বৃহস্পতিবার, ২১ মার্চ, ২০১৩

জামায়াত । ওরা নিজ পরিবারে জঙ্গি বানায় না

মমতাজ লতিফ
এটি আশ্চর্য হলেও সত্য যে, জামায়াতের কোন নেতা, এমনকি গোলাম আযম, নিজামী, সাঈদী, মুজাহিদদের সন্তানরা জামায়াত বা শিবিরের কর্মী হয়ে কাজ করেননি! জামায়াত নেতারা খুবই সতর্কভাবে সন্তানদের তাদের তৈরি ধর্মান্ধ, জঙ্গি-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য ঘৃণিত এবং কুখ্যাত জামায়াত-শিবিরের প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখে নিজেরা '৭১-এর লুট, দখল এবং '৭৫-পরবর্তী রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে ওঠেন এবং সন্তানদের পাশ্চাত্য উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন, যাদের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সরাসরি সংযোগ নেই, দু'একজন মুসলিম নামধারী সেবামূলক এনজিওর কাজে সম্পৃক্ত।
এ থেকে একটা সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, '৭১-এর মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীরা হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণকারী ও লুণ্ঠনকারীরা নিজেদের অপরাধ সম্পর্কে আসলে খুবই সচেতন রয়েছে এবং পরিকল্পিতভাবে নিজেদের সন্তানদের এসব অপরাধের অপরাধী কলঙ্কিত জামায়াত-শিবির দলে সম্পৃক্ত হতে দেয়নি। একই সঙ্গে তাদের নিজেদের সন্তানদের জঙ্গি-সন্ত্রাসী হয়ে একটি জঙ্গির চরম অনিশ্চয়তায় পূর্ণ, গ্রেফতার, জেলজীবন ও পদে পদে মৃত্যুর আশঙ্কায় থাকা অস্থিতিশীল জীবন থেকে অনেক দূরে উচ্চশিক্ষিতের নিশ্চিত নিরাপদ শান্তিপূর্ণ জীবনে স্থিত করতেই চেয়েছে! কিন্তু তাই বলে তারা তাদের জঙ্গি, রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসী সংগঠনের রাষ্ট্র-গণতন্ত্রবিরোধী কার্যক্রম বন্ধ করেনি, বরং এ সন্ত্রাসী সংগঠন পরিচালনার জন্য টার্গেট করেছে প্রথমত মাদ্রাসার দরিদ্রের সন্তানদের! সাধারণত মাদ্রাসায় পড়তে যায় সমাজের নিম্নবিত্তের মানুষের সন্তানরা এবং এই একটি কারণে জামায়াত মাদ্রাসা ও মসজিদের সংখ্যা বাড়িয়েছে, যাতে মাদ্রাসার দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বৃত্তি, বিভিন্ন পরিমাণের আর্থিক সহায়তা এবং বিনা খরচে খাদ্য, থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে তাদের থেকে জামায়াত-শিবিরের কর্মী সংগ্রহ করেছে। খেয়াল করলে দেখা যায়, ওসামা বিন লাদেনেরও কোনো সন্তান কিন্তু আল কায়দার সদস্য হয়নি! তার পূর্ণবয়স্ক সন্তানরা স্বাধীন, স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে! এমনকি পাকিস্তানের জামায়াতের জন্মদাতা মওদুদী যে তার সৃষ্ট সহিংস ইসলামী দলের সাহায্যে পাকিস্তানে আহমদিয়া অনুসারীদের ওপর হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করার অপরাধে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল, সৌদি বাদশাহর অনুরোধে পাকিস্তান সরকার যার দণ্ড মওকুফ করে, সেই মওদুদীর ছেলের বক্তব্য অনুসারে জানা যায় যে, তাদের বাবা জামায়াত থেকে দূরে থাকতে পরামর্শ ও নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ ছেলে প্রয়োজনে জামায়াতের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাংলাদেশেও আসতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন!
আশ্চর্য এই যে, মাদ্রাসা ছাত্রদের পরিবর্তে গত ১০ বছর ধরে জামায়াত ধনী ও উচ্চবিত্তের সন্তানদের জামায়াতের শাখা 'হিযবুত তাহ্রীরে'র অনুসারী সদস্য তৈরি করছে, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা অনুষদের শিক্ষক-ছাত্র, বুয়েটের শিক্ষক-ছাত্র এবং প্রাইভেট নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র বা সমাজের ধনী, উচ্চবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত! এদের মধ্যে অধিকাংশ আবার ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের 'ও' এবং 'এ' লেভেল পাস করা। প্রশ্ন উঠেছে_ কেন এই উচ্চবিত্ত, ধনীর ছেলেরা জামায়াত-শিবিরের অযৌক্তিক জঙ্গি নির্দেশগুলো মেনে নিচ্ছে, যা তাদের হত্যার মতো চরম অপরাধমূলক জীবন ধ্বংসকারী কাজের দিকে পরিচালনা করছে? তাদের মধ্যে কি নিজস্ব ভালো-মন্দ, বিচারবোধ, যুক্তিবোধ, মানবিকতা, হত্যার মতো অপরাধকে ঘৃণ্য এবং নিজের ভবিষ্যৎ ধ্বংসকারী কাজ বলে উপলব্ধি করার ক্ষমতা জন্মায়নি? এদের পরিবারের বাবা-মার ধন-সম্পদ উপার্জনে কি ন্যায়নীতিবোধ পরিত্যাজ্য হতে দেখেছে এ সন্তানরা? তারা মুক্তিযুদ্ধ কেন, কীভাবে সংঘটিত হয়েছিল, তা জানে না? তারা কি জানে না মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর দোসর হয়ে বাঙালি গোলাম আযমের নেতৃত্বে নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী, আমিনী, সাকা চৌধুরী, কাদের মোল্লার যুদ্ধাপরাধী দল কত হাজার হাজার বাঙালি নারী-পুরুষ ও শিশু হত্যা করেছে? কত শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গায়ক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, প্রশাসক, পুলিশ, সেনাসদস্য, বিডিআর, তরুণ গেরিলা যোদ্ধা ও ছাত্র এদের লেলিয়ে দেওয়া আলবদর-আলশামসের খুনিদের হাতে নিহত হয়েছিলেন? সেই কুখ্যাত বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী আলবদর নেতা চৌধুরী মইনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের নাম ও হত্যায় তাদের ভূমিকা কি জানে না তারা? তারা কি একজন শহীদের সন্তানেরও দেখা পায়নি? তারা কি অন্তত 'গেরিলা' বা 'আমার বন্ধু রাশেদ' বা 'একাত্তরের যিশু' সিনেমা ক'টির একটিও দেখেনি? তারা কি বাংলা একাডেমীর বইমেলায় কখনও আসেনি? কখনও শহীদ মিনারে ফুল দিতে নগ্নপদে প্রভাতফেরি করেনি? তারা কি বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত শহীদদের স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের স্মৃতিগুলো যা 'স্মৃতি ৭১' নামে ১৮ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল, তার একটিও পড়েনি? তারা কি শহীদ জননী শহীদ রুমীর মা জাহানারা ইমামের 'একাত্তরের দিনগুলি' পড়েনি? কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে কখনও কি এরা দেখেনি? বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কি শোনেনি তারা? এরা কি কখনও মাতৃভাষা, মাতৃভূমির উন্নয়নে কৃষক-শ্রমিক কী অবদান রাখছে, তার ওপর কখনও কি কোনো রচনা লিখেছে?
হায়! এরা মানবিক মূল্যবোধহীন, দেশপ্রেমহীন, বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা-আদর্শহীন, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অজ্ঞ, প্রযুক্তির এ যুগে যুক্তিবোধহীন, অন্ধ, বোবা, অনুভূতিহীন একদল দানব হয়ে উঠেছে, যারা ধর্ম বলতে 'জিহাদ' বুঝেছে, দায়িত্ব বলতে জামায়াত-শিবিরের খুনিদের নির্দেশ যা 'খুনের নির্দেশ'কে বুঝেছে! মানবসম্পদের এ অপচয়ের পরিণাম সীমাহীন, ভয়ঙ্কর।
আমি ইংরেজিমাধ্যমের স্কুলগুলোকে বলতে চাই, আপনারা অনেক স্কুল নয়, 'কওমি মাদ্রাসা' পরিচালনা করছেন না তো, যেখানে তৈরি হচ্ছে স্বজাতির ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ, সামাজিক-মানবিক-দায়িত্বজ্ঞানহীন, নৈতিকতার বোধহীন, যুক্তিবোধহীন, সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম, বোবা, অন্ধ, দেশপ্রেমহীন এমনকি নিজের মঙ্গল সম্পর্কে অচেতন একটি গোষ্ঠী, যারা পাস করে বেরিয়ে এসে না নিজেদের, না জাতির কোনো মঙ্গল বা কল্যাণ করবে! এরা তো আমাদের সন্তান, এদের জড়, মূক, অন্ধ করে রাখা যাবে না, এতে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হবে। ওদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নিয়ে যান, মুক্তির গান, গেরিলা, আমার বন্ধু রাশেদ, একাত্তরের যিশু ইত্যাদি চলচ্চিত্র দেখান, মুক্তিযুদ্ধের গল্প পাঠ্য করে তা ক্লাসে পাঠ করান, নাটক করান, শহীদ রুমী, আজাদের গল্প বলুন, বইগুলো পড়তে দিন, শহীদ মিনারে নিয়ে যান, রাজাকার, আলবদর, জামায়াতের বাংলাদেশ রাষ্ট্র ধ্বংসের সব অপতৎপরতা জানান, মানবতাবিরোধী অপরাধ সম্পর্কে জানান। মূল কথা, শিশু-কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেমিক, দায়িত্বশীল মানবিক মানুষ হয়ে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে।
বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বা অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জামায়াতপন্থি শিক্ষকদের বলব_ ছাত্রদের দেশপ্রেমহীন, জঙ্গি-জিহাদি, বিজ্ঞান-যুক্তিবিমুখ, অন্ধ, বধির মানুষে পরিণত করছেন অথচ নিশ্চয়ই আপনাদের সন্তানদের আমেরিকা অথবা অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণে পাঠিয়ে দিয়েছেন! মওদুদীর মতোই অন্যের সন্তানদের জঙ্গির নিরাপত্তাহীন জীবনে ঠেলে দিচ্ছেন আর নিজেদের সন্তানদের উচ্চ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত উন্নত আয়ের নিরাপদ পেশায় প্রবেশে সব রকম উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। শিক্ষকের এরকম দ্বিচারিতার নাম কী? ধর্মে এই শ্রেণীকে কী নামে নামকরণ করে, এই দ্বিচারিতার শাস্তি কী_ তা আপনারা ভালো জানেন। পার্থিব জীবনে পরের সন্তানদের খুনি-জঙ্গি বানানোর অপরাধে বিচার যে কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিক আদালতের কাছে কিন্তু চাইতে পারে এবং এসব দ্বিচারী তাণ্ডব সৃষ্টিকারী তরুণের জন্মদাতাদের পরিচয় উদ্ঘাটন করা প্রয়োজন। জামায়াত মেড ইন পাকিস্তান, মেড বাই পাকিস্তান এবং মেড ফর পাকিস্তান, পাকিস্তানের জন্য আপনাদের যত দরদ থাকুক, বাংলাদেশের অর্থে জীবিকা নির্বাহ করে এ দেশ ধ্বংসের কাজ করা চলবে না।

মমতাজ লতিফ : শিক্ষক, গবেষক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন