রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৩

পহেলা বৈশাখ: মৌলবাদের বিরুদ্ধে শপথের দিন

আদিত্য আরাফাত, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ঢাকা: ‘তাপসনিশ্বাস-বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/’ ‘...মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা...।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে একাকার হয়ে দেশের মানুষও প্রত্যাশা করে বিগত বছরের জীর্ণ মলিনতা পেছনে ফেলে নতুন করে স্বপ্ন দেখার। বিদায় ১৪১৯। স্বাগত ১৪২০।


অনেকটা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এসেছে এবারের বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ এসেছে এবার দেশের এক সংকটময় পরিস্থিতিতে। হরতাল অবরোধ আর দেশব্যাপী সহিংস রাজনীতির চাকায় যখন পিষ্ঠ অর্থনীতি সেই ঘোর সংকটে এসেছে বৈশাখ।

একদিকে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর তাণ্ডব আর অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জেগে ওঠা তারুণ্য। এ তারুণ্যের চোখে এখন রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ দেখার স্বপ্ন। সে স্বপ্নে বিভোর হওয়া তারুণ্য রাজপথ আর অনলাইনে লড়াই করছে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে।

অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে তাই বৈশাখের প্রথমদিনে বাঙালিজাতি শপথ নেবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, “বাঙালির এ দিনটি এখন সার্বজনীন বৃহৎ উৎসব। বৈশাখ চেতনাকে জাগিয়ে দেয়।”

তিনি বলেন, “স্বাধীনতা প্রিয় বাঙালি যখন যুদ্ধাপরাধীদের উপযুক্ত বিচারের দাবিতে সোচ্চার তখন যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এ বিচার বন্ধ করতে অপপ্রচারে লিপ্ত। তাণ্ডব চালাচ্ছে দেশব্যাপী। সহিংস এক অ‍বস্থার মধ্যে এসেছে বৈশাখ। আতংক বিরাজ করছে দেশবাসীর মনে। তবুও জাতি-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে পালন করে এ উৎসব।”

গত বছরের সব অপ্রাপ্তি ভুলে গিয়ে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের লগ্নে একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়েই রোববার বাঙালি পালন করবে সার্বজনীন এ উৎসব। নতুন বছরে নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ জাতি আরও সোচ্চার হবে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।

বাংলা বছরের প্রথম দিনে গ্রাম ও শহরের ব্যবসায়ীরা খুলবেন হালখাতা। বিভিন্ন স্থানে বসবে বৈশাখী মেলা। নাগরদোলায় চড়া আর খেলনা, পুতুল, বাঁশিসহ বৈশাখী মেলার রকমারি পণ্য কেনার দুনির্বার আকর্ষণে ছেলে-বুড়ো সবাই হবে মেলামুখো। দেশের বিভিন্ন জেলা শহরেও বসছে বৈশাখী মেলা। গ্রামবাংলার বৈশাখী মেলা শহরাঞ্চলেও সম্প্রসারিত হয়েছে।

রাজধানীসহ সারা দেশের নানা বয়সী মানুষ সাড়ম্বরে উৎসবের আনন্দে মেতে উঠবে। পোশাক-পরিচ্ছদ, খাওয়া-দাওয়া, গান-বাদ্য সবকিছুতেই প্রাধান্য পাবে বাঙালিয়ানা।  সকালেই রাজধানীবাসী ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়বে সুসজ্জিত হয়ে। নারীরা পরবে লাল-সাদা শাড়ি, পুরুষের পরনে নকশা করা পাঞ্জাবি ও ফতুয়াসহ বর্ণিল পোশাক।

মঙ্গল শোভাযাত্রা, নাচ, গান, মেলা, নতুন হালখাতা, মিষ্টিমুখ, নতুন পাঞ্জাবি, শাড়ি, ফতুয়া কেনার ধুম, খাওয়া-দাওয়া, বেড়ানো, শুভ নববর্ষ জানানোর রেওয়াজ—উৎসবের নানা অনুষঙ্গে নববর্ষ উদযাপন নিত্যনতুন মাত্রিকতায় উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে চলেছে।

রমনার বটমূলে ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার নব-উন্মেষকালে ছায়ানট সেই যে কাকডাকা ভোরে নববর্ষকে আবাহনী গান গেয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল, সেটি আজ রাজধানীবাসীর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। পহেলা বৈশাখ রমনায় পালন করতে ঢাকাবাসী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই লোকজন জড়ো হয়। রোববার সব পথ মিশে যাবে রমনায় এসে।

স্থানটির পরিচিতি বটমূল হলেও প্রকৃত পক্ষে যে গাছের ছায়ায় মঞ্চ তৈরি হয় সেটি বট গাছ নয়, অশ্বত্থ গাছ। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা।

প্রতিবারের মতো এবারও রাত পোহালেই রাজধানী ঢাকার রমনা অশ্বত্থমূলে নববর্ষের আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানটি শুরু হবে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। ছায়ানটের শিল্পীদের রুচিশীল সঙ্গীত-ঝঙ্কার উপভোগ করতে প্রাণের বন্যা বয়ে যাবে রমনায়। ভোরের নরম সূর্যকিরণ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা তবলা, মৃদঙ্গ, পাখোয়াজ আর পুং বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে একটি তাল বাদন পরিবেশনের মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাবেন। বর্ণিল পোশাকে সজ্জিত অগণিত নারী-পুরুষ-শিশু যোগ দেবেন প্রাণের এ মিলনমেলায়। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠন নানা আয়োজনে বৈশাখ পালন করবে।

পান্তা-ইলিশ পহেলা বৈশাখের উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। তবে এই পান্তা-ইলিশ খাওয়া এখন একশ্রেণীর মানুষের বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। ইলিশের দাম নাগালের বাইরে থাকায় মধ্যবিত্ত বাঙালির বছরের প্রথম দিনে ইলিশ খাওয়ার সাধ থাকলেও সাধ্য থাকে না কেনার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন