বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০১৩

খালেদা জিয়ার বগুড়া-ভাষণ : ‘রাজনীতি’ নাকি অপরাজনীতি

এস আর চৌধুরী
বাংলাদেশের বিয়াল্লিশতম স্বাধীনতা বার্ষিকীতে স্বাধীনতার আনন্দ-গৌরবের অংশভাগী সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা জানাই। বিয়াল্লিশ বছর পেরিয়েও স্বাধীনতার ইতিহাস-বিকৃতি কিংবা কলঙ্কিত করার অপচেষ্টার অবসান হয়নি এখনো। এবারের স্বাধীনতা দিবসের প্রত্যাশা : স্বদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা সম্পর্কে বিভিন্ন মহলের সব সংশয় হোক অবসান।

দুই. বেগম জিয়া অনেক সময় এমন সব কথা বলেন, যা সামাল দেয়া তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের জন্যও বিব্রতকর হয়ে দাঁড়ায়। তখন একটা মজার বিষয় লক্ষ্য করা যায়। অনুগামীরা সেই কথার সমর্থনে যুক্তি দাঁড় করান, যুক্তিবাদীরা বলেন কথাটি দলনেত্রী ‘রাজনৈতিক অর্থে বলেছেন’ এবং তাতেও সামলানো না গেলে দলের দায়িত্বশীলেরা বলেন, তিনি আমন কথা বলেননি, পত্রিকায় ভুল লেখা হয়েছে। রাজনীতির নামে যখন যা ইচ্ছাÑ তাই বলা চলে কিনা কিংবা একসঙ্গে বিভিন্ন পত্রিকাতেই ‘একই রকম ভুল’ করা সম্ভব কিনা, প্রশ্ন তুলে আদৌ ফায়দা নেই, এমন চেষ্টা অতীতে বহুবার অকার্যকর প্রতিপন্ন হয়েছে।

তবে বিস্ময়-দুঃখে হতাশ হতেই হয়, যখন দেখা যায়, বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান জাতীয় দৈনিকের প্রধান খবরেই নিজস্ব বিশ্লেষক-প্রতিবেদক বলেন : ‘স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ নাকি ২৭ মার্চ, এ নিয়ে বিতর্ক চলছেই’। সহজলভ্য অসংখ্য তথ্যপ্রমাণ অস্বীকার করতে চাইলেও সংবিধান-স্বীকৃত তথ্যনির্দেশ অবশ্যই লঙ্ঘনীয় নয়। বাংলাদেশের মূল সংবিধানে বলা হয়েছিল : “আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের’ (জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের) মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি”। উল্লেখ্য যে, উদ্ধৃতি চিহ্নের অন্তর্ভুক্ত অংশটুকু ব্র্যাকেটবদ্ধ শব্দাবলীর দ্বারা প্রতিস্থাপন করেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম সেনা-শাসক জিয়াউর রহমান। কিন্তু তিনি এমন কোনো কথা বলেননি যে, স্বাধীনতা দিবস ২৬ অথবা ২৭ মার্চÑ এ সম্পর্কে বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে। এটা পরবর্তী সময়ের দূরভিসন্ধিমূলক অপচেষ্টা।

এমন অপচেষ্টার ভিত্তিতেই বেগম জিয়া, যেমন আগেও বলেছেন, তেমনি বগুড়ায় সাম্প্রতিক বিএনপি-জামাত সমাবেশেও বলেছেন, আওয়ামী লীগ নয়, স্বাধীনতার ‘ঘোষণা দিয়েছেন জিয়াউর রহমান’। বহু পুরোনো এ কাসুন্দি ঘেঁটে ‘রাজনীতির দুর্গন্ধ’ ছড়ানো নিতান্তই অর্থহীন। তবে এটুকু স্মরণ করা যেতেই পারে, জিয়া কথায়-লেখায় কোথাও ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’র দাবি করেননি। বরং নিজেই ‘একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামে লিখেছিলেন যে, ২৭ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ছটার দিকে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে এসেছিলেন। উক্ত বেতার কেন্দ্রের সংগঠক-কর্মী বেলাল মহম্মদ ঐদিন পটিয়া থেকে জিয়াকে নিয়ে এসেছিলেন। সেদিন ‘অন বি হাফ অব আওয়ার গ্রেট লীডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বলে জিয়া ঘোষণাটি ‘পাঠ’ করেছিলেন। বেলাল মহম্মদের কথা : ঘোষণা পাঠ যে কেউ করতে পারে, ‘আমিও করেছিলাম’, কিন্তু ‘ঘোষণা প্রদানের জন্য অধিকার’ থাকতে হয়, যা ছিল একমাত্র বঙ্গবন্ধুর।

তিন. বগুড়ার জনসভায় বেগম জিয়া সেনাবাহিনীর উদ্দেশে বলেছেন : “যে দেশের সেনাবাহিনী বিদেশে শান্তিরক্ষার জন্য কাজ করছে, সে দেশে যদি শান্তি না থাকে তাহলে বিদেশীরা বলবে, তারা কীভাবে শান্তি রক্ষার কাজ করবে? কাজেই চিন্তার বিষয় আছে। আপনাদের (সেনাবাহিনীর) সবাইকে এটা চিন্তা করতে হবে” (প্র. আ. ২৫ মার্চ)। বক্তব্যটি যে সরল-সহজ কিংবা সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য নয় তা ইতোমধ্যেই প্রকট হয়ে উঠেছে নানাজনের নানা কথায়। দুজন প্রাক্তন সেনা প্রধানের একজন কে এম সফিউল্লাহ বলেছেন, “রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অধীনে সেনাবাহিনী কাজ করে।ৃতাদের উসকানি দেয়া ঠিক না।ৃরাষ্ট্রের নির্দেশ ছাড়া সেনাবাহিনী নিজেরা কিছুৃকরা ঠিকও না।ৃসেনাবাহিনীৃরাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকবে” (প্র. আ. ২৬ মার্চ)। অপরদিকে, বেগম জিয়ার কথাগুলো ঠিক হয়নি উপলব্ধি করেই মাহবুবুর রহমানকে বলতে হয়েছে : বেগম জিয়া “যা বলেছেন, তা রাজনৈতিক বক্তব্য, মাঠে বলেছেন” (প্রাগুক্ত)। অর্থাৎ রাজনৈতিক বক্তব্যে সেনাবাহিনীর মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকেও মন-পসন্দ কায়দায় জড়িয়ে ফেলা যায়? ‘মাঠের কথা’ বলেই কি দায়িত্বশীল ব্যক্তিও দায়িত্বহীন উক্তির ঝুঁকি নিতে পারেন?

তথাপি ‘মাঠের কথা’য় শেষ-রক্ষা হচ্ছে না ভেবেই ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে বলতে হয়েছে, “খালেদা জিয়ার বক্তব্য পত্রিকায় ‘ভিন্নভাবে’ এসেছেৃসেনাবাহিনীরও দেশের প্রতি কর্তব্য আছেৃসেনাবাহিনী সময়মতোই তাদের দায়িত্ব পালন করবেÑ এ বক্তব্য দেননি” (প্র. আ. ২৬ মার্চ)। বিভিন্ন পত্রিকা একসঙ্গে অমন ভুল করে ফেললো! তা না হয় হলো কিন্তু যারা সরাসরি বিভিন্ন টিভি-চ্যানেলে খবরটি দেখেছেন এবং শুনেছেন, তারাও কি ভুল করে বসে আছেন? সৌমিত্র-অভিনীত একটি বাংলা সিনামার কথা মনে পড়ছে, খুনের প্রত্যক্ষদর্শী এক নিরীহ শিক্ষককে সন্ত্রাসীরা হুমকি দিয়েছিল, মনে রাখবেন, আপনি এ ঘটনার কিছুই দেখেননি। বাংলাদেশে তো এখন সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েমেরই চেষ্টা চলছে। সে কথা রেখে বরং ফেরা যাক বেগম জিয়ার সংশ্লিষ্ট ভাষণের কথায়, যা ‘মেঠো কথা’ বলে উড়িয়ে দেয়া চলে না।

বেগম জিয়া বলেছেন, “সেনাবাহিনীরও দেশের প্রতি কর্তব্য আছে। তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে না।ৃ সেনাবাহিনী সময়মতোই দায়িত্ব পালন করবে”। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে ‘সঠিক সময় নির্ধারণ’ করবে কে, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সেনাবাহিনী নাকি বেগম জিয়া নিজে? এ বিষয়ে দেশজুড়েই প্রাজ্ঞ এবং দায়িত্বশীল মহলে বিতর্ক চলছে। আমি শুধু সাধারণভাবে দুটি দিকের কথা বলতে চাই। কোনো সভ্য দেশেই সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী ইচ্ছেমতো ‘সময় নির্ধারণ’ করে নিজস্ব উদ্যোগে ব্যারাকের বাইরে দায়িত্ব পালনে জড়াতে পারে না। তাতে রাষ্ট্র এবং সরকারের কর্তৃত্ব অস্বীকার করা হয় বলেই সংবিধান লঙ্ঘিত হয়। অতীতের বাংলাদেশে অমন কাজই করেছিলেন জিয়া-এরশাদ এবং উভয়েই আদালতে নিন্দিত হয়েছেন। অপরদিকে সেনাবাহিনী যদি, যে কোনো কারণেই হোক-না-কেন, কর্তৃত্বশীল সরকারি নির্দেশ ছাড়া অন্য কারো ইশারা-নির্দেশে ক্রিয়াশীল হয়, তাহলে একইসঙ্গে সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা এবং সংবিধান লঙ্ঘিত হবে। সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ভূমিকা পালনের আরেকটা ‘পরোক্ষ পথ’, যেমনটি করেছিলেন মঈন-ইউ আহমদ। সে অভিজ্ঞতা জনগণ, রাজনীতিবিদ কিংবা রাজনৈতিক দল কারো জন্যই সুখকর হয়নি। স্পষ্টতই অধিকতর বেকায়দা-ক্ষতি হয়েছিল বিএনপিরÑ এ সত্য অনস্বীকার্য। সব মিলিয়ে বলা চলে, ভবিষ্যতের বাংলাদেশে অমন কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক। এটা খোদ সেনাবাহিনী, দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল, এমনকি জনগণও চাইতে পারে না।

বেগম জিয়ার ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে এ কথাও বলা হয়েছে যে, “ক্ষমতা ছাড়ার পর পালিয়ে বাঁচতে পারবেন না। পৃথিবীর যেখানেই থাকেন না কেন খূজে বের করা হবে”। ভালো কথা, লুটেরা-খুনি-দুর্নীতিবাজরা পৃথিবীর যেখানেই পালাক না কেন, খুঁজে এনে বিচার করা উচিত। শেখ হাসিনা দুর্নীতি-সন্ত্রাস অতীতে করেছেন অথবা বর্তমানে করছেন কিনাÑ সেটা আমজনতার জানার কথা নয়। তবে সকলেই জানে যে, শেখ হাসিনাও তার পিতার মতোই ‘পালানোর রাজনীতি’তে আস্থাশীল নন। কেউ কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভুলে গেলেও জনগণ সহজেই স্মরণ করতে পারবে, ফখরউদ্দীন-মঈন ইউর সেনা প্রভাবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে বিদেশ থেকে দেশে আসতে দিতে চায়নি। কিন্তু তিনি জোর করে এসেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন আর বেগম জিয়া দেশের বাইরে চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন কিন্তু যেতে দেয়া হয়নি। তিনিও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরবর্তী ঘটনাবলীর উল্লেখ এখানে অপ্রাসঙ্গিক।

চার. বিএনপি-নেতৃবৃন্দ বহুবার ঘোষণা দিয়েছেন, তাদের ‘আন্দোলনকে তীব্র থেকে তীব্রতর করা হবে’। অমন একই ঘোষণার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দাবিও উচ্চারণ করেছেন। সকলেই স্মরণ করতে পারবেন, বর্তমান সংসদীয় মেয়াদে তাদের সংসদ বর্জন এবং আন্দোলনের শুরু হয়েছিল নিজেদের জন্য সামনের সারিতে অধিক সংখ্যক আসনের দাবিতে। অতঃপর সেনানিবাসের ভেতরে বেগম জিয়ার বাসস্থান রক্ষা, পুত্রদ্বয়ের বিরুদ্ধে সরকারের ‘মিথ্যা মামলা’ প্রত্যাহার ইত্যাদি নানা ইস্যুর হরতালের পর সামনে আনা হয়েছিল ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ দাবিটি। এরপর ‘যুদ্ধাপরাধী বিচার’ শুরু হলে আবার জামাতের প্রতি কখনো নৈতিক কখনো সক্রিয় সমর্থন কখনোবা জামাতের সহযোগী হয়ে নিজেরাই হরতাল ডেকে সম্যক রূপেই ‘হরতাল-কাম-সংসদ বর্জন’ অব্যাহত রাখলেন। অবশ্য মাঝেমাঝেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত দাবিটি তোলা হয়েছে। জনগণ তাই এতোকাল সংশয়ে ছিল, বিএনপির প্রকৃত দাবিটি কি?

এবার বগুড়া-ভাষণে বেগম জিয়া সকলের সংশয়-মুক্তি ঘটিয়েছেন : “এতদিন আমরা বলেছি, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই। এখন আর তা বলছি না। আমরা এই সরকারের পতন চাই। এখন থেকে সরকার পতনের আন্দোলন চলবে” (প্র. আ. ২৫ মার্চ)। ভালো কথা, আর কোনো আড়াল রইলো না। কিন্তু একটা প্রশ্ন বড় প্রকটভাবেই সামনে এসে গেলো। যদি ‘সরকার-পতন’ ঘটানো সম্ভবও হয়, বিএনপির ফায়দাটা কি? সামন্তযুগে রাজা-বাদশাকে হটিয়ে কিংবা হত্যা করে সিংহাসন দখল করা যেতো। কিন্তু এ যুগে ‘সংবিধান’ এবং ‘গণতন্ত্র’ ইত্যাদি বিবিধ বিধিনিষেধের কারণে নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো কায়দায় হত্যা-অপসারণ ঘটিয়ে কেউ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারে না।

স্মরণীয় যে, বাংলাদেশের বিয়াল্লিশ বছরের ইতিহাসে দুটি মাত্র ‘সরকার-পতন’ ঘটেছে : প্রায় নবছর স্বৈর-শাসন চালাবার পর (১৯৯০) এরশাদ সরকারের আর ‘অবৈধ-অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনে ক্ষমতাসীন’ (১৯৯৬) বেগম জিয়ার সরকারের এক মাসেরও কম সময়ে। এ কথাও স্মরণীয় যে, উভয় ক্ষেত্রেই পরবর্তী সরকার গঠনের লক্ষ্যে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯০ কিংবা ১৯৯৬-এর পরিস্থিতি এখন নেই। সুতরাং সবদিক আগে ভেবে তবেই ‘সরকার পতন’ ঘটাবার আন্দোলনে নামা সমীচীন হবে। অন্যথায় বিএনপি-জামাতের ‘তীব্র থেকে তীব্রতর আন্দোলন’ বুমেরাং হতে পারে।

২৬ মার্চ, ২০১৩
এস আর চৌধুরী : কলামিস্ট।
ভোরের কাগজ : বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন