শনিবার, ৩০ মার্চ, ২০১৩

কাদের মোল্লার মামলার সাক্ষীর ওপর হামলা | সুরক্ষা চেয়ে সাক্ষী ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে

প্রথম আলো | রোজিনা ইসলাম | তারিখ: ৩০-০৩-২০১৩
দুই হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কক্ষে কক্ষে ঘুরছেন এক ব্যক্তি। মুখে একটাই বুলি, ‘আমার দোষ, আমি মুক্তিযোদ্ধা, আমি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। না হলে নিরাপত্তার জন্য কেন আমাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসে ঘুরতে হবে? কেন ভয়ে দিন কাটাতে হবে?’
তিনি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহমেদ খান। তিনি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ঢাকা জেলা ইউনিট কমান্ডের আহ্বায়কও।

মোজাফফর আহমেদ খান গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসেছিলেন নিজের নিরাপত্তা চাইতে। এর আগেও তিনি অসংখ্যবার সচিবালয়ে এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী, আইন প্রতিমন্ত্রীসহ অনেক মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে নিরাপত্তার আবেদন জানিয়েছেন। নিরাপত্তা চেয়ে গত ছয় মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ২৫টির বেশি চিঠি দিয়েছেন তিনি। তিনি বারবার জানিয়েছেন, তাঁকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, তাঁর পরিবারকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে খুদে বার্তা পাঠানো হচ্ছে। শেষমেশ ৫ মার্চ কেরানীগঞ্জের নিজ বাড়িতে ফেরার সময় তাঁর ওপর বোমা হামলা করা হয়। তাতে তাঁর দুই হাত পুড়ে যায়। এ কারণেই দুই হাতে ব্যান্ডেজ।
সাক্ষী মোজাফফর আহমেদ খান বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার পর থেকেই আমি নিরাপত্তা চেয়ে আসছি। আমাকে যাঁরা হুমকি দিচ্ছেন, হুমকি দিয়ে খুদে বার্তা পাঠাচ্ছেন তাঁদের চিহ্নিত করার দাবি জানিয়ে আসছি।’ তিনি বলেন, ‘র‌্যাবের মহাপরিচালকের সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি আমাকে তিন ঘণ্টা বসিয়ে রেখে গোয়েন্দা শাখার পরিচালকের কাছে পাঠিয়েছেন। এর পর থেকে আমি তাঁকে যত দিন ফোন করেছি তিনি কোনো দিনও ফোন ধরেননি। পুলিশের মহাপরিদর্শককে জানিয়েছি। তিনি কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সঙ্গে কথা বলতে বলেছেন। ওসির কাছে গিয়ে হুমকিদাতাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে চেয়েছি। তিনি টাকা চান।’
রাষ্ট্রপক্ষের এই সাক্ষী বলেন, ‘৫ মার্চ যখন আমার ওপর বোমা ছোড়া হলো, আমি সঙ্গে সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েছিলাম। তিনি থানায় জিডি করার উপদেশ দিয়েছেন। আমি সন্দেহভাজন ব্যক্তির নামও সরকারকে জানিয়েছি, কিন্তু তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। ঘুরতে ঘুরতে আমি দিশেহারা।’
মোজাফফর আহমেদ খান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেওয়া চিঠিতে বলেন, ‘আমিই বাদী হয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধী ইসলামী ছাত্র সংঘের শহীদুল্লাহ হলের নেতা কাদের মোল্লাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করি। ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিই।’ স্থানীয় রাজাকার ফয়েজের আত্মীয় ইমাম হোসেন দুটি নম্বর থেকে তাঁকে খুদে বার্তা পাঠিয়ে হুমকি দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
কেন রাষ্ট্রপক্ষের এই সাক্ষীর নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে না, জানতে চাইলে কেরানীগঞ্জ থানার ওসি মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন খান বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে রাগান্বিত হয়ে বলেন, ‘কীভাবে তাঁকে সহায়তা করব? তাঁকে কি আর্থিক সহায়তা করব? এক মুখে শুনলে অনেক কিছুই ভালো শোনা যায়।’ মোজাফফর আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ওসি বলেন, ‘তিনি মিথ্যা কথা বলেন, সব বিশ্বাস করবেন না, এলাকায় এসে খোঁজ নেন।’
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার সাক্ষীদের নিরাপত্তা জোরদার করতে মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থা থেকেও কয়েক দফা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এর আগে মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার সাক্ষী নাজিম উদ্দিন খাত্তাবসহ অনেককে ভয়ভীতি দেখানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ-সংক্রান্ত তদারকি সেলের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাইন উদ্দিন খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, সাক্ষীদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেউ দায়িত্বে অবহেলা করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মোজাফফর আহমেদ খানের নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, পুলিশ কমিশনারকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে, যাতে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং আগামী ১০ দিনের মধ্যে মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি অবহিত করা হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন