শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০১৩

গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষে বিপক্ষে

রাহমান চৌধুরী
গণজাগরণ মঞ্চে যেদিন প্রথম যাই, সেদিন খুব ভিড় ছিল। কিছুটা সময় চারদিক হেঁটে একপাশে দাঁড়িয়েছিলাম। মঞ্চের এদিক সেদিক থেকে নানান ধরনের সেøাগান ভেসে আসছিল। কিছু কিছু সেøাগান শুনে সত্যি বলতে অসুস্থ বোধ করছিলাম। সেরকম একটা সেøাগানের অংশবিশেষ ‘জবাই করো’। মৃত্যুদণ্ড চাওয়া আর ‘জবাই করো’ শব্দ দুটির মধ্যে পার্থক্য আছে। যদি কেউ একাত্তরের সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধীকে আমার সামনে এনে জবাই করতে বলে, সেটা কি আমার পক্ষে করা সম্ভব হবে? প্রশ্নই ওঠে না। মানুষকে জবাই করা সুস্থ সংস্কৃতি নয়। প্রথম ধারণা ছিল, জবাই করা শব্দটি নিয়ে শুধু আমার যত আপত্তি! পরে দেখলাম আমার পরিচিত এবং বন্ধুদের অনেকেরই আপত্তি ছিল শব্দটি নিয়ে। গণজাগরণের মঞ্চের এক নেতার মুখেও এই আপত্তির কথা শুনেছিলাম। চিকিৎসক আমার এক বন্ধু এবং তার চিকিৎসক স্ত্রী দুজনেই গণজাগরণের মঞ্চে দীর্ঘসময় কাটাতেন কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসা দেবার জন্য। তিনি জবাই শব্দটি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে লাকিকে বলেছিলেন। তিনি জানান, লাকি তাঁর সঙ্গে একমত হন। পরে তৃতীয় মাত্রার একটি আলোচনায় এই শব্দটি নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের জনাব দুদু আপত্তি তোলেন।
তার এই আপত্তির সঙ্গে আমি একমত। তবে বিনীতভাবে বলতে চাই, গণজাগরণের এটাই হলো স্বাভাবিক প্রবণতা। মানুষের ক্রোধ নানাভাবে সেখানে প্রকাশ পায়। নানারকম মানুষের মিলনক্ষেত্রে এটাই হয়ে থাকে। মানুষের ভিতরে জমে থাকা ক্রোধ নানাভাবে সেখানে পাখা মেলে। ইতিহাসে দেখা যায়, এটাই হচ্ছে গণআন্দোলনের নানা প্রবণতার একটি দিকÑক্রোধ সেখানে বাধা মানতে চায় না। ব্রিটেনে সেই যন্ত্র ভাঙার আন্দোলনের কথা অনেকের মনে পড়বে, শ্রমিকরা মনে করেছিল যন্ত্র এসে তাদের বেকার বানিয়েছে। সেজন্য যন্ত্র ভাঙার আন্দোলন শুরু করেছিল তারা, বুঝতে পারেনি এই যন্ত্র তাদের পরিশ্রমকে লাঘব করতে পারে।
ইতালির একজন বিচারক উগো বেটি কয়েকটি নাটক লিখেছিলেন বিশ শতকে। বিপ্লবের পর তিনি মানুষের ক্রোধকে বিচার করেছেন এইভাবে যে, ‘বিদ্রোহীরা প্রাসাদের সবকিছু ভেঙে তছনছ করছিল, নিষ্ঠুরতা করছিল তবুও তাদের খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল’। সারা পৃথিবীতেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের ক্রোধ প্রথম প্রকাশ পায় অসঙ্গতরূপে, অসংগঠিতভাবে। দূরের মানুষরা তখন তাদের ভুল বুঝে থাকে। ক্ষুধার্ত আফগানিস্তানের মানুষের বৃহত্তম বুদ্ধের মূর্তি ভাঙাটাকে তাই সারা বিশ্ব ভুল বুঝেছিল। কারণ আফগানিস্তানের মানুষের প্রতি বিশ্ব সহানুভূতি নিয়ে তাকায়নি। যারা মূর্তি ভাঙে তাদের রাগটা ছিল, বিদেশিরা একটা পাথরের মূর্তি রক্ষা করার জন্য প্রচুর টাকা ঢালছে, অথচ তাদের শিশুরা যখন ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে তারজন্য অর্থ সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না। ক্ষুদিরাম যখন ইংরেজদের গাড়িতে বোমা মারে অনেক চিন্তাবিদ মনে করতে পারেন সেটা একটা উগ্র ঘটনা। মনে করতে পারেন এটা ভুল রাজনীতি। কিন্তু ইংরেজদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ক্ষুদিরামের ক্রোধের প্রকাশ ঘটে ঐরকম বোমা মারার মধ্য দিয়েই। ইতিহাসবিদরা যখন তাঁর ভুল ঠিক নিয়ে কথা বলছে, লোককবিরা তাঁকে নিয়েই গান বাঁধছে। ক্ষুদিরাম, সূর্যসেনরা আজও সাধারণ মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছেন। কারণ সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত লড়াইয়ের একটা ধরন রয়েছে। বহু বিজ্ঞ ব্যক্তিই সে আবেগটাকে ধরতে পারেন না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বহু সমাজতান্ত্রিক নেতাও জনগণের সেই আবেগকে ধরতে না পেরে পরবর্তীতে সম্পূর্ণ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। সেজন্য মার্কসবাদীরা মনে করেন, জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন ভুল পথে গেলেও তাদের সঙ্গে থাকতে হবে। সেই আন্দোলনের সঙ্গে থেকেই তার সমালোচনা করতে হবে। জনবিচ্ছিন্নতাকে মার্কসবাদ সমর্থন করে না।
গণজাগরণের মঞ্চ ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন করছে কিনা সে প্রশ্ন তোলা যায়। করাটা দরকার। ফরহাদ মজহার, যিনি গণজাগরণের মঞ্চকে সরকারের দলীয় আন্দোলন মনে করছেন, তিনিও লিখছেন, ‘একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। মানবতার বিরুদ্ধে তাদের অনেকে জড়িত ছিল এবং তার বিচার হওয়া দরকার, এ ব্যাপারে কোনোই সংশয় বা সন্দেহ নাই।’ গণজাগরণের মঞ্চ তো সেই তাদেরই বিচার চাইছে। কিন্তু সরাসরি তারা ফাঁসির দাবি করাতে অনেকেই মনে করছেন, তারা ন্যায় বিচার চাইছে না। ফাঁসি চাইছে। চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার এবং জাতীয়তাবাদী দলের জনাব দুদুসহ আরও অনেকে এই কথা বলেছেন। নিশ্চয় তাঁদের কথার যুক্তি রয়েছে। ফাঁসি দাবি করা মানে তো বিচারের আর প্রয়োজন নেই। বিচারের রায় তো তারাই দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ঘটনার প্রেক্ষাপট বাদ দিয়ে শুধু গণজাগরণের মঞ্চের দাবির দিকে তাকালে হবে না। স্মরণ রাখতে হবে, একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচারের কথা বলা হলেও সকলকে এই বিচারের আওতায় আনা হয়নি। প্রধান কয়েকজনকে আনা হয়েছে। একাত্তর সালের সরকারি পত্রিকার পাতা খুললেই তাদের অনেকেরই অপরাধ নিঃসংশয়ে ধরা পড়ে। গণহত্যাকে, পাকবাহিনীর অত্যাচারকে তারা যে সমর্থন যুগিয়েছে, মদদ দিয়েছে এবং স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে তা সরকারি পত্রিকার পাতায় পাতায় সুস্পষ্ট। ভিন্ন কারও পত্রিকায় নয়, পাক-সরকার সমর্থিত সরকারি পত্রিকার মুদ্রিত খবরে তাদের অপরাধ বিবৃত। পাক-বাহিনীর সঙ্গে তাদের দহরম-মহরমের ছবিও রয়েছে। সেখানে যা রয়েছে তাতে মৃত্যুদণ্ডের চেয়ে বড় শাস্তি থাকলে সেটাই তাদের প্রাপ্য।
কিন্তু বিচারের নামে কী ঘটল? পলাতক আসামি আবুল কালাম আজাদকে দেয়া হলো মৃত্যুদণ্ড। খুব আশ্চর্য এটার বিরোধিতা কিন্তু জামায়াত-শিবির করল না। পরের বিচারে বহু খুনের আসামি কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাগার হলে গণজাগরণের মঞ্চ তা মেনে না নিয়ে ফাঁসি দাবি করে। দাবিটা সঙ্গত হতো ফাঁসি না বলে সর্বোচ্চ শাস্তি বললে। নিদেনপক্ষে ফাঁসি না বলে মৃতুদণ্ড বললে। কিন্তু আগেই বলেছি সাধারণ মানুষের আইনের ভাষা জানা নেই, তাদের ক্ষোভের ভাষায় তারা ফাঁসি বলেছে। কারণ বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ফাঁসি দিয়েই। এই দাবি কিন্তু বিচার ব্যবস্থার পাশাপাশি সরকারের প্রতিও অনাস্থা। যদি কাদের মোল্লার অপরাধ পর্বত প্রমাণ না হতো, আর গণজাগরণের মঞ্চ তার ফাঁসি দাবি করত, তাহলে সেটা ন্যায়সঙ্গত হতো না। কাদের মোল্লার অপরাধ আদালতেই প্রমাণিত হয়েছে, গণজাগরণের মঞ্চ তা প্রমাণ করেনি? প্রশ্নটা হলো আদালতে যতটুকু অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে, তাতে তার মৃত্যুদণ্ড চাওয়া যৌক্তিক কিনা। যদি যৌক্তিক হয় গণজাগরণের মঞ্চের বিরুদ্ধে আমাদের কিছুই বলার নেই। বরং প্রশংসা করার আছে, হাজার মানুষের আবেগকে তারা সম্মান জানিয়ে পথে নেমেছে বলে। গণজাগরণের মঞ্চ সাঈদীর রায়কে প্রভাবিত করেছে বলে যারা মনে করেন, তাদের প্রতি বিনীতভাবে ভিন্ন একটি প্রসঙ্গ এখানে অবতারণা করার রয়েছে। সব সরকারের আমলেই দেখা গেছে, যখন বিরোধী দলের কোনো নেতাকর্মীকে ধরা হয়, তখন নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করে পোস্টার দিয়ে চারদিক ভরে ফেলা হয়। দলীয় বহু খুনের আসামির মুক্তির জন্যও এই ধরনের পোস্টার দেয়া হয়। সেটা কি তাহলে বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করা নয়? সেইসব পোস্টারে তো বিচার না চেয়ে সরাসরি নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করা হয়।               
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের দুদু সাহেব তৃতীয় মাত্রার এক আলোচনায় বলেছেন, গণজাগরণ আর সরকার কখনো এক জায়গায় থাকতে পারে না। কারণ গণজাগরণ হয় সরকারের বিরুদ্ধে। তিনি ভুল কিছু বলেননি। সাধারণত ব্যাপারটা তাই। কিন্তু সত্য সবসময় একরকম হয় না। দিল্লির সাম্প্রতিককালের একটি ঘটনার দিকে চোখ ফেরানো যেতে পারে। গত ডিসেম্বরে দিল্লিতে বাসের মধ্যে এক ছাত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জনগণ রাস্তায় নেমে এলে সরকার তাকে সমর্থন জোগায়। দিল্লির সে গণজাগরণটি ছিল বিরাট। যখন ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটে তার পরপরই আমি কলকাতায় গিয়েছিলাম। সেখানকার দূরদর্শনে-পত্রপত্রিকায় দেখেছিলাম দিল্লির মানুষ কীভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিল। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী প্রথমে ঘটনার দায় এড়াতে একটু বিরূপ মন্তব্য করেন, সেজন্য তাঁকে একবার সমাবেশে কথা বলতে দেয়া হয়নি। কিন্তু পরে যে-কোনো কারণেই হোক বিরূপ সমালোচনা বাদ দিয়ে তিনি আন্দোলনের পক্ষ নেন। তিনি অন্তত এটা বুঝেছিলেন দিল্লি হচ্ছে তার ভোটবাক্স। তিনি লক্ষ লক্ষ লোকের ভোট হারাতে চাননি। আর কেন্দ্রীয় সরকার যেহেতু জনতার আন্দোলনকে সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন দিয়েছিল, দিল্লি সরকারের সমর্থন না দিয়ে উপায় ছিল না। সরকার আর জনতা সেখানে এক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না, প্রচ্ছন্নভাবে এই আন্দোলন দিল্লি সরকারের বিরুদ্ধেই ছিল। ঘৃণ্য অপরাধীরা সরকারের মদদপুষ্ট না হলে এই ঘটনা যে ঘটানো সম্ভব নয় সেটা সাধারণ জনগণ বুঝেছিল। একই সঙ্গে দিল্লির আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারের ব্যর্থতা এই আন্দোলনে প্রকাশ পেয়েছিল। জনগণের দিক থেকে তাই দিল্লি সরকারের কাছে কড়া দাবি ছিল, অপরাধীদের গ্রেফতার করার এবং শাস্তি দানের। সরকার এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে যেতে সাহস করেনি।
গণজাগরণের মঞ্চের দিকে তাকালে একই বিষয় লক্ষ্য করা যাবে। কাদের মোল্লার রায়ের পর জনগণ যখন মাঠে নামল সেটা ছিল প্রচ্ছন্নভাবে সরকারের বিরুদ্ধেই। জনগণ যদি মনে করত রায়কে প্রভাবিত করা হয়নি তাহলে তারা মাঠে এত জোরালোভাবে নামত কিনা বলা যাচ্ছে না। জনগণের মনে হয়েছে, সরকারের দিক থেকে রায়কে প্রভাবিত করা হয়েছে এবং সরকারের সঙ্গে যে জামায়াত-শিবিরের বোঝাপড়া হয়েছে এইরকম একটা আলোচনা মাঠে ছিল। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল হরতাল ডাকলে সেখানে সরকারি আক্রমণ হয় আর জামায়াত-শিবির সফলভাবে হরতাল করছে, নাশকতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছেÑএর থেকে এটা বাজারে চালু খবর ছিল যে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সরকারের আঁতাত ঘটেছে। প্রথম রায়ে যাকে ফাঁসি দেয়া হয় সে তখন পলাতক। সরকার তাকে পালাতে সাহায্য করেছে এই কথাও বাজারে চালু ছিল। বহুজন আগেই থেকেই এরকম বলে আসছিলেন যে, সরকারের প্রভাবে কাদের মোল্লা এবং অন্যদের ফাঁসি হবে না। প্রথম যাবজ্জীবন দেয়া হবে, পরে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ঘোষণা করা হবে। সত্যি হোক আর মিথ্যা হোক, যখন হাওয়ায় এসব খবর প্রচারিত হচ্ছিল ঠিক তেমনি একটি সময়ে কাদের মোল্লাকে ফাঁসি না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাগারে দেয়া হলে জনগণ বা তরুণ সমাজ সরকারের বিরুদ্ধে একটি আন্দোলনে নামে। সরকার উৎখাতের আন্দোলন সেটা ছিল না ঠিকই, কিন্তু ক্ষোভটা ছিল সরকারের বিরুদ্ধেই। এই তরুণ সমাজ নিজেরা সংগঠিত ছিল না বলেই তারা খুব কড়া কর্মসূচি না দিয়ে শাহবাগে অবস্থান নেয়। সরকার অন্তত এটা বুঝেছিল, এই তরুণ সমাজের উপর আক্রমণ চালালে ফল ইতিবাচক হবে না। সরকার তখন আন্দোলনকে সমর্থন জানানো এবং নিজেদের পক্ষে আনার পরিকল্পনা নেয়। সরকারি দলের দু-চারজন বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে নিজেদের দায় এড়াতে আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করার জন্য মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দিতে চায়। কিন্তু গণজাগরণের তরুণদের পক্ষ থেকে তাঁদের মঞ্চে উঠতে দেয়া হয় না। শাহবাগ আন্দোলন সরকার দ্বারা প্রভাবিত হলে এইরকম ঘটনা ঘটত না।
বহুজন গণজাগরণ মঞ্চকে ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। সম্ভবত সেটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ধর্মনিরপেক্ষতা আর ইসলাম বিরোধিতা এক কথা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতার সহজ ব্যাখ্যাটি হচ্ছে, রাষ্ট্রধর্ম পালনে কাউকে পৃষ্ঠপোষকতা করবে না, বাধাও দেবে না। ধর্মপ্রাণ একজন মানুষের ধর্মীয় আচার-আচরণ পালনে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা কি দরকার আছে? ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটি ভারতে সম্রাট আকবর প্রথম প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ আইনি কাঠামো ও ধর্ম সম্পর্কে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতার জন্য একটি আনুষ্ঠানিক ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রের একটি কর্তব্য ছিল এটি সুনিশ্চিত করা, যাতে ধর্মের কারণে কোনো ব্যক্তির জীবনে হস্তক্ষেপ করা হবে না এবং প্রত্যেকে তার নিজের মতো ধর্ম গ্রহণ করতে পারবে। বিভিন্ন ধর্মের ভালো দিকগুলোকে সংকলিত করে দীন-ই-ইলাহি প্রবর্তন করার প্রয়াস সত্ত্বেও আকবর একজন খাঁটি মুসলমানই থেকে গিয়েছিলেন। গণজাগরণের মঞ্চের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষের বিরাট অংশটিও ধর্মপ্রাণ মুসলমান। গণজাগরণ মঞ্চের ত্রুটিগুলো ধরা পড়েছে অন্যত্র। মূল অপরাধীদের বাদ দিয়েও বিভিন্নজনের সঙ্গে তারা বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। বিরাট জনসমর্থন পেয়ে একসময়ে তাদের মধ্যে কিছুটা দম্ভ দেখা দেয়Ñমনে হতে থাকে রাষ্ট্রের সকল নির্দেশনা শাহবাগের মঞ্চ থেকেই দেয়া হবে। গণজাগরণ মঞ্চ যখন ‘আমার দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে পঁচিশে ফেব্রুয়ারি বিকেল তিনটার মধ্যে গ্রেফতার করার জন্য সরকারকে সময় বেঁধে দিয়েছিল সেটা অনেকেরই পছন্দ হয়নি। মনে হয়েছিল সেটা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধাচরণ। যখন মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করা হয় বহুজন আহত হয়েছিলেন। সরকারের সঙ্গে গণজাগরণ মঞ্চের নিজেদের কোনো তুলনা করাটাও ঠিক হয়নি। সেটাও অনেক ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করেছিল। গণজাগরণের মঞ্চ থেকে তার মুখপাত্র জনাব ইমরান যে অন্যদেরকে গণতন্ত্রের শিক্ষা নিতে বলেছেন সেটাও একটা ধৃষ্টতা। বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থেকে নয়, গুলির মুখে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছে এবং বহু কর্মী প্রাণ দিয়েছেÑতাদের গণতন্ত্র শিক্ষা দেয়ার অবস্থা এখনো গণজাগরণ মঞ্চের আসেনি।
গণজাগরণের মঞ্চ থেকে বার বার বলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো, সকল মানুষের খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা এবং বৈষম্যহীন সমাজ গঠন। মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি চারটিÑগণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। কিন্তু সমাজতন্ত্রের কথা এখন আর কেউ বলেন না। বহুজন জেনেশুনে সতর্কভাবেই বলেন না, যদিও সংবিধানে তা উল্লিখিত রয়েছে। সমাজতন্ত্র বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তাই হতে পারে না। ফরহাদ মজহার একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন সেটা হলো সর্বক্ষেত্রে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া এবং তার জন্য মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্মান করা। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে তাঁরা চান, বিভিন্ন নৈরাজ্য বা গৃহযুদ্ধের হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য দুই প্রধান দল বা দুই নেত্রীর মধ্যকার সংলাপ। বৃহত্তর মানুষ তাহলে আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এই দুটির কাউকেই বর্জন করতে চাইছে না। ফলে এই দুটি দলের একটিকে বর্জন করার সেøাগান বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরই সেøাগান হবে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থে আইনিভাবে হরতাল বন্ধ করার দাবিও তুলেছে। গণজাগরণের মঞ্চ একটি কাজ করেছে যা রাজনৈতিক দল এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আশ্বস্ত করতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে, হরতালের মধ্য দিয়েই একমাত্র দাবি-দাওয়া জনগণের কাছে প্রচার করা চলে। সরকারকে ভীত করে তোলা যায়। কিন্তু গণজাগরণের মঞ্চ থেকে প্রমাণিত হয়েছে, হরতাল না করে, সহিংসতা বাদ দিয়েও গণআন্দোলন করা চলে, জনগণের কাছে দলের দাবি এবং বক্তব্য পৌঁছে দেয়া যায়।
গণজাগরণের মঞ্চের উপর বর্তমানে সরকারি দলের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ যদি প্রতিষ্ঠা হয়েও থাকে এটা যে সরকারের দ্বারা পরিচালিত হয়নি তারপক্ষে বেশকিছু যুক্তি উপস্থাপন করা যাবে। গণজাগরণের মঞ্চের দাবিগুলোর দিকে নজর দিলেই সেটা প্রমাণিত হবে। শুধু অপরাধীদের ফাঁসির দাবি তারা করেনি একই সঙ্গে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার কথা বলেছে। সঙ্গে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হলো, মৃতুদণ্ডপ্রাপ্তদের প্রতি রাষ্ট্র্রপতির ক্ষমা ঘোষণার অধিকারটি এই ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যাবে না, সংসদে এমন একটি আইন করতে হবে। কিসের জন্য এই শেষ দাবিটি উত্থাপন করা হয়েছে? কারণ আন্দোলনকারীদের সরকারের প্রতি আস্থা বা বিশ্বাস নেই। সরকারের প্রতি আস্থা বা বিশ্বাস থাকলে বর্তমান সরকারের একজন রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে এ ধরনের দাবি উত্থাপন করা হতো না। গণজাগরণ মঞ্চ সম্পর্কে তারপরেও কি কেউ প্রশ্ন তুলবেন যে, এটা সরকারের আন্দোলন। না, এটা সরকারের আন্দোলন নয়, সরকার কয়েকটি বিবেচনায় এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। সরকার বিরাট তরুণ সমাজের ভোট হারাতে চায়নি, তাদের ক্ষোভকে আওয়ামী লীগের বিপরীতে ঠেলে দিতে চায়নি। সরকারের সঙ্গে এই আন্দোলনের যে মূলগত কোনো সম্পর্ক নেই তা আরও বোঝা যাবে জামায়াত নিষিদ্ধকরণ প্রশ্নটিতে। সরকার কি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে বা চাচ্ছে? সরকার বিভিন্নভাবে বলে দিয়েছে সেটা সম্ভব নয়। গত বুধবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেই ইঙ্গিতটি আবারও দিয়েছেন। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চের একটা অন্যতম প্রধান দাবি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা। ফলে আওয়ামী লীগ আর গণজাগরণের মঞ্চ এক নয়-এটা বুঝতে হবে।
নিঃসন্দেহে গণজাগরণ মঞ্চে যেন আর আগের স্বতঃস্ফূর্ততা নেই। মনে হচ্ছে জাগরণের মঞ্চ যেন একটি সংগঠনে রূপ নিতে চাইছে এবং গণচরিত্র হারিয়ে ইমরান একাই নেতা হয়ে উঠছেন। তিনি যেভাবে সকলকে পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ দিয়েছেন সেটা গণজাগরণের মঞ্চের এখতিয়ারে পড়ে না। যতদূর জানি গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তারা সবাই এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে একমত নন। গণজাগরণের পিছনে বেশিরভাগ মানুষ একত্রিত হয়েছে একটি বিশেষ লক্ষ্যেÑসুনির্দিষ্ট কতিপয় মানবতাবিরোধীর বিচারের দাবিতে। কিন্তু নানা হটকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে তাঁরা স্বতঃস্ফূর্ত একটি আন্দোলনকে প্রতিদিনই নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। পুরো দোষটা ইমরানের বা তাঁর সঙ্গীদের নয়। চারদিকের কর্তৃত্বকামী একটি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বসে এটাই হওয়ার কথা। মনে হচ্ছে গণজাগরণের মঞ্চে এখন কিছু প্রভাব বলয় কাজ করছে। কারণ আমরা অনেকেই নিরপেক্ষভাবে তরুণদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রভাব বলয়কে বাধা দিতে চেষ্টা করিনি। কিন্তু ফরহাদ মজহার যেভাবে এটাকে বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার শাহবাগী তামাশা’ তার সঙ্গে অন্তত আমি একমত নই। এই বক্তব্য একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয় যে, এটা জনগণের আন্দোলন ছিল নাÑএকটি দলের আন্দোলন ছিল। নিশ্চয় আমরা অনেকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকায় এই আন্দোলন কখনো না কখনো কারও প্রভাব বলয়ে চলে যেতে পারে। সে দায় আমাদের। কিন্তু মূল সত্য যেন আমরা এড়িয়ে না যাইÑন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু তরুণের উদ্যম এবং ত্যাগকে যেন আমরা ছোট করে না দেখি। গণজাগরণের উদ্যোক্তাদের একজন ইমরান, ইমরানকে যেন আমরা বিপদের মুখে না ঠেলে দেই।     
খুব লক্ষ্য করলে একটি বিষয় স্পষ্ট হবে, গণজাগরণ সম্পর্কে জাতীয়তাবাদী দলের বর্তমান মনোভাব যাই হোক, গণজাগরণ মঞ্চ কিন্তু জাতীয়তাবাদী দলের সমর্থন বিরাটভাবে আশা করে। জামায়াতে ইসলামীর ডাকা হরতালের তারা বিরোধিতা করলেও জাতীয়তাবাদী দলের ডাকা হরতালের তারা বিরোধিতা করেনি। মঞ্চের বিভিন্ন উদ্যোক্তাদের দাবির মুখেই সেটা করা সম্ভব হয়নি। স্পষ্ট তাঁরা জানিয়ে দিয়েছেন, জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে তাদের বিরোধ নেই, তাদের আন্দোলন একাত্তরের অপরাধীদের বিরুদ্ধে। এই যে দেশের অগণিত তরুণ, বিরোধী দলের প্রতি তাকিয়ে আছে তাদের সমর্থনের আশায়, বেগম খালেদা জিয়া বা জাতীয়তাবাদী দল কি তা প্রত্যাখ্যান করবেন? তরুণরাই দেশের ভবিষ্যৎ, তাদের প্রত্যাখ্যান করাটা কি ঠিক হবে? যদি তাঁদের চিন্তার মধ্যে ভুল থাকে, তাঁদের সে ভুল শুধরে দেয়ার জন্য অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসতে হবে। যতই আমাদের মধ্যে বিভিন্ন মতাদর্শগত বিরোধ থাক না কেন, সকলে মিলে আসুন একবার একাত্তরের মানবতাবিরোধী গুটি কয়েক লোকের বিরুদ্ধে এক হই। সমস্যাটার একটা স্থায়ী সমাধান করে ফেলি। বার বার যেন এই প্রসঙ্গটি আমাদের রাষ্ট্রের মূল কাজে আর বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।

Source: http://www.shaptahik.com/v2/?DetailsId=7901

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন