শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০১৩

ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং সহিংসতা যৌক্তিকতা ও করণীয়

সুলতান মাহমুদ রানা
বাংলাদেশে বহুদলীয় দলব্যবস্থার রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বহুদিন থেকেই। সম্প্রতি রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ঘোলাটে ও ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টির পেছনে ধর্মভিত্তিক দল হিসেবে পরিচিত জামায়াতে ইসলামীর সহিংস কর্মকা-কে অনেকাংশেই দায়ী করা যায়। যুদ্ধাপরাধসহ নানারকম মানবতাবিরোধী কর্মকা-ের প্রেক্ষাপটে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা না করার প্রশ্নটি বর্তমানে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক প্রশ্নে পরিণত হয়েছে। তবে এটা যেহেতু রাজনৈতিক প্রশ্ন, সেকারণে এর সমাধানও রাজনৈতিকভাবে হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
সাম্প্রতিককালে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে সংঘটিত তা-ব ও সহিংসতা নিয়ে দেশবাসী গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। জামায়াতে ইসলামী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল হলেও তাদের আদর্শ মানেই ইসলাম নয় অথবা অন্য ইসলামী দলগুলোও একমাত্র ইসলামের অনুসারী নয়। অর্থাৎ রাজনৈতিক ইসলামই মুসলিম সমাজ নয়। আমরা ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করেছি যে, দেশের বিভিন্ন পর্যায় থেকেই জোরালোভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তথা জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। বিশেষ করে গণজাগরণ মঞ্চের দাবি অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামী কিংবা অন্য যেকোন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কর্মকা- বা দলকে নিষিদ্ধ করা হলে রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতি-প্রকৃতি ও প্রেক্ষাপট বিবেচনার নিমিত্তেই আমার এ নিবন্ধ রচনার ক্ষুদ্র প্রয়াস।

রাজনীতিতে নির্বাচন-পূর্ব ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে ভোট প্রদানে নাগরিকদের চেতনাকে ভিন্নভাবে ব্যবহারের নজির অনেক। বদিউল আলম মজুমদারের 'দিনবদল, গণতান্ত্রিক শাসন ও সম্ভাবনার বাংলাদেশ' নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে, সাঈদী (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ কর্তৃক রায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি) ও তার সহযোগীরা ধর্মীয় বিষয়ে অপপ্রচার চালান। যেমন- কাফেরকে ভোট দেবেন না, কাফেরকে ভোট দিলে জানাজা হবে না, আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে জান্নাতবাসী হবেন না, কাফেরকে ভোট দিলে গুনাহ হবে, আমাকে (সাঈদী) ভোট দিলে আল্লাহকে ভোট দেয়া হবে, আমাকে (সাঈদী) ভোট দিলে বেহেস্তে যেতে পারবেন, আমাকে (সাঈদী) ভোট দিলে বেহেস্তের টিকেট দেব। সাঈদী নিজে এগুলোতে সরাসরি জড়িত না থাকলেও তার কর্মী বাহিনী এসব অপপ্রচারে অনুপ্রাণিত হয়ে ধর্মানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। উল্লেখ্য, সাঈদীর মৃত্যুদ-ের রায়ের পর গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অপপ্রচার চালানো হয় যে, চাঁদে তার (সাঈদী) চেহারা দেখা গেছে। এমনকি কয়েক জায়গায় মসজিদের মাইকে প্রচার করে বলা হয়- চাঁদে সাঈদীর মুখ দেখা গেছে। তাকে রক্ষা করা আমাদের ইমানি ও জিহাদি দায়িত্ব। মাইকের এ আহ্বান শুনে হাজার হাজার সহজ-সরল মানুষ রাস্তায় নেমে এসে ভাঙচুর ও তা-ব শুরু করে। এতে পুলিশের গুলিতে ১১ জনের প্রাণহানি ঘটে। এমতাবস্থায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং সংকট উত্তরণের পথে বাধা ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কিছু বলা যেতে পারে।

একাত্তর পরবর্তী সময়ে গত কয়েকদিনে জামায়াত-শিবিরের যে ধ্বসাংত্মক তা-বলীলা আমরা দেখেছি যা ইতিহাসের জঘন্যতম ধ্বংসাত্মক কর্মকা-কেও ছাড়িয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে এমন ধ্বংসলীলায় লিপ্ত রাজনৈতিক দলের নিষিদ্ধের দাবি ওঠাই অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত বললে খুব বেশি ভুল হবে না বলে আমার মনে হয়। শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর থেকে ইতিমধ্যেই এমন দাবির সঙ্গে অনেক রাজনীতিবিদসহ সুধীসমাজও একাত্মতাও ঘোষণা করেছেন। এমনকি নির্বাচন কমিশন জামায়াত বা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর নিষিদ্ধের উদ্যোগ গ্রহণ করলে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সহায়তা করা হবে বলেও বিভিন্নভাবে সরকারের প্রভাবশালী মহল বারবার উচ্চারণ করেছেন। তবে জামায়াত যেহেতু রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনপ্রাপ্ত হয়ে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে ঠিক তেমনিভাবে এর নিষিদ্ধের দাবিটাও রাজনৈতিকভাবে সমাধান হওয়াটাই জরুরি। প্রসঙ্গত উল্লেখ না করলেই নয় যে, ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বর্তমানে নিষিদ্ধ নয়।

বাংলাদেশে এ ধরনের দলকে নিষিদ্ধ বা তাদের কর্মকা-ের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ কতটুকু যৌক্তিক হবে সেদিকটাও খুব গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। এসব রাজনৈতিকদল নিষিদ্ধ হলে দলীয় সব অনুসারী যারা সাধারণত পরকালের জন্য রাজনীতি করেন, তারা উগ্রবাদের দিকে ধাবিত হবে কিনা সেটাও ভেবে দেখা দরকার। ইতোপূর্বে নিষিদ্ধকৃত ধর্মভিত্তিক সংগঠন হিজবুত তাহরির, জামায়াতে মুজাহিদিন বাংলাদেশ প্রভৃতি থেকে এর বাস্তবতা সহজেই অনুমেয়। এসব সংগঠন আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠন হিসেবে নানাবিধ সহিংসমূলক কর্মকা- চালাতে দ্বিধা করে না। সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ২৫ মে ১৯৭৯ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামী প্রায় ৩০ বছরের অধিক সময় ধরে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার রাজনীতিতে ও সংসদীয় গণতন্ত্রেও যুক্ত। শুধু ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচন ছাড়া সব সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। এমনকি প্রতিটি সংসদে আসনও পেয়েছে। তবে বিগত নবম সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের ব্যাপক ভোট বিপর্যয় ঘটেছে বলা যায়। ওই নির্বাচনে ৩৯ আসনের বিপরীতে ভোট পেয়েছিল ৩২,০৯২২৬। বাকি আসনগুলোতে জামায়াতের সমর্থনের ভোটগুলো অন্য কেউ পেয়ে থাকতে পারে। ৩৯ আসনের হিসাবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৪.২৯% ভোট জামায়াত পেয়েছিল। তবে ১৯৮৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নির্বাচনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামী তাদের আসনের পক্ষে যে ভোট পেয়েছে তার গড় ৯ শতাংশের কাছাকাছি (প্রথম আলো, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩)। বর্তমান সরকার জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করবে কি করবে না সেটা পরিষ্কার নয়। তবে জামায়াতের যে ভোটব্যাংক আছে তা ভোটার তালিকা থেকে কোনভাবেই বাদ দেয়া সম্ভব নয়। জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে তাদের ভোটব্যাংকের ভোট কোন বাক্সে যাবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। কমপক্ষে ৪-৫ শতাংশ ভোটারের ভোট যে পাল্লায় যাবে সে পাল্লা নিঃসন্দেহে ভারী হবে এ কথা সবাই স্বীকার করবে। এছাড়াও এ দলটি পুনরায় নাম পরিবর্তন করে আরেকটি দল গঠন করে দেশের রাজনীতিতে অবস্থান গ্রহণেরও সম্ভাবনা রয়েছে। এতে দেশে বিদ্যমান সহিংসতা লাঘব হওয়ার সম্ভাবনাও খুব ক্ষীণ। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আনতে জামায়াত-শিবিরের দলীয় আদর্শ ও ঐক্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে তাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণের কৌশল গ্রহণই বাঞ্ছনীয় বলে আমার কাছে মনে হয়।

দ্রুত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে মহাজোট নেত্রী (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) ও ১৮দলীয় জোট নেত্রী (বিরোধীদলীয় নেত্রী) উভয়কেই সজাগ ও সচেতনভাবে এগিয়ে আসার বিকল্প নেই। দেশ, জাতি এবং সর্বোপরি গণতান্ত্রিক ধারাকে অক্ষুণ্ন রাখতে দুই নেত্রীর সমঝোতা অনিবার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথমেই বিরোধীদলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই যে, আপনি যদি একটু উদারতার পরিচয় দেন তাহলে দেশে উলি্লখিত অস্থিতিশীল, অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক ঘটনা অনেক ক্ষেত্রেই দূর করা সম্ভব বলে মনে হয়। আপনি নিজেও এ দেশের তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন নির্বাচনের মাধ্যমে এবং আপনার দলও গণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আন্দোলন করছে। আপনার ভালোবাসার হাতটাকে আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে দেশের এসব অস্থিতিশীল ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো দূর করতে যুদ্ধাপরাধীদের নৈতিক সমর্থন দিয়ে হরতাল বা সহিংসতা সৃষ্টি না করে সরকারকে সহযোগিতার মনোভাব ব্যক্ত করে জনগণের আস্থাভাজন হতে পারেন। জনগণ যদি মনে করে আপনি দেশের ও জনগণের জন্য নিবেদিত তবে আগামি নির্বাচনে আপনি অবশ্যই পুনরায় নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। যার প্রমাণ ইতোপূর্বে বিভিন্ন নির্বাচনে আপনি পেয়েছেন। কাজেই আপনি আপনার নেতা-কর্মীদের সহযোগিতামূলক মনোভাব পোষণের নির্দেশ দিন, প্রয়োজনে দেশ পরিচালনার জন্য সরকারকে ইতিবাচক পরামর্শ দিন (সরকার গ্রহণ করুক আর না করুক)। এ পদক্ষেপ গ্রহণ করলে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার মাত্রা অনেক ক্ষেত্রেই বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়। এবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, আপনার সততা, ন্যায়পরায়ণতা, মহানুভবতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা নিঃসন্দেহে অতুলনীয়। আপনার প্রশাসনিক দক্ষতা দিয়ে সরকার পরিচালনায় বিশেষ অবদান রাখুন এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে নিজে হস্তক্ষেপ করুন তাহলেই দেশ, জাতি তথা জনগণ শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার মধ্যে শ্বাস নিতে পারবে বলে আশা করা যায়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়ে এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে সব ষড়যন্ত্র সৃষ্টির পরিবেশকে অতি শীঘ্রই রুখতে হবে। তাহলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনিও আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পুনরায় দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। আর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন তথা জনগণের নিরাপত্তা যেন অনিশ্চিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে সরকারি ও বিরোধীদল উভয়কেই। এজন্য উভয় দলকেই প্রচ-ভাবে সহনশীল হওয়া দরকার। দেশের সিংহভাগ ধর্মপ্রাণ মুসলমান যারা জামায়াতে ইসলামীর মতো এমন উগ্র রাজনৈতিক কৃষ্টিকে সমর্থন করে না, তাদেরও এগিয়ে আসাটা জরুরি হবে বর্তমান সংকট মোকাবিলায়। সর্বোপরি বলা যায়, এসব বিষয়ে দ্রুত সমাধানের আন্তরিক ও গঠনমূলক উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে, তা না হলে রাষ্ট্র গভীর সংকটে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে।

[লেখক : শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন