বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০১৩

যুদ্ধাপরাধের বিচারঃ সাঈদীর মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আপিল করা উচিত

প্রথমআলো | শেখ হাফিজুর রহমান | তারিখ: ২৮-০৩-২০১৩
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে রায় প্রদান করেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে সংগত কারণেই সাঈদীর পক্ষে তাঁর আইনজীবীরা আপিল করবেন। রাষ্ট্রপক্ষে এই রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিল করা হবে কি না, সে ব্যাপারে আমরা এখনো কিছু জানি না। তবে রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের তরফে অবশ্য অবশ্যই আপিল করা উচিত বলে আমি মনে করি।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ্য ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন দল ও অভিযুক্তের আইনজীবী, সুশীল সমাজের সদস্য, পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে ট্রাইব্যুনালের তিনজন বিচারক তাঁদের রায় পড়ে শোনান। রায়ের প্রথম অংশ পড়ে শোনান বিচারপতি আনোয়ারুল হক। তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের কোথাও বলা নেই যে পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তাদের বিচার না করে তার সহযোগী বাহিনীর নেতাদের বিচার করা যাবে না। ফলে ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ী জামায়াতের নেতা এবং রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর নেতাদের বিচারে কোনো বাধা নেই। সাঈদীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিচার করার এখতিয়ার ট্রাইব্যুনালের আছে কি না এবং এই বিচার তামাদি আইন দ্বারা বারিত কি না, সে বিষয়ে তিনি বলেন যে এ ব্যাপারে ট্রাইব্যুনালের আইনসংগত এখতিয়ার রয়েছে এবং অপরাধের বিচার তামাদি আইন দ্বারা বারিত নয়। তিনি বলেন, প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে যে দালিলিক ও মৌখিক সাক্ষী উপস্থাপন করা হয়েছে, তা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৯৭১ সালে রাজাকার বাহিনী ও স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন।

বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন রায়ের দ্বিতীয় অংশ পড়ে শোনান। সাঈদীর বিরুদ্ধে যে ২০টি অভিযোগ প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হয়েছে, তার প্রতিটি অভিযোগের ব্যাপারে উপস্থাপিত দালিলিক প্রমাণ ও মৌখিক সাক্ষ্যের আলোকে ট্রাইব্যুনাল কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সে বিষয়টি তিনি অবহিত করেন। ট্রাইব্যুনালের সভাপতি বিচারপতি ফজলে কবীর কোন কোন অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে এবং তার জন্য দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে কী দণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল, তা পড়ে শোনান।

বিচারপতি ফজলে কবীর বলেন যে সাঈদীর বিরুদ্ধে আনা ২০টি অভিযোগের মধ্যে আটটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসা বালিকে হত্যার দায়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণের দুটি, ধর্মান্তরিত করার একটি এবং লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতনের তিনটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তবে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করায় এবং মৃত্যুদণ্ড যেহেতু সর্বোচ্চ শাস্তি, সে জন্য অন্য ছয়টি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এবং শাস্তিযোগ্য হওয়ার পরও ওই অপরাধের দায়ে সাঈদীকে কোনো দণ্ড প্রদান করা হয়নি। আর এখানে ট্রাইব্যুনাল ভুল করেছেন বলে দ্বিমত রয়েছে। কোনো কোনো বিচারপতি, আইনজীবী ও আইনের অধ্যাপক মনে করেন, যে আটটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে, তার প্রতিটিতে সাঈদীকে দণ্ড প্রদান করা উচিত ছিল। কেননা, আপিল শুনানির পর যদি সুপ্রিম কোর্ট যে দুটি অভিযোগে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে, তা বহাল না রাখেন অথবা মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন বা অন্য কোনো মেয়াদের কারাদণ্ড প্রদান করেন, তাহলে কাদের মোল্লার মতো সাঈদীও দেশবাসীকে জয়সূচক ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে বেরিয়ে আসতে পারেন। যদিও এটা আইনি কল্পনাপ্রসূত।

সাঈদী ও কাদের মোল্লার রায় পর্যালোচনা করে ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রমে যে দুর্বলতা লক্ষ করেছি, তা হচ্ছে—ট্রাইব্যুনালের বিচারক ও প্রসিকিউশন টিমের আইনজীবীরা ১৯৭৩ সালের আইনের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল নন অথবা বিষয়টা তাত্ত্বিকভাবে জানলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ করতে পারছেন না। ১৯৭৩ সালের আইনের ২৩ ধারায় বলা হয়েছে যে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমের ক্ষেত্রে প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধি ও সাক্ষ্য আইনের বিধিবিধানগুলো প্রযোজ্য হবে না। সে জন্য পত্রিকা বা ম্যাগাজিনে প্রকাশিত খবর ও ছবি, চলচ্চিত্র, টেপরেকর্ডিং কিংবা অন্য কোনো প্রাসঙ্গিক দলিল ও সাক্ষ্য ট্রাইব্যুনাল বিবেচনায় নিতে পারবেন। ১৯৭৩ সালের আইনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ’৭১ সালে যারা যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছিলেন, তাঁদের বিচার করা। কিন্তু প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধি ও সাক্ষ্য আইনের বিধিবিধানগুলো ট্রাইব্যুনালের বিচারক ও প্রসিকিউশন টিমের আইনজীবীদের মনের মধ্যে এমনভাবে গেঁথে রয়েছে যে তাঁরা ওই জায়গা থেকে বের হতে পারছেন না। ফলে মামলার বিচারকাজ বিলম্বিত হচ্ছে। আর সাঈদী, নিজামী, গোলাম আযমদের আইনজীবীরাও এর সুযোগ নিয়ে বিচারকাজকে বিলম্বিত করছেন।

উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ওই যুদ্ধে গণহত্যা, মানবতা ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ করার দায়ে জার্মানির ২৪ জনের বিচার করার জন্য নুরেমবার্গে একটি ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয়। ওই ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ ১৯৪৫ সালের ১০ নভেম্বর শুরু হয়ে একটানা ১৯৪৬ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চলে। ১৯৪৬ সালের ১ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ে ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং চারজনকে ১০ থেকে ২০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।

নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো, অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে, অর্থাৎ নয় মাসের মধ্যে বিচার-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দোষী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা। বিচার-প্রক্রিয়া যেন দীর্ঘায়িত না হয়, সে জন্য নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল মৌখিক সাক্ষীর চেয়ে দালিলিক সাক্ষীর ওপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করেন। তাঁরা ফৌজদারি কার্যবিধি ও সাক্ষ্য আইনের বিধিবিধানের ওপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করেননি, ফলে বিচারকাজও বিলম্বিত হয়নি।

বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনটি নুরেমবার্গ চার্টার অনুসরণ করে করা হলেও বাস্তবের বিচার-প্রক্রিয়ায় এর কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা ও প্রসিকিউশন টিমের আইনজীবীরা ফৌজদারি কার্যবিধি ও সাক্ষ্য আইন দ্বারা এতটা বাধ্য ও পরিচালিত যে ১৯৭৩ সালের আইনের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হতে চলেছে। সাঈদীর মামলা তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলছে, অথচ এই মামলার বিচারকাজ এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে সমাপ্ত হওয়া উচিত ছিল। সাঈদীর মামলায় আটটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, অথচ আরও ৮-১০টি অথবা পুরো ২০টি অভিযোগেরই প্রমাণ হতে পারত। সে ক্ষেত্রে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত দালিলিক সাক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী ও প্রামাণিক। এ ক্ষেত্রে প্রসিকিউশন দুর্বলতার পরিচয় প্রদান করেছে। আর শক্তিশালী ও প্রামাণিক দালিলিক সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে যে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা যায়, সে ব্যাপারে ট্রাইব্যুনালের বিচারকদেরও বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে হবে। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা সেই কাজটিই করেছিলেন।

পরিশেষে দুটি প্রত্যাশা। এক. রাষ্ট্রপক্ষ যেন সাঈদীর মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার উদ্যোগ নেয় এবং উদ্যোগটি নিতে হবে ৩০ মার্চের মধ্যেই। দুই. সময় ক্ষেপণ না করে দ্রততার সঙ্গে যেন মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হয়।

শেখ হাফিজুর রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের, শিক্ষক ও অপরাধবিজ্ঞান গবেষক
hrkarzon@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন