রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৩

বিরোধী দলের হরতাল এবং নাশকতা কার স্বার্থে জনতা না দলের?

ড. মারুফী খান
হরতাল এবং নাশকতা! এমন এক অনিশ্চয়তা ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসবে না বাড়িতে থাকবে, হঠাৎ হঠাৎ যখন তখন একটি ঘোষণা এবং অতঃপর হরতাল। আর হরতাল মানেই ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও এবং নানা নাশকতা।
যে যখন বিরোধী দলে থাকবেন, হরতাল তাদের একচেটিয়া অধিকারে পরিণত হয়। নির্বাচনের পূর্বে সাংবাদিক ভাইয়েরা যখন প্রার্থীদের প্রশ্ন করেন- তখন সবাই প্রায় হরতালকে যেন চানই না এমন মনোভাব পোষণ করে বক্তৃতা দেন। সবারই এমনভাব নির্বাচনে হারা জেতা থাকবেই; কিন্তু তাই বলে হেরে গেলেই ‘হরতাল’ ছাড়া উপায় হয় না- এটি জনগণকে শুধু বিব্রত করে না দলগুলোর প্রতি আস্থা হারাতেও সবিশেষ সাহায্য করে।

সম্প্রতি একটি প্রথম সারির দৈনিকে জরিপের ফলাফল পড়লাম। উচ্চমাধ্যমিক এর পরীক্ষা চলাকালে হরতাল সমর্থন করেন ৪৬.৯২% এবং সমর্থন করেন না এর সংখ্যা ৫১.৬৬% খটকাটি এখানেই। আমরা ভাবতে পারি না দেশের জনগণও চাইছে ছেলেমেয়েরা উচ্চ মাধ্যমিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার সময় হরতাল করা যৌক্তিক? এটি কি এমন হলো- আরে ওর ঘর পুড়েছে, ওর বাড়িতে লোক মরেছে, তো আমার কি? আমার তো ঘর পোড়েনি লোকও মরেনি। এ যদি বর্তমান সময়ের চিন্তা-চেতনা হয়- তবে আমরা দেশকে নিয়ে কি ভাবছি? হরতাল মানে স্কুল, কলেজ বন্ধ, দোকানপাট, গাড়ি চলা বন্ধ। কিন্তু খুব খুশি মনে মানুষ ব্যবসা বন্ধ রেখে দিনভর ঘুমোয়? স্কুল কলেজ না করে ছাত্রছাত্রীদের সময় হয়ত খারাপ কাটে না- কিন্তু প্রতিদিনের পড়া কিংবা বর্ষমধ্য বর্ষ সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন করে হবে?
অভিভাবকরা ফোন করেন! কেউ সহনীয়, কেউ অসহনীয়! কেন বাচ্চারা শনিবার ক্লাস করে না? সারা সপ্তাহে দু’দিন ক্লাস হলো, অতএব শনিবার ক্লাস নিতে হবে। আবার এলাকার হরতালবিরোধী দলীয় লোকজন লাঠিসোটা হাতে গেটের দারোয়ানকে হুমকি-ধমকি- কেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা নেই, শিক্ষকরা কোথায়? ইত্যাদি ইত্যাদি। বিষয়টি নিয়ে আমাকে ভাবতেই হয়। প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে শিক্ষালয়ের ভিতরে কেন দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায়-দায়িত্ব আমাদের কিন্তু শিক্ষালয়ে ঢুকবার মুহূর্তেও কিংবা আসার পথে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠান বহন করতে পারে না। এ কারণেই মূলত বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় হরতালের দিন ছাত্রছাত্রী আসে না। পাড়ায় পাড়ায় ছোট ছোট শিক্ষা শিক্ষালয়ে হয়ত ভিতরে ভিতরে বাচ্চাদের নিয়ে মায়েরা দিয়ে আসেন নিয়ে আসনে; কিন্তু তা কি গোটা শহরের চিত্র হতে পারে?
এখন হরতালের দিন শিক্ষকরা কাছাকাছি যারা থাকেন, আসেন স্বাক্ষর করেন খাতায় কিন্তু ছাত্রছাত্রী না এলে তারা পড়াবেন কাদের? ধরে নিচ্ছি সপ্তাহে ৫ দিন হরতাল, ছাত্রছাত্রী এলো না, কিন্তু শিক্ষক এলেন, প্রতিষ্ঠান প্রধান এলেন! কিন্তু ক্লাস হলো না শিক্ষার্থী না আসার কারণে! এ ক্ষেত্রে শুক্র-শনি যখন ক্লাস করার কথা উঠবে, তখন কিন্তু শিক্ষক এবং কর্মচারী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান সপ্তাহে ৭ দিনই কাজ করবেন? ছাত্রছাত্রীরা আসবে এইদিন? শুক্র ও শনিবার। এভাবে কি লেখাপড়া হয়? সব পরীক্ষা স্থগিত থাকে, বোর্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ে, তারপর ছেলেমেয়েরা অতিষ্ঠ হয় পরীক্ষার দিন পিছায় বলে, ওরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
সরকার ১ জানুয়ারি ‘বই বিতরণ দিবস’ যখন ঘোষণা করেছে এবং গত কয়েক বছর নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বে¡ও বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে পারছে, তখন একদিকে যেমন খুশি হবার কথা অভিভাবকসহ সকলেরই তখনই কেন বছর শুরুর সময় থেকে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া? যারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তারা শিক্ষালয়ে পড়তে যাবেন না কিন্তু তারা ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে জাতির ভবিষ্যত কেন নষ্ট করবেন? তার বা তাদের ছেলেমেয়েরা নেতাদের সন্তান হিসেবে বিদেশে পড়বে অথবা ক্ষমতার কারণে যে কোন ভাল স্কুলে ঢুকে যাবে। কিন্তু ক্লাস না করার কারণে যে বিদ্যার্জনে ঘাটতি থেকে গেল, তা পুষিয়ে নেবে কি করে? ফল একটাই হবে বোর্ডে যাও বা একটা পাস করুক না কেন কর্মক্ষেত্রে এদের জ্ঞানের যে অভাব থেকেই গেল, তা থেকে না হবে ভাল নেতাকর্মী, না হবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মাস্টার সর্বোপরি না হবে একজন ভাল মানুষ।
যারা হরতাল করেন আর তার সমর্থন দান করেন, তারাই কিন্তু পরবর্তীতে চিৎকার করেন-জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে এই অভিযোগে। এখন সম্প্রচার মাধ্যমগুলো এত বেশি এবং এত বেশি সংবাদ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করে, যে আমরা সরাসরি দেখতে পাই কোথায় কি ঘটছে! গত কয়েক মাস যাবত যা দেখা যাচ্ছে, তাতে জনগণের কিছু অংশ পুলিশকে ইট-পাটকেল, ককটেল, বোমা ফাটিয়ে নইলে রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে আক্রমণে অগ্রণী থাকেন দেখা যায়, এখন রাস্তায় আগুন জ্বালালে, গাছ কেটে ফেলে রাখলে, কিংবা ইটপাটকেল ছুড়লে বোমা নিক্ষেপ করলে জাতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তব্য কি? তারা যদি হাত-পা গুটিয়ে কিংবা আত্মগোপন করে থাকেন, তাহলে এই আমরা, জনতা কি বিলাপ তুলে শহর-গ্রামগঞ্জ মাথায় করব না দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি ঘুমাচ্ছে? যতজন পুলিশ আক্রান্ত হলো তারা কি মানুষ নয়? কল্পনা করুন এমন একটি চিত্র। হরতালের সমর্থনে একজন বোমা ফাটিয়ে আসায় পুলিশ তাকেও প্রতিঘাত করায় সে আহত হয়ে হাতে মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে বাড়ি ফিরল! মা সন্তানের এ অবস্থা দেখে চিৎকার চিৎকারে পাড়া মাথায় করলেন- আমার পোলারে যেই পুলিশ পিটাইছে, সে মরুক, পুলিশ দেশের শত্তর, আমার পোলাডারে পঙ্গু বানাই ফেলছে! হের উপর গজব পড়ুক, ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেই মা বিকেলে মোবাইলে ফোন পেলেন- তার বড় মেয়ের কাছ থেকে। ফোনের ওপাশে মেয়ের বিলাপ সেই এলাকার বাতাস ভারি করে তুলেছে। মা’র বুকফাটা চিৎকার এ পাশে উচ্চারিত কি কইলি জামাই ককটেলের আঘাতে জখম হইয়া মরছে? হায় আল্লাহ, এইটা কি হইল, আমার মাইয়াটা বিধবা হইল? মেয়ের বিলাপ এবং মায়ের হাহাকার মিশে গেল। কে কইছে পুলিশ হে আমার জামাই।’
এখন ভাবুন বিষয়টি। এই ‘পুলিশ’ কারও সন্তান, জামাই, ভাই, কাগজে খবর ছাপা হয় দশজন মানুষ ও দুই জন পুলিশ নিহত। প্রশ্ন-পুলিশ মানুষ নয়? এই উত্তর কি হতে পারে?
গত এক হরতাল এর দিন রিক্সায় প্রতিষ্ঠানে আসছিলাম! এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক রিক্সার সামনে ভিড়ের মধ্যে। রিক্সাচালক রিক্সা সামনে নিতে পারছে না। এমন অবস্থায় অত্যন্ত ভদ্রভাবে সে বলে মুরুব্বি, একটু দেখে। কিন্তু মুরুব্বি তখনই মারমুখী। অবাক হলাম ভদ্রলোকের শ্বেত-শুভ্র দাঁড়ি, রং ফর্সা কিন্তু মুহূর্তেই তিনি এমন অশ্লীল বাক্য রিক্সাচালককে বলতে লাগলেন, আমি স্তম্ভিত। বিশ-বাইশের রিক্সাচালকও বুঝে উঠতে পারছিল না তার অপরাধ। আমি বললাম ছেলেটি তো আপনাকে কিছু বলেনি বরং মুরুব্বি বলে সম্বোধন করেছে। কে শোনে কার কথা! প্রায় গায়ে হাত তোলার পর্যায়ে রিক্সাচালকটি অত্যন্ত ঠা-ামাথায় বলল- আপনি একজন রাজাকার।
রাস্তার লোকজন ঐ লোককে ঠেলে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। আমি দ্বিতীয়বার চমকালাম। ও কি দৃঢ়তায় অবলীলায় প্রতিপক্ষকে একটি মোক্ষম জবাব দিয়েছে। ওর থেকে শিক্ষিত (হয়ত বা) বৃদ্ধ তাকে অহেতুক অকথ্য গালি দিল বিনা কারণে, এ রকম ক্ষেত্রে সাধারণত রিক্সাচালকও অন্তত তার মুখের ভাষায় ঘায়েল করে থাকে অন্যপক্ষকে, কিন্তু কি ব্যতিক্রম এক দুঃসাহস যে অর্জন করেছে, বলেছে- ‘আপনি একজন রাজাকার।’ একেই বোধহয় বলে ‘নীরব বিপ্লব। আমি নামবার সময় ওকে ভাড়ার চাইতে বেশি দেই বলি- ‘বাবা, তুমি যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখবার জন্য রাজাকার শব্দটি ব্যবহার করেছ এজন্য এই বেশিটুকু তোমার প্রাপ্য।’
সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হরতাল বন্ধের কোন ফর্মূলা আবিষ্কার করার মতো বিজ্ঞজন কি নেই এদেশে। বিদেশে সরকার আসন নেন, আসন থেকে সরে দাঁড়ান, বিক্ষোভ মিছিল হয়, কিন্তু উন্নত সভ্যদেশে এমন হরতাল হয় বলে আমার জানা নেই। এ দেশ থেকে ইংরেজ হটানো হয়েছে কিন্তু তখন হরতাল হয়নি। এ যেন এক ধরনের মজা, তোকে জলে নামিয়ে বলছি এ তোকে হাঁটু পর্যন্ত নামালাম, তুই বল তোর স্থান ছাড়বি, এই তোকে কোমড় পর্যন্ত নামালাম, তুই বল হ্যাঁ, চেয়ার ছাড়লাম এই তোকে বুক জ্বলে, এই তোকে গলা জ্বলে...। এ কি তামাশা? একি রঙ্গ? এভাবে নির্বাচিত গণতন্ত্র বিশ্বাসী সরকারের সঙ্গে ইয়ার্কি করা কি শোভন? পাঁচ বছর যারা দেশ শাসনের ভার নিয়েছেন, তাদের সময় পূর্ণ হোক, নির্বাচন কি (প্রশ্ন উঠবে নির্বাচন যা হবে তা গণতান্ত্রিক হবে না) আরও দশমাস অন্তত অপেক্ষা করেন। সংসদে আসুন। কথা বলুন। শুধু শুধু পথে পথে অঘটন ঘটিয়ে পরস্পরকে দোষারোপ করে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে বিচ্ছিন্ন হবার প্রয়োজন নেই। আমার ধারণা মতে এখন দুটি শক্তি এদেশে রয়েছে, স্বাধীনতার পক্ষ এবং বিপক্ষ শক্তি! আগামী নির্বাচনে জনতা রায় দেবে এ দুটি পক্ষ থেকেই। তখনই সম্ভবত নিরুপিত হয়ে যাবে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ নামক একটি দেশের কতটা রক্ষাকারী হতে পেরেছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন