জনকণ্ঠ । ওবায়দুল কবির
গুজব, মিথ্যা রটনা ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেশে অস্থিরতা
সৃষ্টির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে সরকারের বিরোধী পক্ষ।
মিথ্যা প্রচারে মানুষের অনুভূতিতে আঘাত করে তারা উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা
করছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে তারা সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নামানোর
চেষ্টা করছে দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষকে। একই সঙ্গে চেষ্টা করছে সরকারবিরোধী
আন্দোলন চাঙ্গা করতে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পটভূমিতে এই
প্রক্রিয়া শুরু করেছে জামায়াত। এখন এই পরিকল্পনায় যোগ দিয়েছে প্রধান বিরোধী
দল বিএনপিও। গুজব ছড়িয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পর আরও
ঘটনা ঘটানোর সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে তারা মাঠে নেমেছে বলে জানা গেছে।
শুরু
হয় শাহবাগ আন্দোলনকে ভ-ুল করার জন্য তরুণদের নাস্তিক হিসেবে চিহ্নিত করার
পরিকল্পনা নিয়ে। এরপর একে একে চাঁদে সাঈদীর ছবি দেখা, মসজিদের মাইকে আহ্বান
জানিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা চালানো, নিজেদের কর্মসূচীতে বোমা
ফাটিয়ে হরতাল ডাকা এবং সর্বশেষ শিশুদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সারাদেশে
অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা। জানা গেছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী এ ধরনের গুজব এবং
রটনা অব্যাহত থাকবে। মানুষের অনুভূতিতে আঘাত করে তাদের উত্তেজিত করে দেশে
অস্থিরতা সৃষ্টি করা হবে। কিভাবে গুজব তৈরি করা যায় তা নিয়ে কাজ শুরু করেছে
দুই দলের একটি যৌথ টিম। সুযোগ পেলেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে।
বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে পরবর্তী রায় ঘোষণা হলে এই পরিকল্পনা
বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। মূল পরিকল্পনা ছিল জামায়াত-শিবিরের। ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায় ঘোষণা করা হলে ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে জড়ো হয় তরুণ প্রজন্মের কয়েকজন। পরে বাড়তে থাকে জনতার ভিড়। প্রমাদ গোনে জামায়াত-শিবির। শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রত্যাশী তরুণ প্রজন্মকে নাস্তিক হিসেবে চিহ্নিত করা ছিল তাদের প্রথম টার্গেট। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৫ ফেব্রুয়ারি খুন করা হয় শাহবাগের অন্যতম উদ্যোক্তা আহমেদ রাজীব হায়দারকে। রাজীব খুন হওয়ার দুই ঘণ্টা পর তাঁর নামে চালু থাকা ব্লগে নবী করিম (স) নামে আপত্তিকর বক্তব্য পোস্ট করা হয়। যুদ্ধাপরাধীর মালিকানাধীন একটি পত্রিকায় তা বিস্তারিত প্রকাশ করে একদিন পর। পরদিন আরও দুটি দৈনিকে একই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয় আরও বড় করে। পত্রিকা দুটি আরও এক ধাপ এগিয়ে শুধু রাজীব নন, শাহবাগ আন্দোলনে যুক্ত সব তরুণকে নাস্তিক প্রমাণের চেষ্টা করে। স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। বিক্ষুব্ধ মুসলমানদের উস্কে দিয়ে জুমার নামাজের পর সারাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। হতাহত হয় অসংখ্য মানুষ। মারা যায় পুলিশ, রাজনৈতিক কর্মীসহ অর্ধশতাধিক সাধারণ মানুষ। জামায়াতের সঙ্গে যোগ দেয় প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। তারা মানুষ খুনের ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যায়িত করে পরিস্থিতি কাজে লাগানোর চেষ্টা চালায়। সারাদেশে সৃষ্টি হয় অস্থিরতা। উত্তেজনাকর এই পরিস্থিতিতে ‘চাঁদে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছবি দেখা গেছে’ এই গুজব ছড়িয়ে আরও টালমাটাল পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। বগুড়াসহ আরও কয়েক জায়গায় চালানো হয় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে গাইবান্ধা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, সাতক্ষীরাসহ পনেরোটি জেলায়। একের পর এক হরতাল ডেকে, রাস্তাঘাটে অবরোধ সৃষ্টি করে সারাদেশ থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা শুরু হয়। পরিকল্পনা করে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে হামলা চালানো হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ওপর। একই সঙ্গে চলতে থাকে ইন্টারনেটসহ কয়েকটি গণমাধ্যমে ব্যাপক অপপ্রচার। সন্ত্রাসীরা হামলা চালায় মূল ধারার সংবাদকর্মীদের ওপর। প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েই শুরু হয় সংবাদকর্মীদের ওপর হামলা। কয়েকদিনে আহত হয় অন্তত ২০ জন সংবাদকর্মী। শুধু দেশে নয়, এসব সহিংসতার ছবি পাঠিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রচারণা অব্যাহত থাকে। বিরোধী দল দেশে অবস্থিত কূটনীতিকদের দাওয়াত করে তাদের কাছেও সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র অবশ্য শাহবাগ আন্দোলনকে সমর্থন জানায়। তারা এটিকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মডেল বলেও স্বীকৃতি দেয়।
শুধু দু’দিন। এর পরই নিহত রাজীবের ব্লগ থেকে সরিয়ে নেয়া হয় এই সব অপপ্রচার। একজন মৃত ব্যক্তির পক্ষে তার ব্লগে কোন লেখা পোস্ট করা কিংবা সরিয়ে নেয়াও সম্ভব নয়। মৃত্যুর পর রাজীবের ব্লগে কারা এই সব লিখেছে আবার কারাইবা এগুলো সরিয়ে নিয়েছে তা অনুসন্ধানে কাজ করছে এ সম্পর্কিত কমিটি এবং একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, কেউ যদি ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ করে থাকে তবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। পরে এগুলো তদন্তের জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়। প্রজন্ম মঞ্চের নেতারা আরও স্পষ্ট করে বলেন, তাঁরা কোনভাবেই ধর্মের বিরুদ্ধে নন। ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলা দূরের কথা তাঁরা কোন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধেও কথা বলছেন না। তাঁরা দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দেখতে চান। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখতে চান। তাঁদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের জন্য তাঁরা প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রতিও আহ্বান জানান। এসব আহ্বান এবং মূল ধারার গণমাধ্যমে সংবাদ পরিবেশনে এক সময় ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ভুল ভাঙতে শুরু করে। একটি গোষ্ঠী তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা করছে এটি তারা বুঝতে পারেন। ইসলামী দলগুলোর মধ্যে এ নিয়ে বিভেদ শুরু হয়। একটি অংশ জামায়াত এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। অন্য অংশকে জামায়াত ধরে রাখার চেষ্টা করে নানা কৌশলে। এখনও কিছু কিছু গোষ্ঠী ধর্মীয় অনুভূতি কাজে লাগিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার ঘোষণা অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া আরও নতুন পরিকল্পনা শুরু করেছে বিএনপি-জামায়াতের যৌথ পরিকল্পনাকরীরা। পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই সম্প্রতি শিশুদের খাওয়ানো ভিটামিন ‘এ’ নিয়ে ব্যাপক গুজব ছড়ানো হয়। এবার ধর্ম নয়, মানবিকতায় আঘাত দিয়ে পরিস্থিতি সৃষ্টির অমানবিক চেষ্টা। গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে প্রিয় সন্তানদের নিয়ে মানুষ ছুটতে থাকে স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দিকে। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে বার বার আবেদন জানানো হয়, ভিটামিনটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শিশু স্বাস্থ্য উপযোগী একটি ওষুধ। এতে কোন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই। তবুও বাবা-মায়ের অবুঝ মন। তারা সন্তানকে নিয়ে কোন ধরনের ঝুঁকিতে যেতে চায় না। তাই ছুটে চলেছে স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দিকে। পরিকল্পনাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল যদি মানুষের এই আতঙ্ক কাজে লাগিয়ে কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যায়।
শাহবাগে তরুণদের আন্দোলন নিয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মনোভাব শুরুতে নেতিবাচক ছিল না। এদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার দলীয় কোন সিদ্ধান্তও ছিল না। শাহবাগ নিয়ে নেতারা যার যার মতো বক্তব্য দিয়েছেন। জামায়াত ঘেঁষা নেতারা শাহবাগের আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন তুললেও অনেক বিএনপি নেতাই তারুণ্যের জাগরণকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন। কোন কোন নেতা এই আন্দোলনকে স্বাগতও জানিয়েছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি তরুণরা যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি যুক্ত করেন এমন আহ্বানও এসেছে বিএনপির পক্ষ থেকে। তরুণরা স্পষ্ট বলেছেন, তাঁরা কোন রাজনীতির দিকে যেতে চান না। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদ-ের রায় হলে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির করে সারাদেশ সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। একই দিন সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। পহেলা মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁদের অবস্থান স্পষ্ট করেন তিনি। এর পরই শুরু হয় বিএনপির নতুন ধারার আন্দোলন। প্রথমে মানুষ হত্যার অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর ডাকা হরতালে সমর্থন। পরে আঠারো দলের ব্যানারে নিজেরাই হরতাল ডাকেন। পরের হরতাল ডাকেন নিজেদের কর্মসূচীতে বোমা ফাটিয়ে, পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে, গাড়িতে আগুন ধরিয়ে। সর্বশেষ গত ১১ মার্চ দলীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বোমা বিস্ফোরণের প্রতিবাদে পরদিন অর্থাৎ ১২ মার্চ হরতাল ডাকা হয়। পুলিশ বিএনপি কার্যালয়ে প্রবেশ করে বোমা উদ্ধার এবং নেতাদের গ্রেফতার করলে আবারও ১৮ এবং ১৯ মার্চ দু’দিনের হরতাল দেয়া হয়। রাজধানীতে ২১ মার্চ আরও একদিন হরতাল ঘোষণা করে জেলা বিএনপি। এভাবে শুরু হয় বিএনপির নতুন ধারার আন্দোলন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন