বৃহস্পতিবার, ২১ মার্চ, ২০১৩

জঙ্গিপনা রাজনৈতিক অধিকার হতে পারে না

হারুন হাবীব
অনেক সীমাবদ্ধতা ও অনিশ্চয়তার পরও বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। এ অগ্রসরতা আশাপ্রদ না হলেও ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে এক ধরনের এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নানা সূচকেও অগ্রগতির এ ধারা উচ্চারিত হয়েছে_ এমনকি খ্যাতিমান বিশ্ব সংস্থাগুলোর কাছেও।
কিন্তু প্রায় অকস্মাৎই যেন সবকিছু ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। রাজনীতির সহিংস বিস্ফোরণে সবকিছু মুখ থুবড়ে পড়ছে, দেশ যেন পুড়ে ছারখার হচ্ছে! একটা দানব যেন বাংলাদেশের মাথায় হাতুড়ি মারছে!
স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে_ এই সহিংসতা, নৈরাজ্য ও দুঃখজনক হত্যাকাণ্ড কেন? কে লাভবান হচ্ছে এতে? রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে কেউ কেউ নিশ্চয়ই পরস্পরবিরোধী যুক্তি উপস্থাপন করবেন। কেউ বিরোধীদলীয় রাজনীতিকে দায়ী করবেন, কেউবা সরকারকে।
কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিশ্চিতভাবেই বিশ্বাস করেন, চলতি সহিংসতার মূল কারণ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে যেতে সরকারকে বাধ্য করা; দেশে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা, যাতে সরকার অকার্যকর হয়ে পড়ে, পতন ঘটে এবং এ বিচারটি বন্ধ হয়।
প্রথমেই বলে রাখি, মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধীদের বিচারের প্রশ্নটি চলমান সহিংসতার কারণ হওয়া সত্ত্বেও এ বিচারকর্মটি সম্পন্ন করা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নৈতিক ও ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা। এ থেকে সরে যাওয়ার সুযোগ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নেই। এ বিচার হবে কি হবে না_ তা নিয়ে দলীয় আলোচনা হতে পারে না। কিন্তু অন্যান্য রাজনৈতিক বিষয়_ বিতণ্ডা নিয়ে দুটি বড় দলের মধ্যে অবশ্যই আলোচনা হতে পারে এবং হওয়া উচিত ।
সকলেই জানেন, কোনো জঙ্গিপনাই রাজনৈতিক কর্মসূচি বা গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না। নানা ইস্যুতে প্রতিবাদ, হরতাল বা বিক্ষোভ রাজনৈতিক অধিকার। কিন্তু যে পদ্ধতিতে সাম্প্রতিককালে হরতাল কার্যকর করা হচ্ছে, তাতে সমাজ শিহরিত হচ্ছে। এমন রাজনৈতিক অধিকারের কোনো নৈতিক ভিত্তি থাকতে পারে না। সাম্প্রতিক সহিংসতায় কয়েক হাজার গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। এ গাড়িগুলো কার? এ গাড়িগুলোর সঙ্গে রাজনীতির কী সম্পর্ক?
ইদানীং আরও দেখা যাচ্ছে, 'ককটেল' বা হাতে বানানো বোমা হরতালগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বলাই বাহুল্য, এসব সংঘাত-সংঘর্ষের হরতাল দেশের মানুষ গ্রহণ করছে না। তারা হয়তো জানমালের নিরাপত্তার চিন্তা থেকে যানবাহন, দোকানপাট বন্ধ রাখছেন। কেউ কেউ আবার ঝুঁকি নিয়ে খুলেও রাখছেন। জীবনের ঝুঁকির মধ্যেই মানুষকে দৈনন্দিন কাজে বের হতে হচ্ছে। ইতিমধ্যেই আহত, নিহত হয়েছেন অসংখ্য সাধারণ মানুষ। বলাই বাহুল্য, রাজনীতির নামে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিঘি্নত হয় এমন কোনো কর্মকাণ্ডই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।
মানবতাবিরোধী অপরাধের চলমান বিচার বানচালের দাবিতে জামায়াত-শিবির সারাদেশে নজিরবিহীন নাশকতা, তাণ্ডব চালিয়েছে। একদিকে তারা আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে আসামিদের পূর্ণ আইনি সহায়তা দিচ্ছে, রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করছে; অন্যদিকে নজিরবিহীন সহিংসতার পথ বেছে নিয়েছে। তারা পুলিশকে টার্গেট করছে, থানা-পুলিশ ফাঁড়ি, রেলস্টেশন, সরকারি অফিস, বিদ্যুৎকেন্দ্র, বাস-ট্রেনে হামলা-ভাংচুর-অগি্নসংযোগ করছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, উপাসনালয়ে হামলা-ভাংচুর-অগি্নসংযোগ চালাচ্ছে, সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিঘি্নত করছে! এসব কর্মকাণ্ড এতটাই চূড়ান্ত ও অপরিণামদর্শী দৃষ্টান্ত যে, একে কোনো মানদণ্ডেই সংবিধানসিদ্ধ বা গণতান্ত্রিক অধিকার বলার সুযোগ নেই।
দূর্ভাগ্য আরও আছে। শিবগঞ্জে অবস্থিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সদর দফতরে জামায়াত-শিবিরের ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর থেকে দুই সপ্তাহ ধরে সেখানকার প্রায় ১০টি ইউনিয়ন বিদ্যুৎহীন। ভুতুড়ে অবস্থা বিরাজ করছে সেখানে। আরও বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, ওই এলাকার ৮শ' হেক্টর বোরো জমিতে সেচকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে এলাকার বোরো ধানের ফলন। যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষ একদিন বিদ্যুতের জন্য জীবন দিয়েছেন, আজ তারা নিজেরাই বিদ্যুৎহীন। যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পোড়ানো হয়েছে তার আওতায় রয়েছে ১৫০টি গভীর নলকূপের অধীনে এক হাজার দুইশ' হেক্টর জমিতে এক হাজার ৪৯৯টি অগভীর নলকূপের মাধ্যমে তিন হাজার ৮ হেক্টর জমির বোরো চাষ। বোরো জমির সিংহভাগের সেচ বন্ধ রয়েছে। ক্ষেত হলদে বর্ণ ধারণ করেছে। সেই সঙ্গে বিবর্ণ হয়ে পড়ছে কৃষকের স্বপ্ন, কৃষকের ভবিষ্যৎ।
যে কোনো জাতীয় সংকটে দেশের সুস্থ ধারার রাজনীতিবিদরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন, সমাধান বের করেন। এটিই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতিবিদদের দায়িত্ববোধ। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক সংকটের অবসানে সংলাপের দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া। আলোচনার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে অনিবার্য রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পথে চলেছে দেশ। ক্রমশ ঘোলাটে হচ্ছে রাজনৈতিক ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। সংঘাতময় এ রাজনীতি একদিকে যেমন জনমনে ভীতির সঞ্চার করেছে, অন্যদিকে ক্রমেই স্থ্থবির হয়ে পড়ছে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, লাগাতার হরতাল আর সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়েই সামনের দিকে এগোবে বিরোধী দল। হয়তো আরও কিছু প্রাণ বলি হবে। এর পরও পেছনে ফিরবে না তারা। খালেদা জিয়া নিজেই তার বক্তব্যে বিষয়টা স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, এ সরকারের পতনের আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। হয়তো এ জন্য আরও কিছু প্রাণহানি হবে, জানমালের ক্ষতি হবে। কিন্তু এটুকু ক্ষতি মেনে নিতে হবে। এ ধরনের অবিবেচনাপ্রসূত বক্তব্য কোনো সুস্থ মানুষ গ্রহণ করতে পারে কি-না তা ভেবে দেখার বিষয়।
অস্বীকার করার উপায় নেই, জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত। এ সত্য ইতিহাসের। বিশ্বের নানা প্রান্তেই এ রকম দল-গোষ্ঠীকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেমন আমেরিকার কে.কে.কে. দল, যারা কেবল তাদেরকেই অর্থাৎ সাদা জনগোষ্ঠীকেই এক সময় মানুষ বলে বিবেচনা করত। জার্মানির নাৎসি, যারা কেবল নিজেদেরই সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করত। এই উগ্রবাদিতা বা শ্রেষ্ঠত্ব মানসিকতার মাশুল দিতে হয়েছে বহু নিরপরাধ মানুষকে। জনজীবনের শান্তি, নিরাপত্তার প্রতি হুমকির কথা বিবেচনায় এনে সে কারণেই এদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিগত ২০ বছরে একমাত্র ইউরোপেই কমপক্ষে ১০টি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে মানুষে মানুষে ঘৃণা ও সহিংসতার অভিযোগে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে।
বলাই বাহুল্য, বর্তমান পরিস্থিতি উদ্বেগের, আতঙ্কের। দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আজ নিদারুণ অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে। ১৯৭১-এর পর তাদের এ ধরনের সহিংসতার মুখোমুখি আর কখনোই হতে হয়নি। তাদের ঘরবাড়ি, উপাসনালয় ভাংচুর করা হয়েছে। আরও উদ্বেগের ব্যাপার হলো, যারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবে, সেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও আজ আক্রান্ত। খুলনায় পুলিশকে আক্রমণ করে, পুলিশ হত্যা করে আসামি ছিনতাই করে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। এর আগেও জামায়াত-শিবির কর্তৃক পুলিশ আক্রমণ ও পুলিশ সদস্য হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। দেশের পুলিশ বাহিনীতে সদস্য সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। অর্থাৎ জননিরাপত্তার কাজে পুলিশ সদস্যের অপ্রতুলতা রয়েছে। আর চলমান সহিংসতা এতটাই পরিকল্পিত যে, পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের অবসান হওয়া জরুরি। শান্তিপূর্ণভাবে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া জরুরি। দুই পক্ষকেই আলোচনার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। মোটকথা, বর্তমান পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করতে হলে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতান্ত্রিক আচরণ করতে হবে। বিরোধী দল বর্তমানে দুটি এজেন্ডা নিয়ে আন্দোলন করছে। বিএনপি বলছে, তাদের আন্দোলন নির্বাচনকালীন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ের। কিন্তু জামায়াত আন্দোলন করছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের লক্ষ্যে। তাদের আন্দোলন জোটভুক্ত এবং সঙ্গত কারণেই যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে আলোচনার ক্ষেত্র কীভাবে তৈরি হবে? তবে বৃহৎ দুটি দল_ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যদি নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে বলে মনে করার কারণ আছে।
খালেদা জিয়া দু'বারের প্রধানমন্ত্রী। যে পরিস্থিতি বা যে সময়েই হোক না কেন, তিনি দেশ শাসন করেছেন। তার মুখে যখন শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের যুব তারুণ্যকে আক্রমণ করতে দেখি, তখন সত্যি সত্যি করুণা হয়। তিনি একাত্তরের চেতনাধারী এই নবতারুণ্যকে একদিকে 'নাস্তিক' বলেছেন, অন্যদিকে বলেছেন এরা 'নষ্ট'। এসব কোন উপলব্ধি? স্বাধীনতাবিরোধী কিছু রাজনৈতিক মোল্লা যে ভাষায় গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের গালাগাল করেন, খালেদা জিয়াও তার পুনরাবৃত্তি করেছেন। আমরা জানি না, কে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে বলেছেন_ গণজাগরণ মঞ্চের তরুণ-তরুণীরা ধর্মে বিশ্বাস করে না? ভাবতে অবাক লাগে।

হারুন হাবীব : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও সাংবাদিক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন