বুধবার, ২০ মার্চ, ২০১৩

শাহবাগ আন্দোলন : দীর্ঘ বিরতির পর কিছু কথা

ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
আমরা যারা সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আছি তাদের কাছে নিশ্চয়ই শাহবাগ আন্দোলন একটি বড় মাইলফলক। আর বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর এ ধরনের আন্দোলন খুবই বিরল। কিন্তু আন্দোলনের সূত্রপাত যেভাবে হয়েছিল আর তার ব্যাপ্তি যেভাবে হচ্ছিল আজ তা হয়তো অনেকটা ফিকে হয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে আমি দায়ী করবো আন্দোলনকারীদের না, দায়ী করবো যারা এই আন্দোলনে পার্শ্বচরিত্রে ছিলেন তাদের। তবে এক্ষেত্রে শুরুতে বলে নেয়া ভালো এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় অর্জন আমরা ইতোমধ্যে অর্জন করে নিয়েছি। তা হলো আমরা বাঙালি মানসের সেই জাগরণ আবার নতুন করে সৃষ্টি করতে পেরেছি।
আমরা এক নতুন প্রজন্মকে চিনলাম যারা আগামী দিনে বাংলাদেশকে গড়ে তুলবে। যারা বাংলাদেশের প্রচলিত দুর্নীতিপরায়ণ আর ক্ষমতার রাজনীতিকে ঘৃণা করে আর দেশকে এই অপশক্তির বাইরে গড়ে তুলতে চায়। তার প্রমাণ এই জাগরণ মঞ্চ সকল ক্ষমতালোভী শক্তিকে বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে। যারা সবকিছুর ঊর্ধ্বে দেশকে নিয়ে ভাবতে চায় আর দেশকে এগিয়ে নিতে চায় গণতান্ত্রিক আর অসাম্প্রদায়িক চেতনায়।

এক. শাহবাগ আন্দোলনকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তি আর ক্ষমতার বাইরের রাজনৈতিক শক্তি নানাভাবে নিজেদের আন্দোলন বা প্রতিপক্ষের আন্দোলন বলে চালানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু খুব সহজ কথা হলো, এই আন্দোলন কি কোনোভাবেই সরকারের পক্ষের আন্দোলন ছিল? এই আন্দোলন কি কোনোভাবেই বিরোধী দলকে ধ্বংস করার জন্য করা হয়েছে? জনগণ এই প্রশ্নের জবাব দেবে। তবে এক্ষেত্রে যারা জামাতকে রক্ষা করার চেষ্টা করবে তারাই এই আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নেবে। তাই এক্ষেত্রে পক্ষ-বিপক্ষ খুবই স্পষ্ট।

দুই. এই আন্দোলনকে যারা নাস্তিকদের আন্দোলন বলছে তারা কারা? তারা কেন বলছে? তাদের উদ্দেশ্য কী? তারা কি সরকারকে প্রভাবিত করছে? তারা কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষের কোনো শক্তি? তারা কি অনেক বড় ভোট ব্যাংক? এমন হাজারো প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে হাজির হয়। এক্ষেত্রে বলতে চাই এই শক্তিরা আজ বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে চলেছে। যারা শাহবাগ আন্দোলনকে নাস্তিকদের আন্দোলন বলছে তারা যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের শক্তি। আর চট্টগ্রামের সমাবেশে তো কাগজের লিখা উঁচিয়ে অনেকে সাঈদীর নিঃশর্ত মুক্তি চেয়েছেন। তাই যদি হয় তবে এই শক্তিকে কেন সরকার এতো নরমভাবে নিচ্ছে? ভোটের হিসাব নাকি ভিন্ন কিছু?

তিন. যুদ্ধাপরাধী দল কেবল জামাত একা ছিল না। নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগের কী ভূমিকা বাংলাদেশের মানুষ তা খুব ভালো করে জানে। আজ কেন আমরা এই মুসলিম লীগ আর নেজামে ইসলামকে নিষিদ্ধের দাবি তুলছি না? আর এই সুযোগে জামাত তার বি টিম দিয়ে সারা দেশে ধ্বংসলীলা অব্যাহত রেখেছে।

চার. ইসলামী ব্যাংক বন্ধ হবে কি? ইসলামী ব্যাংক জামাতের রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শুধু তাই নয় জামাতের অর্থনৈতিক শক্তিকে টিকিয়ে রেখেছে ইসলামী ব্যাংক। তার হাজার হাজার কর্মীকে কর্মসংস্থানসহ নানান লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের দিকে। আজকে গরিব সাধারণ মানুষের সন্তানদের জিহাদের কথা বলে মানব বোমায় পরিণত করছে তারা। অথচ জামাতের সকল নেতাদের সন্তানরা পশ্চিমা সংস্কৃতিকে বেড়ে উঠছে। অথচ এই নেতারাই অন্যের সন্তানকে বিভ্রান্ত করছে নানা অপকৌশলে। ইসলামী ব্যাংকসহ সকল জামাতি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা এখন সময়ের দাবি।

পাঁচ. আমরা যারা শাহবাগকে সমর্থন করেছি এবং যারা শ্রম দিয়েছেন তাদের কাছে একটি বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার যে এই আন্দোলনকে কেউ ক্ষমতা দখলের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলে ভুল করবেন। আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নটি যুক্ত হয়ে গেছে। তাই কেউ এটাকে নিয়ে ছলচাতুরী করলে ফল হবে খুবই খারাপ। তাই প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলতে চাই ক্ষমতার দখল, পাল্টা-দখলের নতুন কোনো ফর্মুলা বের করুন, বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কাউকে বাণিজ্য করতে দেবে না।

কিছু কথা বলে শেষ করতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই জনপদে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার হয়েছিল সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের হত্যা করা হয়েছিল, তাদের ধর্ষণ করা হয়েছিল, তাদের সম্পদ লুট করা হয়েছিল, বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, উপাসনালয় ধ্বংস সবই করা হয়েছে শুধুমাত্র তারা সংখ্যালঘু বলে। আজ কি আবারো তাই ঘটছে না? আজ নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, খুলনাসহ অসংখ্য স্থানে যেভাবে ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছে তাকে কেবল মধ্যযুগীয় বর্বরতার সঙ্গে তুলনা করা যায়। বাংলাদেশে কি ৭১’র সেই কালরাত নেমে এসেছে। নিশ্চয়ই তা নয়। তবে কেন সরকার এই পাকিস্তানের প্রেতাত্মাদের শক্ত হাতে দমন করছে না? যারা মন্দির ভাঙতে যাবে কেন তাদের দেখা মাত্র গুলি করা হবে না? যারা সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেবে কেন তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হবে না?তাই বলতে চাই শাহবাগের তরুণ প্রজন্ম শিক্ষা দিয়েছে কিভাবে সংগ্রাম করতে হয়। বর্তমান ক্ষমতাসীন জোট আর বিরোধী জোট যদি এই আন্দোলন থেকে শিক্ষা না নেয় তবে রাষ্ট্রক্ষমতা তাদের হাতেও থাকবে কিনা বলা যায় না। কারণ এই প্রজন্ম সত্যিকার অর্থে দুদলের যোগ্যতার প্রমাণ ইতোমধ্যে পেয়েছে। তাই এখনো সময় আছে ক্ষমতাসীন আর ক্ষমতার বাইরের শক্তিরা দেশ নিয়ে ভাবেন। আর তা না হলে তরুণ প্রজন্ম একবার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আর কোনোদিন আপনাদের দিকে ফিরেও তাকাবে না। জয় শাহবাগ, জয় নতুন প্রজন্ম।

ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল : ছাত্রনেতা, লেখক।
ভোরের কাগজ : বুধবার, ২০ মার্চ ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন