মোরসালিন মিজান ॥ বলার অপেক্ষা রাখে না, শাহবাগ এখন মস্তবড় ইতিহাস।
রাজধানীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই স্থানে নতুন এক বিপ্লবের সূচনা করেছে
তরুণ প্রজন্ম। এখানে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ
শাস্তি মৃত্যুদন্ডের দাবি ওঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ফিরে পাওয়ার আকুতি
জানানো হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এভাবে মাসাধিককাল। এ পর্যায়ে এসে সারা দেশে
আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করছেন আয়োজকরা। ফলে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মসূচী ছোট
হয়েছে। জনস্রোত কমেছে কিছুটা। তবে প্রতিবাদী চেহারাটি ধরে রেখেছে অন্যান্য
সংগঠনগুলো। গণজাগরণ মঞ্চ ঘিরে থাকা এসব সংগঠন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি
তুলছে। নানা কায়দায় একাত্তরের ঘাতকদের ঘৃণা জানাচ্ছে।
প্রথমেই বলতে হয়, চিত্র শিল্পীদের কথা। শিল্পী সমাজের ব্যানারে কাজ করছেন
তাঁরা। চারুকলা অনুষদ শুধু নয়, এর আশপাশের এলাকা যুদ্ধাপরাধ বিরোধী
শিল্পকর্মে ভরিয়ে তুলেছেন তাঁরা। চারুকলার ঠিক সামনে গেলে চোখে পড়বে,
বিশালাকৃতির একটি পেঁচা উল্টে পড়ে আছে। অশুভ শক্তি জামায়াত-শিবিরের
বিপর্যয়ের কথা বলতেই এ শিল্পকর্ম। অনুষদের দেয়ালের ওপরের অংশটি সাজানো
হয়েছে সিরিজ ছবি দিয়ে। প্রতিটি ক্যানভাসে রাজাকারের মুখ। জন্তু জানোয়ার হয়ে
প্রকাশিত হয়েছে তাঁরা। একাত্তরের ঘাতকদের প্রতি শিল্পীদের ঘৃণা কত প্রবল
তা অনুমান করা যায় এখান থেকে। বাম পাশের দেয়ালের আয়োজনটিও উল্লেখ করার মতো।
এখানে যুদ্ধাপরাধীদের নামের তালিকা। না, একটি দুটি নাম নয়। দীর্ঘ তালিকা।
ঘৃণাভরা চোখে তালিকাটি দেখছেন পথচারীরা। পাশেই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের ছবি।
ফাঁসির দড়ি পড়ানো গো. আজম, নিজামী, সাকা, সাঈদী, কাদের মোল্লা,
কামারুজ্জামানদের দেখে অনেকেই থুঁতু ছিটাচ্ছেন। যাদের ইতোমধ্যে ফাঁসির আদেশ
হয়েছে তাদের ছবিতে ক্রস চিহ্ন একে দিচ্ছেন। তবে মজার কা-টি করছে শাহবাগের
কাক। রাজাকারের মুখ যেন এরাও চিনে গেছে। হয়ত তাই এদিক উড়ে বেড়ানো শেষ করে
কাকগুলো ছবির ওপরে এসে বসে। বিষ্ঠায় ভরিয়ে দেয় রাজাকারের মুখ! দৃশ্যটি
সত্যি দেখার মতো! অনেকেই খুব মজা করে দেখছেন। তাদের মতে, এটি আসলে প্রকৃতির
বিচার। সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের সামনে চলা হাতে হাত কর্মসূচীটিও
দারুণ সফল। এখানে হাতের ছাপ সংগ্রহের কাজ চলছে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির
দাবির সঙ্গে একাত্ম হয়ে ছেলে বুড়ো সকলেই হাতের ছাপ দিচ্ছেন। রঙ মাখা হাত
ক্যানভাসে চেপে ধরছেন। এভাবে অসংখ্য হাত। অগণিত মানুষের দাবি। দেখতে দেখতে
অনিন্দ্যসুন্দর শিল্পকর্ম হয়ে ওঠছে ক্যানভাসটি। কর্মসূচীটি পরিচালনা করছেন
তারিক রহমান। তিনি জানালেন, ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে এ কর্মসূচী চলছে। এখন
পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ হাতের ছাপ রেখে গেছেন। এর মধ্য দিয়ে মূলত
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ হাতে হাত রাখলেন। যুদ্ধাপরাধীদের
ফাঁসির দাবি তুললেন। এর ঠিক পাশে অন্য একটি সংগঠন স্বাক্ষর সংগ্রহের
কর্মসূচী। আন্দোলনের প্রতিটি দিনের ইতিহাস সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে আরেকটি
সংগঠন। মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণও চোখে পড়ার মতো। এক সময়ের বীর যোদ্ধারা
বিভিন্ন ব্যানারে শাহবাগে অবস্থান নিয়েছেন। তেমন একজন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল
লতিফ। জনকণ্ঠকে তিনি বললেন, আমরা আমাদের কাজ করেছি। এখন তরুণরা করছে। এই
দৃশ্যটি দেখতেও ভাললাগে। তাই বাসায় বসে থাকতে পারি না। ওদের সাহস যোগাতে
শাহবাগ চলে আসি। মুক্তিযোদ্ধাদের মতো শাহবাগে আছেন তাঁদের গর্বিত
সন্তানরাও। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে মতামত ও স্বাক্ষর গ্রহণের কাজ করছে যুদ্ধাহত
ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড। সংগঠনটির পক্ষে হানিফ হেলাল বললেন,
আমাদের শরীরে মুক্তিযোদ্ধার রক্ত। শহীদের রক্ত। এ কারণেই শাহবাগের দাবির
সঙ্গে একাত্ম হয়েছি। এভাবে আরও অনেকগুলো সংগঠন নিজেদের মতো করে কাজ করছে।
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে চলা তাঁদের এ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে
জানান সংগঠকরা।
এদিকে, শনিবার এসব সংগঠনের কার্যক্রম পরিদর্শন করেছেন গণজাগরণ মঞ্চের
মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার। সবকটি সংগঠনের কাজকর্মের খোঁজ নেন তিনি।
ইতিহাস সৃষ্টিকরা আন্দোলনের মূল নেতাকে সামনে পেয়ে সকলেই ছিলেন দারুণ
উজ্জীবিত। অনুজরা তাঁর সঙ্গে করমর্দন করেন। বুকে জড়িয়ে ধরেন। অগ্রজরা মাথায়
হাত দিয়ে দোয়া করে দেন। এ সময় আবেগঘন এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সম্মিলিত এই
প্রয়াস সম্পর্কে জনকণ্ঠকে ইমরান বলেন, আন্দোলনটি আমার নয়। আমাদের। যে যার
জায়গা থেকে কাজ করছেন বলেই এতদূর এগিয়েছে আন্দোলন। সামনের দিনগুলোতেও সকলকে
পাশে পাওয়ার ইচ্ছার কথা জানান তিনি।
Source: http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=27&dd=2013-03-17&ni=129052
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন