যক্তি হয়েও পৃথিবীতে বেসামরিক ও সামরিক দু’টি বাহিনীকেই নিয়ন্ত্রণ করেছেন। গোলাম আযমের নির্দেশে, তার চিঠিতে রাজাকার বাহিনীতে সদস্য নিয়োগ করা হয়েছে। এরকম ক্ষমতা যাঁর আছে, তাঁর তো অন্যায় করা থেকে বাহিনীকে বিরত রাখারও ক্ষমতা ছিল। কিন্তু তা তিনি প্রয়োগ করেননি। তিনি যে আলোটা বিচ্ছুরণ করেছেন সেটা শুধুই কষ্টের, শুধুই ভয়াবহতার, শুধুই নির্মমতার।
জরিমানা ॥ জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের মামলার আইনজীবী হরতালের দিন উপস্থিত না হওয়াতে আবারও তাঁকে জরিমানা করেছে ট্রাইব্যুনাল। গোলাম আযমের মামলা পরিচালনা করতে হলে আগামী ২০ মার্চের মধ্যে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে গোলাম আযমের আইনজীবীকে জরিমানার ৫ হাজার দিতে হবে। তা না হলে যুক্তিতর্ক ক্লোজড করে দেয়া হবে। চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সোমবার এ আদেশ প্রদান করেছে।
আলীম ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত বিএনপি নেতা আব্দুল আলীমের আইনজীবী ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত না হওয়ায় প্রসিকিউশনের ১১তম সাক্ষীর বাকি থাকা জেরা বন্ধ করে দিয়ে ১৩তম সাক্ষী ডা. কাজী এজাজ আহমেদের জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়েছে।
কামারুজ্জামান ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের পক্ষে ২০ মার্চ ৫ম ও শেষ সাফাই সাক্ষী হাজিরের নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।ওই দিন সাক্ষী হাজির করতে না পারলে সাফাই সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত ঘোষণা করে মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের বিষয় ধার্য করে দেয়া হবে। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট অন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ আদেশ দিয়েছেন।
সৈয়দ হায়দার আলী ॥ আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলীকে এ্যাটর্নি জেনারেলের মর্যাদায় পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। সোমবার আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। এর আগে সৈয়দ হায়দার আলী আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্বে ছিলেন। উল্লেখ্য, সৈয়দ হায়দার আলী মানবতাবিরোধী অপরাধের মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার প্রসিকিউশন পক্ষের প্রধান প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জনকণ্ঠ, মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন