বুধবার, ২৯ মে, ২০১৩

ক্ষমতায় থাকলে জেএমজেবি আর বিরোধী দলে থাকলে হেফাজত এবং একটি প্রচারপত্র

শেখর দত্ত
একবিংশ শতাব্দীর প্রথম ১৩ বছরের অভিজ্ঞতায় এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, বিএনপি রাজনৈতিক দলটি ক্ষমতায় থাকলে জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ (হুজি) প্রভৃতি উগ্র জঙ্গিবাদী গ্রুপগুলোকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে। আর বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় এখন অপব্যবহার করছে হেফাজতে ইসলামকে। আরো লক্ষ্য করার মতো বিষয় হচ্ছে, ক্ষমতায় ও বিরোধী দলে থাকা অর্থাৎ দুই সময়েই বিএনপি নিজেকে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ রেখেছে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী দল জামাত এবং তালেবানপন্থী বলে সুপরিচিত, যারা সেøাগান দিয়েছিল ‘বাংলা হবে আফগান’, সেই সব উগ্রপন্থী দলগুলোকে।
প্রসঙ্গত, বিএনপি দলটি ১৯৭৬ সালে জন্মের পর ৩৭ বছর সময়কাল অতিক্রম করে ৪টি পর্যায় অতিক্রম করেছে। জিয়ার আমল, জিয়ার মৃত্যুর পর নেতৃত্বের শূন্যতা, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত সময়কাল এবং বর্তমানে চলছে খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের সময়কাল। এই চার পর্যায়ের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে এটা খুব সহজেই প্রতীয়মান হয়ে উঠবে যে, মাতা-পুত্র মিলিতভাবে দলটি পরিচালনা দিনগুলোতেই দলটি সর্বোচ্চ ও সর্বোতোভাবে জামাত ও তালেবানপন্থী দলগুলোর সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ক্ষমতায় থাকতে বাংলাভাই ও মুফতি গংদের আর বিরোধী দলে থাকতে বাবুনগরীদের যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে চলেছে।

এটাই তো সত্য যে, সেনাশাসক জিয়া সামরিক শাসনের মধ্যে সামরিক ফরমান দিয়ে যুদ্ধাপরাধী সাম্প্রদায়িক দল জামাতকে রাজনৈতিক দল করার লাইসেন্স প্রদান করেন। কিন্তু নিজ দল বিএনপিকে তিনি কখনো জামাতের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ করেননি। ‘মুক্তিযোদ্ধার দল’ হিসেবে বিএনপিকে দেশবাসীর সামনে পরিচিত করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। তবে এটা ঠিক, ক্ষমতার কেন্দ্রে ও তৃণমূলে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য জামাতকে তিনি সুচতুরভাবে ব্যবহার করেছিলেন। জামাতের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের দল ও সংগঠনগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্ব-সংঘাত বাধিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নিজের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত দীর্ঘস্থায়ী ও পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি। তারপর খালেদা জিয়া দল পরিচালনায় আসার পর জামাত ও তালেবানপন্থী দলগুলোর সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হয় বিএনপি। তখনো চলে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য ধর্মকে অপব্যবহার করার সুচতুর খেলা। তবে তিনি যতোটুকু বাকি রেখেছিলেন, সেটুকু সাঙ্গ করার পারদর্শিতা দেখিয়েছেন জিয়া-খালেদা জিয়ার সুযোগ্য পুত্র তারেক রহমান। তারেক রহমান বিএনপির মঞ্চে আরোহণের পর জামাতকে বলেছে, ‘আত্মার আত্মীয়’ আর বাংলাভাই ‘মিডিয়ার সৃষ্টি’ বলতে দলকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। আর এখন বিদেশে থেকে কলকাঠি নেড়ে হেফাজতে ইসলামীকে রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে।

ধারাবাহিকভাবে পবিত্র ধর্মকে রাজনীতিতে অপব্যবহার করতে করতে আজ দলটি যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, তা কোনোক্রমেই বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজজীবনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। কিন্তু সাম্প্রদায়িক চেতনার ঘোর বিরোধী। পবিত্র ধর্মকে রাজনীতিতে অপব্যবহার করতে গিয়ে পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে গেছে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা প্রমাণ করে, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। ‘জয় বাংলা’ সেøাগান কিংবা ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন যেমন অসাম্প্রদায়িক ভাবধারাপুষ্ট; তেমনি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার সেøাগান প্রচেষ্টা ও স্বপ্নও ধর্ম সম্প্রদায়কে আলাদা করে না বরং ঐক্যবদ্ধ করে। প্রকৃত বিচারে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে এবং লক্ষ্যাভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতাকে ভিত্তি করে।

এই বাস্তবতায় মাতা-পুত্রের পরিচালনায় বিএনপি দলটি ২০০১-০৬ ক্ষমতায় থাকাকালীন এবং বর্তমানে বিরোধী দলে থাকার সময়ে যে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছে, তাতে দলটি যারপরনাই বেকায়দায় পড়েছে। পবিত্র ধর্মকে নিয়ে খেলা করে যে আগুনকে প্রজ্বলিত করেছে, সেই আগুনেই দলটি দগ্ধ হচ্ছে। সম্প্রতি বিএনপি একটি প্রচারপত্র বিলি করেছে। ওই প্রচারপত্রের ভাষা বিবেচনায় নিলেই এটা অনুধাবন করতে অসুবিধা হবে না দলটি কতোটুকুই না বিপাকে পড়েছে। ওই প্রচারপত্রে বলা হয়েছে যে, এক. ‘ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী বিএনপি একটি উদারনৈতিক অসাম্প্রদায়িক আধুনিক রাষ্ট্র গঠনে প্রয়াসী। নর-নারীর সমতাভিত্তিক একটি কর্মমুখর সমাজ বিকাশের লক্ষ্যে বিএনপি কাজ করে যাচ্ছে।’ দুই. ‘হেফাজতে ইসলাম আলেম, মাদরাসা শিক্ষক ও ছাত্রদের সমন্বয়ে গঠিত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। তাদের কিছু কিছু দাবির প্রতি আমাদের সমর্থন থাকলেও অনেক দাবির সঙ্গে আমাদের দ্বিমতও রয়েছে।’ তিন. ‘হেফাজত কর্মীরা শাপলা চত্বরের সমাবেশের দিকে চলে যাবার পর সরকারি দলের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পল্টন মোড় ও বায়তুল মোকাররম এলাকা দখলে নিয়ে পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছাত্রছায়ায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, বাণিজ্য কেন্দ্র, ফুটপাতের বইয়ের দোকান ও যানবাহনে বেপরোয়া হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। তারা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ এমনকি পবিত্র কুরআন শরিফেও অগ্নিসংযোগ করে। বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচারিত ভিডিও ফুটেজে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের পদ-পদবিধারী বেশ কয়েকজনকে এসব সন্ত্রাসী তৎপরতায় নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে।’

প্রচারপত্রের উল্লিখিত কথাগুলোর কোনোটাই কি সত্য? কোনোটাই সত্য নয়। প্রসঙ্গত, বিএনপি বলে ক্ষমতায় গেলে দলটি মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে। কথাটা যেমন বেঠিক, তেমনি উল্লিখিত কথাগুলোও তেমনই সত্য নয়। বস্তুতপক্ষে জামাতকে ১৮ দলীয় ঐক্যজোটে সঙ্গে রেখে জামাতের রাজাকার-আলবদর নেতাদের বিচার করা কি সম্ভব? জামাত দলে এখনো নেতা হিসেবে রয়েছে সাকা চৌধুরী, আব্দুল আলিম। ক্ষমতায় এলে দলটি কি এদের বিচার করতে পারবে? বিএনপি দলটি উল্লিখিত কথা বলছে আসলে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার উদ্দেশে জনগণকে ধোঁকা দিতে। বিএনপি যদি ‘একটি উদারনৈতিক অসাম্প্রদায়িক আধুনিক রাষ্ট্র গঠনে প্রয়াসী’ হয়, তবে পঁচাত্তরের কালরাতে জাতির জনকের হত্যার পর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি সামরিক শাসনের মধ্যে সামরিক ফরমান জারি করে পাল্টালেন কেন? ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’ এই নীতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রীয় চারনীতি থেকে বাদ দেয়া হলো কেন? জামাতকেও মন্ত্রিত্ব দিয়ে ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনের পর বিএনপি যখন নিরীহ ধর্মীয় সংখ্যালঘু ভোটারদের বাড়িঘরে আক্রমণ চালায়, অগ্নিসংযোগ করে, খুন জখম-ধর্ষণ করে ‘এথেনিক ক্লিনজিং’ চালায় তখন সাম্প্রদায়িক আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের বুলি ছিল কোথায়? এখন মন্দির ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করছে কারা? এতোদিন তো বিএনপি এই বলে আহ্লাদে আটখানা ছিল এই জন্য যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশকে ‘মধ্যপন্থার মুসলিম দেশ’ হিসেবে চেনে। বর্তমানে বিএনপি যখন জামাতসহ ১৮টি সাম্প্রদায়িক দলের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ, তখন উদারনৈতিক অসাম্প্রদায়িক আধুনিক রাষ্ট্র গঠনে প্রয়াসী বলে নিজেকে পরিচিত করাতে উদগ্রীব কেন? বর্ণচোরা হতে চাওয়া হয় কখন? ঠেলায় পড়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার সময় নয় কি!

বিএনপি প্রচারপত্রে বলছে হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। ভালো কথা! যদি তাই হয় তবে রাজনৈতিক উদ্দেশে বিএনপি ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটামের সঙ্গে ওই সংগঠনটির প্রোগাম যুক্ত করলো কেন? আর কেনই বা হেফাজতে ইসলাম বিএনপির দ্বারা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হতে গেলো? এই দুই প্রশ্ন বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, হেফাজতে ইসলামীর মধ্যে রাজনীতি রয়েছে। প্রচারপত্রে বিএনপি বলছে, হেফাজতে ইসলামের ‘কিছু কিছু দাবির প্রতি আমাদের সমর্থন থাকলেও অনেক দাবির সঙ্গে আমাদের দ্বিমত রয়েছে। প্রশ্ন হলো ১৩ দফা দাবির কোন কোনটি বিএনপি সমর্থন করে আর কোন কোনটি করে না, তা কিন্তু প্রচারপত্রে, কোনো বিবৃতিতে কিংবা প্রস্তাবে স্পষ্ট করেনি। এটা তো সর্বজনস্বীকৃত যে, ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিকই ইসলাম ধর্ম, মহানবী এবং সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে যদি কেউ কটূক্তি করে, কুৎসা রটায় তবে তার বিরোধিতা ও শাস্তির দাবি করবে। হেফাজতে ইসলামের ওই দাবি ছাড়া আর ‘কিছু কিছু’ কোন দাবির প্রতি বিএনপির সমর্থন রয়েছে? বিএনপি প্রচারপত্রে বলছে, নরনারীর সমতাভিত্তিক একটি কর্মমুখর সমাজ বিকাশের লক্ষ্যে বিএনপি কাজ করছে। যদি তা-ই হয়, তবে হেফাজতকে তো বিএনপির বিরোধিতা করার কথা।

প্রসঙ্গত, একটা প্রশ্ন হেফাজতে ইসলামের নেতাদের উত্তর দিতে হবে এই যে, সংগঠনটি যদি শান্তির ধর্ম ইসলামের পক্ষে হয়, তবে বিএনপি আমলে বাংলাভাই ও মুফতিগংরা যখন বোমা, গ্রেনেড হামলা চালিয়ে দেশকে ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ বানানোর জোরদার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল, তখন সংগঠনটি কোথায় ছিল? আফগান ফেরত জঙ্গিদের সঙ্গে এই সংগঠনের যোগাযোগ থাকার কথা তো হরহামেশা শোনা যাচ্ছে। প্রচারপত্রে বিএনপি বলেছে যে, ৫ মে হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা যখন শাপলা চত্বরে সমবেত হয় তখন সরকারি দলের লোকেরা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কাজ করেছে। কী বলে বিএনপি! ‘উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে’ প্রবাদটি প্রমাণ করে ছাড়লো দলটি। মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত দলটি মিথ্যা বলতে বলতে এখন সত্য বলতে ভুলে গেছে।

ঠিক এভাবেই ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা ও কোটালীপাড়ায় শাক্তিশালী বোমা পুঁতে রাখার পর, কিবরিয়া-আহসানউল্লাহ মাস্টার-মনজুরুল ইমাম, মমতাজউদ্দিনকে হত্যা করার পর, ১৭ আগস্ট ০৫ সিরিজ বোমা বিস্ফোরণের পর, যশোর উদীচী রমনা বটমূল সিপিবির জনসভায় বোমা হামলার পর প্রভৃতি সময়ে বিএনপি উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে সচেষ্ট থেকেছে। বিএনপি মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপনে এতোই পারদর্শী যে, উল্লিখিত নাশকতামূলক তৎপরতা সংঘটিত হওয়ার পর তখনকার মতো বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। ‘ব্লেইম গেইম’ শব্দটি বিএনপির মিথ্যা প্রচারে প্রতিষ্ঠিত হতে বসেছিল। কিন্তু এটা এখন দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট যে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিএনপি যদি ওই সব জঙ্গি সন্ত্রাসী তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের তথা জাতীয় মূলধারা আন্দোলন-সংগঠনকে কোণঠাসা বা নিশ্চিহ্ন করতেই যে উল্লিখিত জঙ্গি সন্ত্রাসী তৎপরতায় ‘হাওয়া ভবন’ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গোপনে পরিচালিত করেছিল, এটা এখন আর বিতর্কের কোনো বিষয় নয়।

স্বভাবতই প্রশ্ন বিএনপি দলটি ক্ষমতায় থাকতে একভাবে আর বিরোধী দলে থাকতে অন্যভাবে কেন পবিত্র ধর্মকে ব্যবহার করছে? কেন কখনো বাংলাভাই মুফতি গংদের, আবার কখনো বাবুনগরীদের উসকানি দিয়ে মাঠে নামাচ্ছে? এক সময়ে শায়খ আব্দুর রহমান আর বর্তমান সময়ে মওলানা শফিকে ব্যবহার করছে। কারণ স্পষ্ট। প্রকৃতপক্ষে বিএনপি পরাজিত-পরিত্যক্ত পাকিস্তানি আমলের দ্বিজাতিভিত্তিক রাজনীতিকে বাংলাদেশে জাতীয় মূলধারার রাজনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর রয়েছে। রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে বাম দিকে থাকবে আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের রাজনৈতিক দল ও শক্তি আর ডান দিকে থাকবে উগ্র ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক মধ্যযুগীয় ইসলাম নামধারী দল ও শক্তি এবং মধ্যে ভারসাম্যমূলক অবস্থানে থাকবে বিএনপির সংগঠন ও রাজনীতি-এই হচ্ছে বিএনপি দলটির লক্ষ্য। বিএনপি আন্তর্জাতিক মুরব্বি ও দেশের মানুষকে এটা দেখাতে চায় যে, আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের সঙ্গে উগ্রবাদী জেএমজেবি-হুজিসহ অসংখ্য নিষিদ্ধ এবং হেফাজতে ইসলামের মতো সংগঠনগুলোর দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যে কেবল বিএনপিই পারে দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে। উগ্র জঙ্গি সন্ত্রাসী দল বা গ্রুপই হোক আর হেফাজতের মতো মধ্যযুগীয় চিন্তাচেতনার সংগঠনই হোক, বিএনপিই পারে এদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে। আওয়ামী লীগ তা পারে না এবং পারবেও না। পাঠকদের নিশ্চয়ই স্মরণে থাকার কথা যে, খালেদা জিয়া প্রায়শই বলতে ভালোবাসেন, আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপিই হচ্ছে জাতীয় মূলধারা আন্দোলনের একমাত্র দল। জাতি বলতে যাদের মাথায় রয়েছে পাকিস্তানি ভূত দ্বিজাতিতত্ত্ব, তারাই হতে চাইছে জাতীয় রাজনীতির মূলধারা! দেশের রাজনীতির গতিধারা পর্যবেক্ষণে এটা সুস্পষ্ট যে, ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের কাল রাত্রির পর থেকে এই প্রচেষ্টা চলছে এবং এখনো এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রসঙ্গত, বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়া যেমন কর্নেল তাহেরকে ব্যবহার করে সব শেষে ‘হুকুমের বিচার’ করে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন, খালেদা জিয়া যেমন বাংলাভাইদের অপব্যবহার করে গোপনে বিচার করে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন, ঠিক তেমনি খালেদা জিয়া-তারেক জিয়াও এক সময় বিশ্বাসঘাতকতা করে হেফাজতে ইসলামের চরম সর্বনাশ করবে।

এই লক্ষ্য থেকে বিএনপি ‘মুক্তিযোদ্ধা প্রতিষ্ঠিত দল’ বলে নিজেদের পরিচিত করানোর চেষ্টার করলেও টার্গেট করে জাতির গৌরবম-িত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধকে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় ও অমর্যাদা করতে কিংবা নিশ্চিহ্ন করতে বিএনপি কখনো পিছপা হয় না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে পর্যন্ত দলটি কম খেলা খেলেনি। জিয়া আমলে এক দিকে সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে নীলনকশা অনুযায়ী ব্যর্থ ক্যু ঘটিয়ে মুক্তিযোদ্ধা অফিসার-জোয়ানদের নিশ্চিহ্ন করার এবং অন্যদিকে পাকিস্তানপন্থীদের সামরিক-বেসামরিক দালালদের রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল প্রকৃত বিচারে সুদূরপ্রসারী ওই লক্ষ্য থেকেই। বিএনপি দলটি সুচতুরভাবে প্রথমে এটা প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর ছিল যে, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বাংলাদেশ আসলে হয়ে গেছে ভারতের অধীনস্ত একটি দেশ এবং পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর ভারতের নাগপাশ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করা হয়েছে। এই চিন্তুা থেকেই ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসকে হেয় প্রতিপন্ন করে ৭ নভেম্বরকে ‘পরাধীনতা মুক্ত দিবস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তৎপরতা চালিয়েছিল।

কিন্তু তা ব্যর্থ হওয়া হয়েছে। উল্লিখিত প্রচারপত্রে বলা হয়েছে যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে ঘুমন্ত মানুষের ওপর যে পৈশাচিক গণহত্যা এই অঞ্চলে পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে অনিবার্য করে তুলেছিল ৫ মে কালরাতের গণহত্যা কেবল তার সঙ্গেই তুলনীয়।’ কার সঙ্গে কিসের তুলনা করছে বিএনপি! কোথায় বকুলতলা আর কোথায় চকিরতলা। গৌরব আর কলঙ্কের পার্থক্য ঘুচিয়ে দিতে চাইছে বিএনপি। এটা দেশবাসীর জানা, বিএনপি ‘হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী’ কথাটি মুখে বলতে নারাজ। জিয়া আমলে তা বলা হলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়ার পর থেকে বিএনপি তা বলে না, বলতে চায় না। মানুষ বলে, খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানের দখলকৃত ক্যান্টনমেন্টে সামরিক কর্তাদের আশ্রয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে ছিলেন বলেই পাকিস্তানি বাহিনীকে ‘হানাদার বাহিনী’ বলতে চান না। প্রচারপত্রেও সুকৌশলে ‘পৈশাচিক গণহত্যা’ কারা করছে, সেই সত্যটি চেপে রাখা হয়েছে। বাস্তবে ২৫ মার্চ ’৭১-এর সঙ্গে ৫ মে ’১৩-এর তুলনা করে বিএনপি পরোক্ষভাবে সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে আহ্বান জানাচ্ছে। ক্ষমতায় থাকতে বোমা-গ্রেনেড ফাটিয়ে আর এখন বিরোধী দলে থাকতে ককটেল ফাটিয়ে ওই আহ্বানকেই বিএনপি কার্যকর করতে চাইছে। ক্ষমতায় ফিরে আসতে বা ক্ষমতার আশা ধূলিসাৎ হলে বিএনপি যে কতোটা প্রতিহিংসাপরায়ণ ও হিংস্র হতে পারে, তা ইতোমধ্যে দলটি দেখিয়ে দিয়েছে। অশুভ-অকল্যাণকর-ক্ষতিকর সবকিছুরই একটা শেষ আছে। বিএনপি যদি পথ-পন্থা পরিবর্তন না করে, তবে এবারে শেষ দেখতে বাধ্য হবে।

শেখর দত্ত : রাজনীতিক, কলাম লেখক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন