সোমবার, ১৮ মার্চ, ২০১৩

সময় কি বিপজ্জনক, না সম্ভাবনাময়?

শাহাদুজ্জামান
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ কি সবচেয়ে বিপজ্জনক একটা সময় অতিক্রম করছে, নাকি এই সময়ের ভেতর আছে নতুন কোনো সম্ভাবনা? এ প্রশ্নের উত্তর এ মুহূর্তে ধোঁয়াটে, অস্পষ্ট। ফিল্মের নেগেটিভের মতো। আবছা একটা আভাস আছে কিন্তু ছবিটা ঠিক কী বোঝা যাচ্ছে না। বলা বাহুল্য বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথকে আচমকা এমন একটা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে রাজনীতির চেনা ক্ষেত্রের বাইরে সাইবার পরিসরে সক্রিয় কিছু তরুণ, তাদের শাহবাগ আন্দোলনের মাধ্যমে। শাহবাগ কি দেশের মানুষের ভেতর একটা ব্যাপক বিভাজন তৈরি করেছে, নাকি সমাজে চোরাস্রোতের মতো যে বিভাজনগুলো ক্রিয়াশীল ছিল, শাহবাগ সেগুলোকে স্পষ্ট করে তুলেছে মাত্র? শাহবাগ আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে, কিন্তু এটুকু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে এই আন্দোলন সমাজে নানামুখী প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে।

মোটা দাগে তিন ধরনের মানুষ শাহবাগের আন্দোলনের ব্যাপারে খুবই উৎসাহী হয়েছেন। অগণিত রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ সাধারণ মানুষ, যাঁরা দুটো প্রধান রাজনৈতিক দলের ভয়াবহ সংঘাতমূলক রাজনীতি দেখতে দেখতে বীতশ্রদ্ধ, তাঁরা হঠাৎ অচেনা কিছু তরুণের প্রাণবন্ত ডাকে আশান্বিত হয়েছেন। কোনো ক্ষমতা বা দলীয় বিবেচনায় নয়, নেহাতই দীর্ঘদিনের হতাশা থেকে বেরিয়ে আসার একটা সম্ভাবনা তাঁরা দেখেছেন। জীবনে মিটিং-মিছিলে যাননি তেমন বহু মানুষ ঘোরগ্রস্ত হয়ে ছুটে গেছেন শাহবাগে। অন্যদিকে, বাম রাজনীতির অনেক কর্মী উৎসাহে গেছেন শাহবাগে। তাঁরাও দুটো প্রধান রাজনৈতিক শক্তির বাইরে তৃতীয় শক্তির কথা বলে আসছেন দীর্ঘদিন। সেই তৃতীয় শক্তি তাঁরা নিজেরা হতে না পারলেও শাহবাগের মাধ্যমে তার একটা সম্ভাবনা হয়তো তাঁরা দেখেছেন। আর শাহবাগের দাবিগুলো অনেকাংশে তাঁদের দলীয় দাবির সমার্থক বলে ভোটের রাজনীতির হিসাবমতো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সরকারও সমর্থন জানিয়েছে তাদের।

বিপরীতে শাহবাগ আন্দোলনের ব্যাপারে একদল মানুষ খুবই ক্ষুব্ধ এবং কিছু মানুষ দ্বিধান্বিত, নিরাসক্ত। যারা ক্ষুব্ধ, বলা বাহুল্য তাদের মধ্যে প্রথম জামায়াতে ইসলামী। দীর্ঘদিন জামায়াত বেশ অব্যাহতভাবে এ দেশে বিকশিত হচ্ছিল। যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলেও সরকারকে নানা হুমকি দিয়ে তারা বেশ চাপের মধ্যে রেখেছিল, কিন্তু অবস্থাটা পাল্টে দিল শাহবাগ। তারা এসে একেবারে জামায়াতের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলল। স্বভাবতই শাহবাগের ব্যাপারে জামায়াত তাই ভয়ংকর আগ্রাসী। শাহবাগ বেকায়দায় ফেলেছে বিএনপিকেও। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আবার যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনকারী, এই স্ববিরোধিতাকে বিএনপি এতকাল ভালোই সামাল দিয়ে আসছিল। আওয়ামী লীগেও রাজাকার আছে, তারাও জামায়াতের সঙ্গে এককালে সমঝোতা করেছে ইত্যাদি বলে পারস্পরিক দড়ি টানাটানি করে বেশ চলছিল তাদের। কিন্তু শাহবাগের অজানা এক পক্ষ থেকে হঠাৎ যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং জামায়াত উচ্ছেদের ডাক এলে তারা বেশ হকচকিত হয়ে পড়ে, কী প্রতিক্রিয়া জানাবে তা বুঝে উঠতে পারে না। পরিস্থিতির চাপে তাদের দ্বৈত অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। একপর্যায়ে তারা জামায়াতের পক্ষে গিয়েই দাঁড়ায় এবং শাহবাগের আন্দোলনকে ভেলকিবাজি হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে। যে আন্দোলন তাদের দ্বৈত অবস্থানের সুবিধা থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করেছে, যে আন্দোলনকে তাদের শত্রুপক্ষ আওয়ামী লীগের সমর্থন দিচ্ছে তার প্রতি বিএনপি স্বভাবতই ক্ষুব্ধ। শাহবাগের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ একটি বিশেষ বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠীও। তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে রাষ্ট্রপরিচয়ে ইসলামের গুরুত্ব নিয়ে নানা বুদ্ধিবৃত্তিক তর্ক করে আসছেন। সেই সূত্রে জামায়াতসহ বিভিন্ন ইসলামি দলের গণতান্ত্রিক অধিকারের ব্যাপারে তাঁরা সোচ্চার। শাহবাগ আন্দোলন এই বুদ্ধিজীবীদের সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন, নব্য রাজাকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। স্বভাবতই তাঁরাও শাহবাগ বিষয়ে খুবই বিরক্ত।

শাহবাগ বিষয়ে যাঁরা নিরাসক্ত এবং দ্বিধান্বিত, তাঁদের মধ্যে লক্ষ করি কয়েক ধরনের মানুষ। রাজনীতি বিষয়ে সর্বাঙ্গীণ অনাগ্রহী অনেক মানুষ এ ব্যাপারটাকে তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে তৈরি হওয়া হঠাৎ একটা আপদ হিসেবে দেখছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ দেখে অনেকে শুরুতে শাহবাগ বিষয়ে উৎসাহী হলেও পরে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন, অনেকে আছেন, যাঁরা ঠিক কোনো দলের পক্ষাবলম্বী না হলেও বরাবর বর্তমান সরকারের কঠোর সমালোচক। শাহবাগকে সমর্থন করলে তা পরোক্ষে সরকারের সমর্থনেও চলে যায় বলে এ বিষয়ে তাঁরা কোনো পক্ষ নেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠী আছে, যারা মানবাধিকারের একটা বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে মৃত্যুদণ্ডবিরোধী, ফলে তাঁরা শাহবাগের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবির পক্ষে নন। আরও ক্ষুদ্র একটা গোষ্ঠী পুরো ব্যাপারটাকে রাষ্ট্রের শক্তিশালী পক্ষগুলোর পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় হিসেবে দেখছে, ফলে রাষ্ট্র বিষয়ে নিরাসক্ত নৈরাজ্যবাদী দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে তারা পুরো শাহবাগ বিষয়ে নীরব থাকার পক্ষে। একটা অভিনব পরিস্থিতির জন্ম হওয়ায় নানাজন নিজের ভেতর ব্যাপারটার একটা মীমাংসা করার চেষ্টা করছেন, কেউ কেউ তাঁদের অবস্থান অদল-বদল করছেন। এই নিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে।

কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যারা সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছে, সেই জামায়াত একে মোকাবিলার জন্য আশ্রয় নিয়েছে প্রতারণার, নৃশংসতার। একটুও সময় ব্যয় না করে যুদ্ধাপরাধীর সুষ্ঠু বিচারের শাহবাগের আন্তরিক দাবির গায়ে তারা কৌশলে চড়িয়ে দিয়েছে ইসলামবিরোধিতা এবং নাস্তিকতার লেবাস। সেই অছিলায় ঘটিয়েছে হত্যা, ধ্বংস। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জামায়াতের এই প্রতারণার এবং নৃশংসতার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে বিএনপি। আর জামায়াতের সহিংসতার গণতান্ত্রিক বৈধতার তাত্ত্বিক যৌক্তিকতা দেওয়ার জন্য এগিয়ে এসেছেন কথিত একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী। শাহবাগের অনাস্থা শুধু জামায়াতের ব্যাপারে হলেও তাঁরা পরস্পর হাত ধরাধরি করে শাহবাগকে মোকাবিলা করছেন। তাঁদের এই ঐক্যের একটা প্রেক্ষাপট আছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে ইসলামকে রাষ্ট্র পরিচয়ের অংশ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল বিএনপি। পরবর্তী সরকারগুলোও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। ইতিমধ্যে উল্লিখিত বুদ্ধিজীবীরা তাত্ত্বিক তর্ক চালিয়ে গেছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনে কেন ইসলামকে স্বীকার করতে হবে এ নিয়ে। পাকিস্তান রক্ষায় ব্যর্থ হয়ে জামায়াতও বাংলাদেশের একটা ইসলামি পরিচয় তৈরির চেষ্টা চালিয়ে গেছে অব্যাহতভাবে, যদিও তা একটা বিশেষ ধরনের ইসলাম মাত্র। মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসন, যুক্তরাষ্ট্রের ইসলামবিরোধী অবস্থান, বিশ্বায়নের বিবিধ প্রভাবে ধীরে ধীরে বাংলাদেশে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের কাছে তাদের মুসলমান পরিচয়টা বড় হয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ক্রমেই মূলত বাঙালি মুসলমানের দেশ হিসেবে গড়ে ওঠার একটা সাম্প্রদায়িক প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই প্রক্রিয়ার উৎসাহী খেলোয়াড় জামায়াত, বিএনপি এবং কতিপয় বুদ্ধিজীবী। তাঁরা জানেন কালে কালে বাংলাদেশের নির্বাচনগুলোতে ‘ইসলাম’ একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠেছে। নৃশংসতা, প্রতারণা, গুজব ইত্যাদির মাধ্যমে শাহবাগ আন্দোলনকে ইসলামবিরোধী ঘোষণা দিয়ে পুরো লড়াইকে তাই তারা একটা সাম্প্রদায়িক লড়াই হিসেবে উপস্থিত করেছে। ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের ব্যাপারটার মীমাংসা হওয়ার কথা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়ই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু বহুদিনের, বহুজনের ভুলে সে প্রশ্নটির নিষ্পত্তি হয়নি। এখন মনে হচ্ছে অনেক মাশুল দিয়েই এর নিষ্পত্তি করতে হবে।

মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত কল্যাণ ও ন্যায়বোধের ওপর দাঁড়িয়ে আনুষ্ঠানিক সংগঠনবিহীন শাহবাগের আন্দোলনকারীদের পক্ষে তাদের কিছু বাম সমর্থকদের নিয়ে এই দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি করা দুরূহ। কারণ, তাদের প্রতিপক্ষ কুটিল, নির্মম এবং ঘোর সংগঠিত। এই দ্বন্দ্বের গতি নির্ভর করবে শাহবাগ আন্দোলনের সবচেয়ে শক্তিশালী সমর্থক আওয়ামী লীগের সরকারের ভূমিকার ওপর। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ অতীতে ক্ষমতার রাজনীতির প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপস করেছে। সেই সঙ্গে শাহবাগকে সমর্থন দিলেও রাষ্ট্রের পরিচালক হিসেবে শাহবাগ-উদ্ভূত অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে মানুষকে নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হয়নি। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ শুধু নৈতিকতার প্রশ্নে নয়, ভোটের রাজনীতি বিবেচনায় রেখে সাম্প্রদায়িকতার দ্বন্দ্ব মোকাবিলা করার চেষ্টা করবে। বলা বাহুল্য, এ দ্বন্দ্ব নিরসন এখন হয়ে পড়েছে আরও জটিল। কারণ, লড়াই এখন শুধু রাজপথে, মাঠে-ঘাটে নয়, সাইবার স্পেসে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। সেই বহুমুখী লড়াই মোকাবিলার প্রস্তুতি সরকারের আছে কি না, সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। ইতিহাসের পথপরিক্রমায় বিশেষ মুহূর্তে একটা জাতির কাছে একটা দ্বন্দ্ব মুখ্য হয়ে ওঠে। দেখা যাচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার দ্বন্দ্বটা মুখ্য হয়ে উঠেছে এ মুহূর্তের বাংলাদেশে। এই দ্বন্দ্ব নিষ্পত্তি না করে আর এগোনোর উপায় আছে বলে মনে হয় না।

শাহবাগ আন্দোলনকারীদের অবিরাম অহিংস আন্দোলনের আহ্বান সত্ত্বেও প্রতিপক্ষের হিংস্রতা দেখে স্পেনের মাতাদোর মঞ্চের ষাঁড়ের লড়াইয়ের কথা মনে পড়ে। মাতাদোর মঞ্চে যে মানুষটা ষাঁড়ের সঙ্গে লড়াই করে, তার জন্য রয়েছে গোটা পঞ্চাশেক নিয়ম। কিন্তু বলা বাহুল্য, ষাঁড়ের জন্য একটা নিয়মও নেই। এলোপাতাড়ি যেকোনো পথে ষাঁড় তার নিয়মতান্ত্রিক প্রতিপক্ষ মাতাদোরকে ঘায়েল করতে পারে। এমনকি দেয়াল ডিঙিয়ে রক্তাক্ত করে দিতে পারে গ্যালারিতে নিরাপদে বসে থাকা দর্শকদেরও। এ সময়টা বিপজ্জনক, না সম্ভাবনাময়, সেটা নির্ভর করবে আমরা কাকে বিপদ আর কাকে সম্ভাবনা ভাবছি। যাঁরা মনে করবেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার মুক্তিযুদ্ধের সেই অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতি সমাপ্ত করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, এখন তাহলে সোচ্চার হতে হবে তাঁদের প্রত্যেককেই। নিরাপদ দর্শক হয়ে থাকার কোনো উপায় নেই। কারণ সাম্প্রদায়িকতা রক্তাক্ত করতে পারে যে কাউকেই।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
প্রথম আলো | তারিখ: ১৮-০৩-২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন