বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৩

সাঈদীর মামলার আপিল শুনানি শুরু ২ মে

ঢাকা: জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে দেওয়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল আবেদনের শুনানি আগামী ২ মে শুরু হবে। সরকারপক্ষ ও আসামিপক্ষের করা পৃথক দু’টি আপিলের শুনানি একসঙ্গে শুরু হতে যাচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে।


বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি মো. মোজ্জাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ৬ সদস্যের বেঞ্চ এ তারিখ নির্ধারণ করেন। এ বেঞ্চের অপর পাঁচ বিচারপতি হলেন-বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

আদালতে সরকারপক্ষে ছিলেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমের সমন্বয়কারী ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান। আসামিপক্ষে ছিলেন ট্রাইব্যুনালে সাঈদীর প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।

এম কে রহমান পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘আমরা আপিল আবেদনের সার সংক্ষেপ আগেই জমা দিয়েছি। আদালত আসামিপক্ষকে তাদের আপিল আবেদনের সার সংক্ষেপ জমা দিতে বলেছেন। আর আমাদের দুই পক্ষকে নিজেদের সার সংক্ষেপ আদান-প্রদান করতে বলেছেন।”

সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ঘোষিত রায়ে যে ৬টি প্রমাণিত অভিযোগে সাঈদীর শাস্তি হয়নি, আপিল আবেদনে সেসব অভিযোগে সর্বোচ্চ শাস্তির আরজি জানিয়েছি আমরা। আপিল শুনানিতে আমরা এ বিষয়ে যুক্তি তুলে ধরবো।’’

ওই ৬টি প্রমাণিত অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের সাজা না দেওয়া মারাত্মক ভুল বলে মন্তব্য করে এম কে রহমান বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩ অনুসারে এসব অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডই আশা করছি আমরা। আমাদের আশাবাদ, আপিল বিভাগে আমরা ন্যায়বিচার পাবো।’’

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আপিলের মূল বিষয়, প্রমাণিত ২টি অভিযোগ, যেসব অভিযোগে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। সাঈদীর আইনজীবীরা অবশ্য জানিয়েছে, ১২০ পৃষ্ঠার রায়ের প্রতিটি লাইন ধরে ধরে তারা আপিল করেছেন।

প্রসঙ্গত, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২৮ মার্চ সাঈদী ও সরকারপক্ষ পৃথক দু’টি আপিল(আপিল নম্বর: ৩৯ ও ৪০) দাখিল করেন। গত ৩ এপ্রিল আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল আবেদনের সার সংক্ষেপ জমা দেন সরকারপক্ষ। বুধবার দুপুরে এম কে রহমান আপিলটির ওপর শুনানির জন্য দিন ধার্য করতে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির আদালতে আবেদন করেন। চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বিষয়টি বৃহস্পতিবার শুনানির জন্য নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণের মতো আটটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ার প্রেক্ষিতে এর মধ্যে দু’টি অপরাধে তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল।

সাঈদীর বিরুদ্ধে গঠন করা অভিযোগে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিন হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা বা হত্যায় সহযোগিতা, নয়জনেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ, বিভিন্ন বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট, ভাঙচুর এবং ১০০ থেকে ১৫০ হিন্দুকে ধর্মান্তরে বাধ্য করার ২০টি ঘটনার অভিযোগ আনা হয়েছিল।

এগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে ৮টি অভিযোগই প্রমাণ করতে পারায় ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। এর মধ্যে দু’টি অভিযোগে অর্থাৎ ৮ ও ১০ নং অপরাধে সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। এছাড়া ৬, ৭, ১১, ১৪, ১৬ ও ১৯নং অভিযোগ প্রমাণিত হলেও এগুলোতে কোনো সাজার কথা ঘোষণা করেননি ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল জানান, দুই অভিযোগে সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়ায় বাকিগুলোতে আর সাজা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আর বাকি ১২টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় সেগুলোতেও কোনো সাজা দেননি ট্রাইব্যুনাল।

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩ এর বিধান অনুসারে, রায় ঘোষণার এক মাসের মধ্যে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। সে হিসেবে ২৮ মার্চ আপিলের শেষ দিনেটিতেই উভয়পক্ষ আপিল আবেদন করেন। অন্যদিকে আইন অনুযায়ী ৬০ দিনের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তির বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

এর ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের আরো একটি মামলা যাচ্ছে সুপ্রিম কোর্টে। সাঈদীর পক্ষে-বিপক্ষে এ আপিলের মধ্য দিয়ে সুপ্রিম কোর্টে উঠতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় মামলা।

এর আগে আর্ন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর গত ৫ ফেব্রুয়ারি দেওয়া রায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী আব্দুল কাদের মোল্লা খালাস চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আপিল আবেদন করেন। আর সাজা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ শাস্তির আরজি জানিয়ে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ। গত ১ এপ্রিল থেকে ওই মামলায় দু’টি আপিলের বিষয়েই একসঙ্গে শুনানি শুরু হয়েছে প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ। ওই শুনানির মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারে সুপ্রিম কোর্টের কার্যক্রম শুরু হয়।

প্রসঙ্গত, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ থেকে এ ট্রাইব্যুনাল আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করেন। বিচারিক প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করতে গত বছরের ২২ মার্চ গঠিত হয় দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল।

এ পর্যন্ত ৫ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এর মধ্যে জামায়াতের সাবেক সদস্য (রোকন) পলাতক আবুল কালাম আজাদ বাচ্চু রাজাকার, জামায়াতের বর্তমান সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা এবং নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন দুই ট্রাইব্যুনাল। বাচ্চু রাজাকার ও সাঈদীকে ফাঁসি এবং কাদের মোল্লাকে মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। আর জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মামলার রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন