শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৩

মদিনা সনদে যা বলা হয়েছে

মুফতি এনায়েতুল্লাহ
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে দলীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠককালে বলেন, 'দেশে সব ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে তাদের নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। যেটা আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তার মদিনা সনদ ও বিদায় হজের ভাষণে বলে গেছেন। ঠিক সেভাবেই এ দেশ চলবে।' তিনি আরও বলেন, 'যে কোনো ধর্ম অবমাননা বরদাশত করব না।' প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য নিয়ে নানা রকম আলোচনা চলছে। কেউ বলছেন, মদিনা সনদে মুসলমানদের অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে সম্প্রীতি রক্ষার কথা বলা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে এটাই বোঝাতে চেয়েছেন। অনেকে বলছেন, প্রধানমন্ত্রী কথাটি রূপক অর্থে বলেছেন। অবশ্য বেশ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, 'দেশ পরিচালনায় মদিনার সনদ ও বিদায় হজের ভাষণ অনুসরণ করলে ওলামায়ে কেরাম প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে থাকবে।' তারা অবশ্য কথার কার্যকারিতা প্রমাণে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণেরও দাবি জানিয়েছেন।
যেহেতু আলোচনা উঠেছে, তাই মদিনা সনদের আলোকে দেশ পরিচালনার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের ব্যাখ্যা আসা প্রয়োজন। যদি তিনি প্রকৃত অর্থেই মদিনা সদনের আলোকে দেশ চালাতে চান, তবে এ দেশের আলেম সমাজসহ সব মুসলিম প্রধানমন্ত্রীকে সহযোগিতা করতে বাধ্য। যাই হোক, প্রধানমন্ত্রী যখন কোনো কথা বলেন, তখন রাজনৈতিক বিশেল্গষকদের মনে হয়, তিনি তো ইচ্ছা করলে এসব করতেও পারেন। তার হাতে একক ক্ষমতা রয়েছে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ রয়েছে। দলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থান রয়েছে। ধর্মীয় মূল্যবোধ, ধর্ম বিশ্বাস, ধার্মিকতা ও ধর্মীয় চর্চা তার জীবনের সঙ্গে প্রবলভাবে মিশে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ধার্মিকতা, ধর্মচিন্তা ও নির্মল আবেগপ্রবণতা নাগরিক সমাজে বহুল বিদিত। সুতরাং তিনি মনেপ্রাণে চাইলে এসব করতেও পারেন। এর আগেও আমরা দেখেছি, ধর্মীয় ক্ষেত্রে নানা অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলার সময় প্রধানমন্ত্রী বারবার দেশের সর্বজনমান্য ওলামা-মাশায়েখদের সঙ্গে বসেছেন, তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন, উত্থাপিত দাবি-দাওয়াগুলো আন্তরিকভাবে দেখবেন বলেও আলেমদের আশ্বস্ত করেছেন। তার একক ইচ্ছাতেই কওমি আলেমদের নিয়ে কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতির রূপরেখা প্রণয়নের জন্য কওমি কমিশন গঠিত হয়েছে। বন্ধ হয়েছে কওমি মাদ্রাসায় পুলিশি হয়রানি।
এবার আসুন, দেখা যাক কী আছে মদিনা সনদে। ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর হজরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় হিজরত করেন। এ সময় সেখানে বসবাসরত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাঝে বিরাজ করছিল গোষ্ঠীগত হিংসা-বিদ্বেষ। তাই কলহে লিপ্ত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাঝে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি স্থাপন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নবী করিম (সা.) ৪৭ ধারার একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন, যা পৃথিবীর ইতিহাসে মদিনা সনদ নামে পরিচিত। বিশ্বের ইতিহাসে এটাই প্রথম লিখিত চুক্তি ও সংবিধান।
মদিনা সনদের মূল বিষয়বস্তু ছিল_ ১. সনদে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়গুলো একটি জাতি গঠন করবে; ২. যুদ্ধ শুরু হওয়ার মতো তীব্র বিরোধ তৈরি হলে বিষয়টি হজরত মুহাম্মদের (সা.) কাছে ন্যস্ত হবে; ৩. কোনো সম্প্রদায় গোপনে কোরাইশদের সঙ্গে কোনো প্রকার সন্ধি করতে পারবে না কিংবা মদিনা বা মদিনাবাসীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে কোরাইশদের কোনোরূপ সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারবে না; ৪. মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, পৌত্তলিক ও অন্যান্য সম্প্রদায় ধর্মীয় ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। কেউ কারও ধর্মীয় কাজে কোনো রকম হস্তক্ষেপ করতে পারবে না; ৫. মদিনার ওপর যে কোনো বহিরাক্রমণকে রাষ্ট্রের জন্য বিপদ বলে গণ্য হবে। সেই আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য সব সম্প্রদায়কে একজোট হয়ে কাজ করতে হবে; ৬. রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষার ব্যবস্থা থাকবে; ৭. অসহায় ও দুর্বলকে সর্বাবস্থায় সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে; ৮. সব ধরনের রক্তক্ষয়, হত্যা ও বলাৎকার নিষিদ্ধ করতে হবে এবং মদিনাকে পবিত্র নগরী বলে ঘোষণা করা হবে; ৯. কোনো লোক ব্যক্তিগত অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবেই বিচার করা হবে। সে জন্য অপরাধীর সম্প্রদায়কে দায়ী করা যাবে না; ১০. মুসলমান, ইহুদি ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা পরস্পর বন্ধুসুলভ আচরণ করবে; ১১. রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তির অধিকার থাকবে রাষ্ট্রপ্রধানের এবং তিনি হবেন সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সর্বোচ্চ বিচারক; ১২. নবী মুহাম্মদের (সা.) অনুমতি ব্যতীত মদিনাবাসীরা কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না; ১৩. মুসলমানদের কেউ যদি অন্যায় কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করে, তবে সবাই মিলে তার বিরুদ্ধে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। নিজ সন্তান বা আত্মীয় হলেও এ ব্যাপারে তাকে ক্ষমা করা যাবে না।
যা হোক, এ সনদের মাধ্যমেই মহানবী (সা.) ধর্ম, বর্ণ, জাতি, উপজাতি নির্বিশেষ সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। তিনি যে রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাণ্ডারি ছিলেন সেই রাষ্ট্রে সব মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত হয়েছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক। তিনি সবার সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। মদিনা সনদে আইনের ভাষায় সব নাগরিককে সমান অধিকার প্রদান করা হয়েছে। মহানবী (সা.) একজন ধর্ম প্রবর্তক হয়ে নিজের অনুসারীদের বিশেষ কোনো সুবিধা প্রদান না করে সব ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের ধর্ম পালন, সামাজিক ব্যবস্থা, রাজনীতি, আইন, বিচার, অর্থনীতি তথা সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার প্রদান করেন এই সনদ রচনার মাধ্যমে।
আধুনিককালের অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের দাবিদার বিভিন্ন দেশে যখন মুসলিম হওয়ার কারণে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়, তখন মহানবীর (সা.) অসাম্প্রদায়িক চেতনাভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা আমাদের নতুন পথের সন্ধান দেখায়। অন্য ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে মহানবীর (সা.) মদিনা রাষ্ট্রে কাউকে সামান্য আঁচড় পেতে হয়েছে এমন নজির নেই। তাই বলা যায়, মহানবী (সা.) প্রবর্তিত মদিনা সনদ এবং এর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত মদিনা রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক চেতনা আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারে। সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী সেই আলোকিত চেতনাবোধ থেকেই কথাগুলো বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর মদিনা সনদ এবং বিদায় হজের ভাষণের আলোকে দেশ চালানোর কথা যেন শুধু কথার কথা না হয়। তাহলে নবীপ্রেমিক ধর্মপ্রাণ মানুষ অনেক ব্যথা পাবে। তাদের কাছে এসব কথার ভুল ব্যাখ্য ও বার্তা পেঁৗছবে, যা প্রধানমন্ত্রীসহ তার দল ও সরকারের জন্য হবে হিতে বিপরীত। তখন লাভের চেয়ে এসব কথা বেশি ক্ষতির কারণই হয়ে দাঁড়াবে।
muftianaet@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন