রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৩

যুদ্ধাপরাধী বিচার ॥ জামায়াতের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত শুরু

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযুক্তদের পাশাপাশি এবার তদন্ত সংস্থা যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে তদন্ত শুরু করেছে। জাতীয় সংসদে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন সংশোধন করায় সংগঠনেরও বিচারের পথ সুগম হয়েছে। একই সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে রায়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যার প্রত্যক্ষ সহযোগী হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করা হয়েছে। তদন্ত সংস্থা সে কারণেই সংগঠনকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। অন্যদিকে দু’টি ট্রাইব্যুনালে ১১টি মামলা বিভিন্ন স্তরে রয়েছে। তিনটি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন করে কোন মামলার তদন্ত শুরু হয়নি। তদন্ত সংস্থা সূত্রে এ খবর জানা গেছে।

তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক এমএ হান্নান খান জনকণ্ঠকে বলেছেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) এ্যাক্ট সংশোধনীর ফলে অভিযুক্তদের পাশাপাশি সংগঠনের বিচার করা যাবে। সেই হিসেবে আমরা জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে তদন্ত শুরু করেছি। একই সঙ্গে সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে আমরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছি। পাশাপাশি যে মামলাগুলো তদন্তাধীন রয়েছে সেগুলোরও তদন্ত কাজ চলছে। সহসা তদন্ত শেষ করে তার চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রদান করা হবে।

তদন্ত সংস্থার অন্যতম সমন্বয়ক সানাউল হক জানিয়েছেন, এবার ব্যক্তির পাশাপশি জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছি। তদন্তে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন পক্ষের শক্তিশালী একটি টিম কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, কয়েকটি মামলায় রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া রায়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যার প্রত্যক্ষ সহযোগী হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করা হয়েছে। জাতীয় সংসদে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন সংশোধন করায় সংগঠনেরও বিচারের পথ সুগম হয়েছে। তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক বলেছেন, জামায়াতের ইসলামীর অনেক তথ্য উপাত্ত আমাদের হাতে রয়েছে। বিশেষ করে দৈনিক সংগ্রাম, তখনকার পত্রপত্রিকা, তাদের বই পুস্তক, ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। মামলা তদন্তে কয়েকজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তদন্ত সংস্থার অন্যতম সমন্বয়ক আরও বলেন, আমরা তদন্তের স্বার্থে এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না।

উল্লেখ্য, একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচারের গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ এ ১৪টি মামলার মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ প্রথম রায ঘোষণা করেন। ২১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল-২ বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আজাদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- প্রদান করে। ফাঁসি দ-প্রাপ্ত আসামি পতলাতক রয়েছে। তিনি আপীলও করেননি। ইতোমধ্যে আপীলের সময়সীমা পার হয়ে গেছে। একই ট্রাইব্যুনাল ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের শীর্ষ নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায় প্রদান করে। ঐ রায়ে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপীল করেছেন। যার শুনানি ৩১ মার্চ। একই মাসে ২৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল-১ জামায়াতের অপর শীর্ষ নেতা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- প্রদানের রায় ঘোষণা করেন। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদ- দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আসামি পক্ষ মার্চের শেষে দিকে আপীল করবে বলে জানা গেছে।

এখন দুটি ট্রাইব্যুনালে ৬টি মামলার বিচারিক কার্যক্রম বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে, জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী, বিএনপি স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আব্দুল আলীম।

এ ছাড়া আরও ৫টি মামলার মধ্যে কয়েকটির রিপোর্ট প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যগুলো তদন্ত দ্রুত চলছে। এর মধ্যে জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে ২৪ এপ্রিল। সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা হাজী মোঃ মোবারক হোসেনের জামিন বাতিল করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। অভিযোগ (চার্জ) গঠন বিষয়ে শুনানির জন্য ৪ এপ্রিল দিন ধার্য্য করা হয়েছে। জামায়াতের অপর নেতা মাওলানা আব্দুল সোবহানের বিরুদ্ধে ১৬ এপ্রিল তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

অন্যদিকে আরও ছয়টি মামলার তদন্ত কাজ চলছে। সেগুলো হলো একেএম ইউসুফ, সাবেক এমপি সৈয়দ মোহাম্মদ কাওসার, গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন, এমএ জাহিদ হোসেন খোকন, আমজাদ মিনার বিরুদ্ধে তদন্ত কাজ চলছে। তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে তদন্ত কাজ শেষ হলেই এদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট প্রাদন করা হবে। এছাড়া বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম আসামি চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থা প্রতিবেদন দাখিল করেছে। মামলাটি গুরুত্ব বিবেচনায় তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন উভয় পক্ষ এটি যৌথভাবে আরও তদন্ত করছে বলে জানা গেছে। এরা দু’জনেই এখন বিদেশে রয়েছেন। বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের দায়িত্বপ্রাপ্ত আলবদর বাহিনীর চীফ এক্সিকিউটর বা ‘প্রধান জল্লাদ’ ছিলেন আশরাফুজ্জামান খান আর অপারেশন ইনচার্জ ছিলেন চৌধুরী মাঈনুদ্দীন।

দুটি ট্রাইব্যুনালে যে ৬টি মামলা চলছে তার মধ্যে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মামলাগুলো প্রায় শেষের দিকে। জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষ যুক্তিতর্ক শেষ করেছে। আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক চলছে। সোমবার আসামি পক্ষ ৫ম দিনের মতো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবেন। তাদের যুক্তিতর্ক শেষ হলেই রায় ঘোষণার জন্য দিন নির্ধারণ করা হবে। ২০১২ সালের ১৩ মে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মোট ৫টি চার্জ গঠন করা হয়েছে। যড়যন্ত্র, অপরাধ সংগঠনের পরিকল্পনা, উস্কানি সম্পৃক্তি ও হত্যা জনিত অপরাধে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি গোলাম আযম ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন জানান। এ আবেদন নাকচ করে দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর এমপির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এখন শেষ পর্যায়ে। তার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ২১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। ২১তম সাক্ষী আবুল বশরের জবানবন্দী শেষ হয়েছে। তাকে আসামি পক্ষ এখন জেরা করবে। মামলার কার্যক্রম ১৮ মার্চ পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে। ২০১০ সালের ২৬ জুলাই সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়। তাকে গ্রেফতারের জন্য ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালে আবেদন করে তদন্ত সংস্থা। ১৯ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগেও তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্মান্তরে বাধ্য করাসহ ২৩টি অপরাধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা চলছে।

জামায়াতের বর্তমান আমির ॥ জামায়াতের বর্তমান আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের তৃতীয় সাক্ষী সাক্ষ্যপ্রদান করবে ১৯ মার্চ। বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ ১৬ অভিযোগ গঠন করা হয়। ১৬ নম্বর অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রেসিডেন্ট ও আলবদরের প্রধান হিসেবে বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। অন্য ১৫টি অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ এ ধরনের অপরাধে সহযোগিতা করা, ষড়যন্ত্র করা ও উর্ধতন নেতা হিসেবে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।

Source: http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=27&dd=2013-03-17&ni=129053

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন