শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০১৩

শাহবাগের আলোকে দেখা শত্রু-মিত্রের মুখ

মো. মইনুল ইসলাম
গত মাসের ২৮ তারিখ '৭১-এর গণহত্যার অন্যতম নায়ক দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর দেশজুড়ে জামায়াত-শিবিরের তা-ব মানুষকে সে বছরের ২৫ মার্চের কালরাত্রি ও তৎপরবর্তী ৯ মাসের ধ্বংস ও হত্যালীলার কথা নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিল। পাকিস্তান গেছে আজ প্রায় ৪১ বছর। ২০১৩ সালের এ সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে পাকহানাদারদের তৎকালীন দোসর জামায়াত-শিবিরের এ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ আমাদের বিস্মিত করে। তাদের সাহস এবং শক্তির যে পরিচয় এ কয়দিনে তারা প্রদর্শন করেছে, তাতে বিশ্বাস করার কারণ আছে যে আমাদের রাষ্ট্র এবং সমাজ এ নরপশুদের শুধু সহ্য করেনি, বরঞ্চ তাদের '৭১-এর চরম অপরাধ এবং মওদুদিবাদী উগ্র ধর্মান্ধতাকে মেনে নিয়েছে। সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর জামায়াত-শিবির দেশব্যাপী যে ব্যাপক হত্যা এবং ধ্বংসলীলা চালিয়েছে সেটাকে কোনমতেই ছোট এবং মামুলি বলে ধরে নেয়া যায় না। এটা একেবারেই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের শামিল।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক এবং সশস্ত্র আক্রমণ বললেও ভুল হবে না। মানুষ আরও হতবাক যখন দেখে দেশের একটি বড় দল বিএনপি তাদের বিরোধিতা করা দূরে থাক, বরঞ্চ সমর্থক এবং সহযোগী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

উপরোক্ত বক্তব্যের আলোকে সাম্প্রতিক কিছু নারকীয় ঘটনাবলির বিবরণ এবং ব্যাখ্যা থেকে দেশ ও দশের শান্তি এবং অগ্রগতির কি বার্তা পাওয়া যায় এবং দেশের শত্রু-মিত্র কারা তা ভেবে দেখা যেতে পারে। ২৮ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যা থেকে এ পর্যন্ত (৭-৩-১৩) দেশব্যাপী জামায়াত-শিবিরের তা-বের দুটি বৈশিষ্ট্য বেশ পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠে। একটি হলো পুলিশ, থানা, সরকারি দফতর, যানবাহন, রেললাইন প্রভৃতিতে হামলা, নষ্ট, লুটপাট ও অগি্নসংযোগ জাতীয় ধ্বংযজ্ঞ এবং নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি। অন্যটি হলো সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর এবং উপাসনালয়ে অগি্নসংযোগ এবং মূর্তি ভাঙচুর। প্রথমটিতে সহিংসতার শক্তি ও স্পর্ধার পরিচয় আছে, যা জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এসব দুর্ঘটনা একেবারেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, যা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। দ্বিতীয়টিতে তাদের ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতার বৈশিষ্ট্যটি বিশেষভাবে পরিস্ফুট। এসব জঙ্গি-সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাতে গিয়ে তারা ধর্মের নামে চরম অধর্মের কাজটি করেছে সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং সাম্প্রদায়িকতার মতো জঘন্য বর্বরতার আশ্রয় নিয়ে। তাছাড়া কম্পিউটারে চাঁদের ছবিতে সাঈদীর ছবি সেঁটে দিয়ে তাকে অতিশয় বুজুর্গ ব্যক্তি এবং আল্লাহর পেয়ারা বান্দা বানানোর মতো জঘন্য মিথ্যাচারের আশ্রয় নিতেও তারা পিছপা হয়নি। তারপর তাকে রক্ষা করার মানসে মসজিদের মাইক থেকে ফজরের নামাজের সময় ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তুলে মিছিল করানো হয়েছে। সে মিছিলের অগ্রভাগে শিশু-কিশোর-নারীদের দ-ায়মান করে ধূর্ত জামায়াত-শিবির তাদের মানববর্ম হিসেবে ব্যবহার করেছে।

শয়তানকে হার মানানোর মতো দুষ্টবুদ্ধির আশ্রয় তারাই নিতে পারে যারা শান্তির ধর্ম ইসলামকে চরম অশান্তি সৃষ্টির কাজে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চায়। তাদের পবিত্র কোরআনের বাণী থেকেই বলতে হয়, 'বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি যুদ্ধ হতেও গুরুতর'। ওই মহাগ্রন্থে আরও বলা হয়েছে, 'তোমরা সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেক না; জেনে-শুনে সত্য গোপন কর না। আর পৃথিবীতে অহেতুক অশান্তি সৃষ্টি কর না।' কথায় বলে 'চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী'। দেখে-শুনে মনে হচ্ছে ধর্মের এসব পবিত্র বাণী এবং সুমহান আদেশ-নির্দেশ উপেক্ষাকারী জামায়াত-শিবির '৭১-এর মতোই এবারও ধর্মের লেবাসে চরম অধর্মের পরিচয় প্রদানে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর এবং উপাসনালয় ধ্বংস করে এরা এদের পাকিস্তানি ভাই লস্কর-ই-তৈয়বা, লস্কর-ই দেঙ্গভি সিপাহি সাহাবা, তেহরিকে তালিবান পাকিস্তানের মতো মনে হয় বাংলাদেশে একই ভূমিকা পালনে ব্রত হয়েছে। দেশের ২০টি জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের দেড় হাজার বাড়িঘর ও মন্দির ধ্বংস করে এরা এদের ধর্মান্ধতার পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উদ্যোগেই '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। শাহবাগের আন্দোলনকারীরা এদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাচ্ছে। তাই প্রধান বিরোধীদল বিএনপির এ ব্যাপারে অবস্থানটি বিচার-বিবেচনার দাবি রাখে। ৫ ফেব্রুয়ারি (২০১৩) শাহবাগের আন্দোলন শুরু হয়। এর ৮ দিন পর ১২ ফেব্রুয়ারি বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম ঝঃধহফরহম ঈড়সসরঃঃবব বা স্থায়ী কমিটি এক বিবৃতিতে আন্দোলনটিকে স্বাগত জানিয়ে বলে, 'আগামীতে নির্বাচিত হলে তারা এ মানবতাবিরোধী অপরাধের নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করবেন।' তারা এও স্বীকার করেন, 'জনগণ আজ ১৯৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু বিচার চায়'। তারা আরও বলেন, 'জনগণ আজ ১৯৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ' (প্রথম আলো ১৩-২-১৩)। কিন্তু অন্যদিকে বিএনপির হান্নান শাহ, জয়নুল আবদিন ফারুক, এম কে আনোয়ার, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং রুহুল কবির রিজভীর মতো শীর্ষ স্থানীয় নেতারা এ আন্দোলনকে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিকে বানচালের ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেন। তারা আরও বলতে থাকেন, এটি জামায়াতকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের ১৮দলীয় জোটকে দুর্বল করার অপচেষ্টা, একটি সাজানো নাটক এবং ইসলামবিদ্বেষী কথাবার্তার একটি সরকারি প্ল্যাটফরম মাত্র। ১৯ ফেব্রুয়ারি বেগম জিয়া এক বিবৃতিতে শাহবাগ আন্দোলনকে সরকারি দলের চক্রান্ত সম্পর্কে সচেতন থাকতে হুঁশিয়ার করে দেন। সরকারের ভয়াবহ, অপকীর্তিগুলো যুক্ত করে একটা সর্বজনীন আন্দোলনের সম্ভাবনাকে ব্যর্থ করার ক্ষমতাসীন মহলের সুদূরপ্রসারী প্রচেষ্টা সম্পর্কে সজাগ থাকার আহ্বান জানান (সংবাদ ১৯-২-১৩)।

অন্যদিকে জামায়াতসহ অন্য ইসলামী দলগুলোর ডাকা ২৪ ফেব্রুয়ারির হরতালে বিএনপিকে আবার সমর্থন দিতেও দেখা গেল। এরপর জামায়াত-শিবিরের দেশব্যাপী ব্যাপক সন্ত্রাস এবং ধ্বংসলীলার প্রতিক্রিয়ায় খালেদা জিয়া ২ মার্চের বিবৃতিতে ইনিয়ে- বিনিয়ে তাদের তা-বের পক্ষেই সাফাই গাইলেন এবং সমর্থন দিলেন। ২ মার্চ থেকে জামায়াত-শিবিরের সংঘটিত ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ এবং সংখ্যালঘুদের জানমাল ও মন্দিরের ওপর আক্রমণের ব্যাপারে খালেদা জিয়ার বিবৃতিটি বেজায় কৌতূহলজনক এবং তাই উল্লেখের দাবি রাখে। ৫ মার্চের এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, 'ব্যর্থ ও গণবিচ্ছিন্ন সরকারের ফ্যাসিবাদী নির্যাতন-নিপীড়ন ও নির্বিচার হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষ যখন ফুঁসে উঠে প্রতিরোধ লড়াই শুরু করেছে, সে মুহূর্তে বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর, অগি্নসংযোগ এবং লুটতরাজের বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা আমরা জানতে পেরেছি।

'...আমি এসব ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি' (৫-৩-১৩-এর সব সংবাদপত্র)। একদিকে তিনি সংখ্যালঘুদের ওপর আঘাতের ব্যাপারে তীব্র নিন্দা জানান অন্যদিকে এ সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের নায়ক জামায়াত-শিবির এবং তাদের সৃষ্ট সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য ঠেকাতে গিয়ে সরকারের বিভিন্ন স্বাভাবিক এবং বৈধ পদক্ষেপকে ফ্যাসিবাদী নির্যাতন বলে অভিহিত করেন। আর জামায়াত-শিবিরের সহিংস ও সাম্প্রদায়িক তা-বকে অভিহিত করেন 'প্রতিরোধের লড়াই' বলে।

তথাকথিত সেই 'প্রতিরোধ লড়াই' ঠেকাতে গিয়ে আইন প্রয়োগকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হওয়া জামায়াত-শিবিরদের মৃত্যুকে খালেদা জিয়া 'গণহত্যা' বলে অভিহিত করেন এবং ৩-৪ মার্চের জামায়াত আহূত হরতালের সঙ্গে যোগ দিয়ে ৫ মার্চ আরেকটি হরতাল ডাকেন। খালেদা জিয়ার উপরোক্ত 'গণহত্যা' আসলে '৭১-এ পাকহানাদার এবং তাদের দোসর জামায়াত-শিবির অনুষ্ঠিত গণহত্যাকে আড়াল এবং ক্ষুণ্ন করার জন্যই খালেদা জিয়ার এ অপচেষ্টা। প্রধান বিরোধীদলের নেত্রী হিসেবে জাতিসংঘের প্রদত্ত এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত 'গণহত্যার' সংজ্ঞাটি তার অজানা থাকার কথা নয়।

এখন দেখা যাচ্ছে, বিএনপি একটার পর একটা দাবি ও বিক্ষোভের মাধ্যমে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে এবং তারপর দিনই হরতাল আহ্বান করছে। ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। যে দলই হরতাল ডাকুক, তা তারা নিজেদের স্বার্থে করে, জনগণের স্বার্থে খুব কমই করে। হরতাল সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবন অচল করে দেয় এবং অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার সৃষ্টি করে। হরতাল একেবারেই গণবিরোধী এবং জনগণের ওপর বলপূর্বক চাপিয়ে দেয়া এবং মহাঅভিশাপ। অথচ বিপদে ভয়ে ঘরে বসে থাকা মানুষগুলোকে পরের দিন রাজনৈতিক দলগুলো 'স্বতস্ফূর্তভাবে হরতাল পালনের' জন্য ধন্যবাদ জানায়। জনগণের সঙ্গে এক মহাকৌতুক বটে! হরতালের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর জোর-জুলুম এবং মিথ্যাচার দেখলে বিস্মিত হতে হয়। অন্যদিকে এদের মুখে গণতন্ত্র জনগণ, উন্নয়ন ইত্যাদি মহাজন বাক্য খইয়ের মতো ফুটে। হরতালের প্রতি জনগণের ব্যাপক বিরূপতা এবং ধিক্কার এবং এর সঙ্গে অর্থনীতির ওপর এর মারাত্মক কুফল সম্বন্ধে বড় দলগুলো জানে না, তা কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু এ অপরাজনীতির বেপারিদের হাতে অসহায় দেশবাসী জিম্মি। এটিও আমাদের এক বড় দুর্ভাগ্য।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকালে ধর্মের দোহাই তুলে রাজনৈতিক ফায়দা আদায়ের কৌশলটিও বিএনপি হাতছাড়া করছে না। সেই পুরনো পাকিস্তানি আমলের কায়দায় ইসলাম বিপন্নের জিকিরটি ঘাতকদের বর্তমান বিচারের প্রেক্ষাপটে তারা ভালো করেই তুলছে। শাহবাগের চলমান আন্দোলনকে ইসলামবিরোধী আখ্যায়িত করে বিএনপির স্থায়ী কমিটি একে সরকারের মদতে দেশের স্বাধীনতাকে ইসলামের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা বলে আখ্যায়িত করেছে। জামায়াত-শিবিরের মতো স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক যুবশক্তির এ মহতি আন্দোলন এবং উদ্যোগ হলো, বিএনপির মতে 'সরকার কর্তৃক দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস ও স্বাধীনতাকে পরিকল্পিতভাবে প্রতিপক্ষ বানিয়ে মুখোমুখি দাঁড় করানো' এবং 'ফলে জাতিকে স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষের দুই মেরুতে বিভক্ত করার ভয়ানক অপকর্ম' (প্রথম আলো ৯-৩-১৩)। শাহবাগের আন্দোলন আসলে যা করেছে, তাহলো '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে অপরাধী নরঘাতকদের বিচার এবং প্রাণদ-ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এর সঙ্গেই ধর্ম বা জাতীয় বিভেদ সৃষ্টির যে সামান্য যোগসূত্রও নেই তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবু 'যত দোষ নন্দ ঘোষ' এবং 'যারে দেখতে নারী তার চলন বাঁকা' জাতীয় অর্থহীন প্রগলভতা বিএনপি করেই যাচ্ছে। এতে তাদের ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক, সুবিধাবাদী এবং ক্ষমতালিপ্সু মনোভাবের কদর্ম রূপটি ফুটে উঠেছে মাত্র।

এপর্যায়ে জামায়াত-শিবিরের স্বভাব-চরিত্র এবং আদর্শ-উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যাক। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে নিদারুণভাবে পর্যুদস্তু এ ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তাদের উগ্র মৌলবাদী মওদুদিবাদী মতাদর্শ কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশও পরিত্যাগ করেনি। '৭১-এর পর কিছুদিন আত্মগোপনে থেকে গোপনে তারা সংঘবদ্ধ হয়েছে। আর তাদের মওদুদিবাদী উগ্র মতাদর্শ ভিত্তিক রাজনীতি পুনরায় বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। একদিকে সরলপ্রাণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আবেগকে সুবিধামতো ব্যবহার করে তাদের সদস্য এবং সমর্থক সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। অন্যদিকে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রাজনীতির অঙ্গনে কিছুটা স্থান দখল করে নিয়েছে। ফলে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে পারস্পরিক সাহায্য এবং সুবিধার সম্পর্ক। মিটিং-মিছিলের মাধ্যমে শক্তি প্রদর্শন এবং ভোটযুদ্ধে জয়লাভের জন্য জামায়াতের সুসংগঠিত এবং প্রশিক্ষিত ক্যাডার বাহিনী, বিশেষ করে শিবিরের জঙ্গিদের ওপর বিএনপি বহুলাংশে নির্ভর করে থাকে। জামায়াত-শিবিরের যে কতটা সুসংগঠিত এবং প্রশিক্ষিত নাশকতাবাদী গোষ্ঠী তা গত কয়েক দিনের থানা, পুলিশ ফাঁড়ি, সরকারি দফতর, রেললাইন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংস করা এবং সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে অগি্নসংযোগ থেকেই সুস্পষ্ট। জামায়াত এদেশে পাকিস্তানি কায়দায় ধর্মীয় জঙ্গিবাদী সৃষ্টি করেছে, যারা নাশকতামূলক কাজে প্রশিক্ষিত এবং পারদর্শী। এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ বড় দুই দলের ছাত্র-যুব ক্যাডারদের দ্বারা সংঘটিত করা সম্ভবপর হতো না। এ জন্য চাই উগ্র ধর্মান্ধ মতাদর্শে দীক্ষিত এবং প্রশিক্ষিত জঙ্গি বাহিনী।

পরিশেষে বলতে হয়, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রাণশক্তি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতা, গণতান্ত্রিকতা এবং উন্নয়নশীলতা। একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং উন্নয়নশীল বাংলাদেশ অর্জন ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য। তার বিপরীতে একটি সাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক ধর্মীয় রাষ্ট্র কায়েম করা জামায়াতের অভীষ্ট লক্ষ্য। এই দুই বিপরীত এবং সাংঘর্ষিক লক্ষ্যের পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াতের রাজনীতির সুদূরপ্রসারী কুফলতা এবং ভয়াবহতার মূল্যায়ন করতে হবে। সাধারণভাবে দুর্নীতি এবং সন্ত্রাস আমাদের জাতীয় উন্নতি এবং অগ্রগতির বড় শত্রু। এ দুই আপদ আওয়ামী এবং বিএনপি, উভয় আমলেই বিদ্যমান এবং বহাল থাকে। এগুলো আমাদের তথা জাতির দেহের শত্রু। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী এবং পাকহানাদারদের দোসর গোষ্ঠী হলো আমাদের প্রাণের শত্রু। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা আদর্শ-উদ্দেশ্যকে হত্যা করার জন্য তারা সদাসর্বদা উদ্ধত তরবারি। যার অর্থ হলো, এ সর্বনাশা শত্রুকুল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রাণহরণ করতে চায়। এ প্রাণের শত্রুরা আবার নতুন করে দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এদের পক্ষের শক্তিগুলোকেও দেশ ও জাতির মিত্র বলা যাবে না। এ আলোকে আজ অমাদের শত্রু-মিত্র চিনতে হবে। বিদ্রোহী কবির ভাষায় দেশবাসীকে নতুন করে আহ্বান জানাব এবং বলব, 'দুর্গম গিরি কান্তার মরু, দুস্তর পারাপার। লম্বিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার।' দেশ এক কঠিন সংকটকাল পার হচ্ছে। প্রিয় দেশবাসী হুঁশিয়ার, শত্রু-মিত্র চিনে নিন।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন