মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০১৩

সহিংসতা প্রতিরোধে গণজাগরণ মঞ্চের গুরুত্ব

মিল্টন বিশ্বাস
সেলিনা হোসেনের ‘জেন্ডার ও উন্নয়ন কোষ’ গ্রন্থে ‘সহিংসতা’ নিয়ে একটি অধ্যায় আছে। সেখানে এই শব্দটিকে মানব উন্নয়নবিরোধী একটি প্রত্যয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যুদ্ধ, সংঘাত, বিদ্রোহ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো বড় আকারের সহিংসতা নারী-পুরুষ উভয়কেই সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই সহিংসতা শারীরিক ও মানসিক দুই প্রকারের হতে পারে। বিষয়টিকে জেন্ডারের পরিপ্রেক্ষিতে লেখক বিবেচনা করলেও সহিংসতার ধারণাটি বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে গণ্য হচ্ছে। সহিংসতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে স্বৈর শাসক গোষ্ঠীর ক্ষমতার আধিপত্যের জায়গা থেকে। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকারের শাসনব্যবস্থায় সহিংসতা জন্ম নিতে পারে ধর্মীয় মৌলবাদের কারণে। ধর্মান্ধ অনুশাসন অপর ধর্মানুগামীকে প্রতিহতের ধারণা দিয়ে থাকে।
উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামল থেকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ভাবাদর্শে নতুন চিন্তা ভাবনার উদ্ভব ঘটে। কিন্তু ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি অন্ধ অনুরাগ আমাদের সমাজে অনেক সহিংসতার জন্ম দিয়েছে; সমাজকে পশ্চাৎপদ করেছে। একসময় অনেকের মনে এই ধারণাও জন্ম নিয়েছিল যে নিজেদের উন্নয়নে ধর্ম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এক সময় মানুষের সাধারণ অধিকারকে ধর্ম দিয়ে বিবেচনা করা হয়েছিল। কিংবা প্রগতিশীলদের মতো প্রকাশের স্বাধীনতাকে অবহেলা করার কারণে ধর্মীয় পুরোহিত-মোল্লাদের সঙ্গে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তান আমলে ইসলামের দৃষ্টিতে দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে শাসকগোষ্ঠী বাঙালি সংস্কৃতির ওপর খড়গ উঁচিয়ে ধরেছিল। ফলে সহিংসতা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। যদিও সেই সহিংসতা বাঙালি সমাজ সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে প্রতিরোধ করে। তখন সহিংসতা ছিল শাসকগোষ্ঠীর দমন-নিপীড়নের ফল। এমনকি সেই সময় ধর্মীয় অনুশাসকদের বিরুদ্ধাচরণকারীদের শাস্তির বিধান করে জীবনের মুক্ত বিচরণকে অস্বীকার করা হয়েছিল। ইসলামের নামে গোঁড়ামির বিরুদ্ধে মুসলিমসমাজের সচেতন বিশিষ্টজনরা অনেক আগে থেকেই কথা বলে গেছেন। তদুপরি ধর্মের যে মানবিক দিক রয়েছে সেইগুলোকে বাতিল করার মানসিকতা আমাদের সহিংস করে তুলেছে।

যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য জামাত-শিবির যেমন নাশকতা ও গুজবের আশ্রয় নিয়েছে তেমনি কিছু সংখ্যক মৌলবাদী বুদ্ধিজীবী তাদের কর্মকা-কে সমর্থন করে উস্কানি জুগিয়ে চলেছেন। ধর্মীয় শপথ করে মৌলভীরা যেমন সাঈদীসহ একাত্তরের অপরাধীদের পক্ষে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে তা-ব ও গুজব ছড়িয়েছে তেমনি কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা প্রতিদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষকে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে সহিংসতায় উস্কে দিচ্ছে। এমনকি ধর্মপ্রাণ মানুষকে দেশীয় অস্ত্র সরবরাহ করে হামলায় অংশগ্রহণে প্ররোচিত করা হচ্ছে। কুড়াল-করাত ধরিয়ে দিয়ে গাছ কেটে সড়ক অবরোধ করাচ্ছে জামাতিরা। হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলাও তাদের পরিকল্পনার অংশ। ৪ মার্চ নয়াদিগন্তে ‘নির্মূলের রাজনীতি’ শীর্ষক কলামে নির্লজ্জভাবে জামাত-শিবিরকে সমর্থন করা হয়েছে। এর আগে একাধিক রচনায় এ ধরনের ব্যক্তিরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে অস্বচ্ছ বলে দাবি জানিয়েছেন। উক্ত লেখকদের লেখায় উস্কানি আছে, আছে সত্যকে মিথ্যা বলে চালিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা। আর জামাত-শিবিরের কর্মকা-কে সমর্থনের প্রমাণ। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চের সদিচ্ছা সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশের অকুণ্ঠতা। ২২ ফেব্রুয়ারি আমার দেশ পত্রিকায় ‘ধর্ম ও আদালতের অবমাননা করছে ব্লগারচক্র’ শীর্ষক উস্কানিমূলক প্রতিবেদনের মতোই এ ধরনের লেখকরা উঠে পড়ে লেগেছেন গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করার জন্য। এর আগে ২০০৭ সালে কোনো কোনো ব্যক্তি ও সংঘ জিএমবি, হরকাতুল জেহাদ প্রভৃতি জঙ্গি সংগঠনের কর্মকা-কে সমর্থন করে বক্তব্য প্রচার করেছিল।

৩ ও ৪ মার্চ জামাত-শিবিরের হরতালকে প্রত্যাখ্যান করেছে আপামর জনগোষ্ঠী। যদিও তারা সেই সময় ইসলামের নাম ভাঙিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনায় সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছে। ইতোমধ্যে ধর্মপ্রাণ ওলামারা বলেছেন, জামাতে ইসলামী প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ফ্যাসিবাদী মানসিকতায় বিশ্বাসী একটি সন্ত্রাসী দল। তাদের প্রতিষ্ঠাতা নেতা মাওলানা মওদুদী নবী-রাসুল ও সাহাবাদের নামে বহু অপকথা প্রচার করেছিল। তাকেই অনুসরণ করে জামাত-শিবির হরতালের নামে সহিংসতায় দেশের সহজ-সরল ধর্মপ্রাণ মানুষকে ধর্মীয় উন্মাদনায় উস্কে দিচ্ছে। মূলত সহিংসতার ঘটনা কয়েক বছর আগে শুরু হলেও চলতি বছর ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে জামাত-শিবিরের প্ররোচনায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে অনেকেই এবং মারা পড়ছে নিরীহরা। কারণ তাদের সামনে এগিয়ে দিচ্ছে, হামলায় প্ররোচিত করছে মৌলবাদীরা। এমনকি শোনা গেছে মানুষের সহানুভূতি অর্জনের জন্য নিজেদের কর্মীকে নিজেরা হত্যা করছে। জামাত-শিবির এখন পাগলা কুকুরের মতো আচরণ করছে। গণজাগরণ মঞ্চের যাকে পাচ্ছে, যাকে মনে হচ্ছে সরকার ও আওয়ামী লীগের লোক তাকেই শেষ করতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছে। এ জন্য হিন্দুদের আক্রমণ করে সরকারকে বিব্রত ও ব্যর্থ প্রমাণ করতে মরিয়া তারা। ভারতের রাষ্ট্রপতির আগমনের দ্বিতীয় দিন ৪ মার্চ তার হোটেলের সামনে ককটেল ফুটিয়েছে সহিংসতার জনকরা। ঢাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ এটা প্রমাণ করতে উন্মাদের মতো কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে জুম্মাবারেও। মসজিদের মধ্যে বোমা ও অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করছে। ধর্মপ্রাণ মানুষকে অনেকক্ষেত্রে বাধ্য করছে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে। সহিংস ঘটনায় মুহূর্তের মধ্যে জীবন দিয়ে দিচ্ছে যারা তাদেরকে শহীদ বলে প্রচার করতে চাইছে জামাত। এভাবে যখন জামাতি অপতৎপরতা চলছে তখন বিশিষ্ট ধর্মতাত্ত্বিকরা বলছেন, সব সহিংসতাই ইসলামের দৃষ্টিতে গর্হিত ও হারাম কাজ। কোনো মুসলাম জেনেশুনে এ কাজ করতে পারে না। ইসলামের দৃষ্টিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য উদ্বুদ্ধ করাটাও অন্যায় ও গুনাহর কাজ। জামাত-শিবির পুলিশকে আক্রমণ করে রাষ্ট্র ও সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে যা ফ্যাসিবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। একজন মুসলমান কখনো ধর্মের নামে অন্যের বাড়িঘরে হামলায় বা সহিংসতায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। সকলেই বলছেন জামাত-শিবিরের নিরপেক্ষ বিচারের প্রতি আস্থা নেই। তাদের কুখ্যাত নেতাদের পক্ষে আইনজীবী আছেন। সে ক্ষেত্রে বিচার ব্যবস্থাকে মেনে নিলে বিচার ছাড়াই নেতাদের মুক্তি চাচ্ছে কেন তারা। তাদের মূল লক্ষ্য সহিংসতা। অস্থিতিশীলতা তাদের মুখ্য রাজনীতি।

পক্ষান্তরে গণজাগরণ মঞ্চ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জামাত-শিবির নিষিদ্ধের দাবি নিয়ে আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শৃঙ্খলা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়েছে তার গুরুত্ব অনেক। সারা দেশে সহিংসতা দূর করার জন্য গণজাগরণ মঞ্চের বিকল্প নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী মানুষের জন্য প্রজন্ম চত্বরের জাগরণ প্রকৃত চপেটাঘাত। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যে চেতনা মুক্তিযুদ্ধের মর্মমূলে ছিল তার কাছেই আমরা আবার ফিরে এসেছি। ধর্মীয় জঙ্গিবাদকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। জয় বাংলা স্লোগানকে আওয়ামী লীগের দলীয় লেবাস থেকে মুক্ত করা হচ্ছে। যারা ও যাদের সমর্থকরা এদেশকে তালেবান বানাতে পারলে নিজেদের জীবনকে ধন্য মনে করত তাদের স্পষ্টভাবে বয়কট করা হয়েছে। আসলে ব্যর্থ ও সহিংসের পরিপোষক মানুষগুলো শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের দাবিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার স্পর্ধা পেলেন কোথা থেকে সেই প্রশ্ন আমাদের। যুক্তি-বিচার ও বুদ্ধি দিয়ে মৌলবাদীদের মোকাবিলার করার জন্য এদেশে মানুষের অভাব নেই। এজন্য অপরাধী জামাত-শিবির ও তাদের নগ্ন দালাল বিএনপিকে ধরে নেয়া যেতে পারে দেশের শত্রু বলে; যারা আসলে দেশকে ভালোবাসেনি। বরং দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টায় সহিংসতা বিস্তার করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে। এদের চিনে রাখার সময় এসেছে। সকলে সতর্ক থাকুন। গণজাগরণ মঞ্চ মানবিকবোধকে উচ্চে তুলে ধরেছে। তার প্রসার ঘটানোর জন্য ঢাকার বাইরে কর্মসূচি ঘোষিত হয়েছে। সেই কর্মসূচি দেশের মধ্যে সহিংসতা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই পারে দেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে। এই ঐক্য উন্নয়ন ও অগ্রগতির চালিকা শক্তি হিসেবে পরিগণিত হবে।

মিল্টন বিশ্বাস : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ভোরের কাগজ : মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন