বুধবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৩

রাজনীতিতে ধর্ম : অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু কথা

মোঃ মইনুল ইসলাম
সম্প্রতি বেগম খালেদা জিয়া শাহবাগের আন্দোলন ঘিরে বেশ জোরেশোরে সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দিতে শুরু করেছেন। বিধর্মী ও নাস্তিকদের ব্যাপারে তিনি বেজায় সোচ্চার। তাই এ বিষয়ে কিছু লেখা জরুরি মনে হলো। তবে আমরা যে সহজেই অতীত ইতিহাসকে ভুলে যাই এবং ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা চলে গেছে বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বোকার স্বর্গে বাস করি সে সত্যটাই নতুন করে আবার জানান দিয়ে গেলো। সাম্প্রতিক জামাত-শিবিরের তা-ব এবং বেগম জিয়ার উগ্র সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা সে সত্যটিরই প্রমাণ বহন করে। এটা ভাবা নেহাতই বোকামি ছিল যে ’৭১ সালের পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারেরও অবসান ঘটেছে, সেটা আর স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসবে না।
কিন্তু ১৯৭৮ সালে দীর্ঘ বিদেশ বাসের অবসান ঘটিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম ধর্মীয় রাজনীতি, বিশেষ করে জামাত-শিবিরের রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বেশ বহালতবিয়তে চলছে। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত এবং প্রায় তিন লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা সমাজ এবং রাষ্ট্র থেকে এই ধর্মান্ধ উগ্রবাদী শক্তির অবসান ঘটাতে পারেনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের দাপট বরঞ্চ তাদের সাহস এবং শক্তির কথাটিই নতুন করে জানিয়ে দিলো। এমনকি একপর্যায়ে তাদের কিছু প্রতিনিধি আমার অসাম্প্রদায়িক, উদার এবং গণতান্ত্রিক কথাবার্তা ও চিন্তা-চেতনার জন্য একদিন সাবধান করে গেলো।

বুঝলাম, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে আমাদের রাজনীতিকরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক আদর্শিক আন্দোলনটি যথাযথভাবে চালাতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগ এবং উৎসর্গের আদর্শ ভুলে গিয়ে ক্ষমতা এবং সম্পদের মোহে বিভ্রান্ত রাজনীতিকদের কারণেই যে স্বাধীনতা-পরবর্তী দিনগুলোতে পরাজিত জামাত-শিবির নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তা বুঝতে অসুবিধে হলো না। তাই পাকিস্তানি ধরনের মহাবিপদ যে ফের দেশের বুকে পুনরায় চেপে বসতে পারে সে ভয় এবং আশঙ্কা থেকেই গেলো। চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং রায় শুরুর পর ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে সংঘটিত জামাত-শিবিরের তা-ব সে আশঙ্কাই বাস্তবে আবার প্রমাণ করলো।

রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার সেই পাকিস্তানি আমল থেকে এ দেশের গণতন্ত্রকামী দেশপ্রেমিক মানুষ প্রচ- অনাসক্তি এবং অনীহার সঙ্গে দেখে এসেছে। এর একটি অতি সংক্ষিপ্ত বিবরণ এখানে উল্লেখের প্রয়াস আছে, যদিও বয়সের কারণে স্মৃতিশক্তি দুর্বলতা একটি বড় বাধা। তাছাড়া লাইব্রেরি ঘেঁটে সঠিক এবং বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার মতো সময় এবং শক্তিরও অভাব আছে। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনকালে আমি সিলেটের শায়েস্তাগঞ্জ স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র। তখন সে আন্দোলনকে মুসলিম লীগ ও তাদের সরকার ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানও ইসলাম বিরোধী ভারত ও হিন্দুদের ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করে। কিন্তু এ দেশের মানুষ যাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ছিল মুসলমান সে প্রচারণায় বিশ্বাস করেনি। বরঞ্চ তখনকার ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ এবং হত্যা ব্যাপক গণরোষের সৃষ্টি করে। এর ২ বছর পরই আসে নির্বাচন। ১৯৫৪ সালে শাসক মুসলিম লীগ দল আসন্ন নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি টের পেয়ে শেরে বাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানি ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে সেই একই ধরনের সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারের আশ্রয় নেয়। যুক্তফ্রন্টকে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান ও ইসলাম বিরোধী আঁতাত বলে অভিহিত করতে থাকে। প্রচার করা হয় নৌকায় (যুক্তফ্রন্টের প্রতীক) ভোট দিলে বিবি তালাক হয়ে যাবে, দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে ইত্যাদি। সে নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয় এবং পাকিস্তানের এ অঞ্চল (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে দলটি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

’৬২ এবং ’৬৬ সালে আইয়ুব বিরোধী এবং ৬ দফার আন্দোলনের সময়ও ইসলাম এবং পাকিস্তান বিপন্নের ধুয়াটি তোলা হয়। ইসলাম এবং পাকিস্তান তখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে ছিল সমার্থক। ’৭০-এর নির্বাচনে আবার একই জিগির তোলা হয়। বলা হয় ৬ দফায় ভোট দিলে ইসলাম এবং পাকিস্তান বিপন্ন হবে। ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। তারপর সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ ও বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অস্বীকৃতি, নানা ষড়যন্ত্র ও হুমকি-ধমকি এবং শেষ পর্যন্ত ’৭১-এর ২৫ মার্চের কাল রাতে ইতিহাসের অন্যতম গণহত্যার কথা সবারই জানা। তারপর ৯ মাস যাবৎ বাংলাদেশ জুড়ে হানাদার বাহিনী ও তাদের বাঙালি দোসর জামাত-রাজাকার-আলবদর-আল শামস যে হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের তা-ব ঘটায় সেসব কিছুই করা হয় ইসলাম এবং পাকিস্তান রক্ষার নামে।

পাক হানাদারদের প্রধান টার্গেটই ছিল হিন্দু ও আওয়ামী লীগ এবং সাধারণভাবে এ দেশের বাঙালি জনসাধারণ। যারা ছিল তাদের ভাষায় ‘ময়লা রঙের খর্বকায়’ (উধৎশ ধহফ ংযড়ৎঃ) ইতরজাতীয় মানুষ। এই ‘বেজন্মাদের’ (ইঁংঃধৎফং) জীবনের মতো শিক্ষাদান ছিল হানাদারদের মুখ্য উদ্দেশ্য। ’৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানিদের মতোই জামাত-শিবির গোষ্ঠী হিন্দু ও ভারতীয় ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছিল এবং এখনো গোলাম আযম গং এ বিশ্বাসে সুস্থির। তখন আমি বিলাতের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পাকিস্তানি ছাত্ররা সেখানে অধ্যয়নরত আবর ছাত্রদের মধ্যে প্রচার করে এটা বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয় যে, তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) পাকিস্তান বাহিনী হিন্দু ও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। তাছাড়া সেখানকার ব্যাপক সংখ্যক মুসলমানও ভারতীয় প্ররোচনায় ধর্মদ্রোহী হয়ে পড়েছে। স্পষ্ট মনে আছে ইসলামী ছাত্র সংঘের (বর্তমান ছাত্রশিবির) সক্রিয় সদস্য রশিদ মুক্তিযুদ্ধকে ভারত ও হিন্দুদের পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করার কারণে লিডসের বাঙালি ছাত্রদের কাছে সে ছিল চরম ঘৃণিত ব্যক্তি। তখন বিবিসি (ইইঈ) কর্তৃক প্রচারিত বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের গণহত্যা ও খুন-ধর্ষণের খবর পাকিস্তানি ছাত্রদের মতোই রশিদও মিথ্যা সাজানো বলে আখ্যায়িত করতো। বিবিসি তাদের মতে তাই ছিল ভারতীয় ব্রডকাস্টিং করপোরেশন। আর তারই নতুন প্রমাণ পেলাম যখন দেখলাম এক জামাত নেতা বাংলাদেশের নানা জায়গায় সম্প্রতি হিন্দুদের জানমাল ও মন্দির ধ্বংসের খবর বিবিসি কর্তৃক প্রচারকে মিথ্যা ও উসকানিমূলক বলে আখ্যায়িত করেছে।

এরও আগের দুটি অভিজ্ঞতাও এখানে উল্লেখ করতে চাই। বোধহয় সেটা ১৯৫৬-৫৭ সাল। তখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করি। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের (বর্তমানে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় বা ইটঊঞ) এক কোনায় (বর্তমান শহীদ মিনারের কাছে) তখন সুলতান ভাইয়ের (ভাষা সৈনিক) পুঁথিপত্র বলে একটি বই-পুস্তক ও প্রগতিশীল পত্রপত্রিকার দোকান ছিল। রাতে লাইব্রেরিতে (এখনকার মেডিকেল কলেজের আউটডোর ভবন) পড়াশুনা করে ফেরার পথে ঐ কোনাটির কাছে পৌঁছালে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার কিছু ছাত্র আমাদেরকে ঘিরে ধরতো এবং জিজ্ঞাসা করতো আমরা যুক্ত নির্বাচনী চাই, না পৃথক নির্বাচন চাই। তখন প্রগতিশীল সমস্ত বাঙালি যুক্ত নির্বাচন চাইতো কিন্তু সাম্প্রদায়িক দলগুলো, বিশেষ করে মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তানপন্থী ক্ষুদ্র গোষ্ঠী চাইতো পৃথক নির্বাচন এবং বলতো হিন্দু-মুসলমান যৌথভাবে ভোট দিলে ইসলাম চলে যাবে। আমরা যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে বললে আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্ররা বেজায় নাখোশ হতো এবং বলতো এটা হবে ইসলামবিরোধী কাজ। তাই ইসলামের স্বার্থে পৃথক নির্বাচনকে সমর্থন দেয়ার আহ্বান জানাতো।

১৯৫৫-৫৬ সালে ঢাকা শহরে জনসংখ্যা ৫/৬ লাখের বেশি ছিল না। আমরা কাপড়-চোপর কিনতে অনেক সময় হেঁটে ইসলামপুরে চলে যেতাম। পুরান ঢাকার বাসিন্দারা আমাদের ‘তাদের নওয়াব ছাবের হোটেলে’ (অর্থাৎ সলিমুল্লাহ হলে) থাকি বলে সমীহ এবং সমাদর করতো। তখন উর্দু-বাংলা বিতর্ক তুঙ্গে এবং উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গেলানোর জন্য পাকিস্তানপন্থীরা বেজায় সক্রিয়। উর্দুর সপক্ষে প্রচারণার জন্য সোলায়মান নদভি নামক এক ‘আল্লামা’কে নিয়ে আসা হলো। কার্জন হলে এক ভাষণে ঐ আল্লামা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে এবং ইসলামের স্বার্থে উর্দুর পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখলেন। কিন্তু বিধি বাম। উপস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ ‘শেইম শেইম’ ধ্বনিতে আল্লামাকে ধিক্কার জানালেন। তাতে ঢাকার পুরান বাসিন্দাদের কেউ কেউ বেশ মনঃক্ষুণœ হয়েছিল বলা যায়। পুরান ঢাকায় তারা সে বিরক্তিরই প্রকাশ ঘটালেন একদিন আমাদের পেয়ে। বললেন, ‘আল্লামা কারে কয়, যে নাহি এলেমের জাহাজ’ আর তারে কিনা ছাত্ররা কয় ‘ছেইম ছেইম’। ইসলাম ও ধর্মকে ‘অপমান’ করার আরো বহু ঘটনা তখন পাকিস্তানপন্থী লোকজন, অবাঙালি মোহাজের, মর্নিং নিউজ এবং আজাদ পত্রিকার বদৌলতে অহরহ শোনা যেতো। সম্ভবত ’৫৬-৫৭ সালের কোনো একদিন দেখি সলিমুল্লাহ হলের সামনের রাস্তায় কিছু অবাঙালি ঘোড়ার গাড়ি থেকে মাইকে জোর প্রচার চালাচ্ছে, ভারতে কুকুরের নাম মোহাম্মদ রেখে দিয়েছে (হিন্দুস্তান মে কুত্তাকি নাম মোহাম্মদ রাখদিয়া, নাউজুবিল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ)। ভারত ও হিন্দু বিরোধিতা উসকিয়ে দিয়ে দাঙ্গা বাধানো এবং বাঙালির দাবি-দাওয়াকে নস্যাৎ করার জন্য এসব ধর্ম নষ্টের জিগির তোলা হতো তখন।

১৯৬৪ সালে দেশে আরেকটি বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। তখন কাশ্মিরের হযরতবাল মসজিদে সংরক্ষিত মহানবী (দ.)-এর কিছু নিদর্শনের অবমাননাকে কেন্দ্র করে ধর্মান্ধগোষ্ঠী ধর্ম বিপন্নের জিগির তোলে। ফলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন দেয়াসহ তাদের জানমালের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হয়। এ সবই করা হয় ইসলাম অবমাননার কারণে। অবমাননা হয় কাশ্মিরে, আর এর প্রতিশোধ নেয়া হয় বাংলাদেশের নিরীহ নির্দোষ হিন্দুদের জানমাল ধ্বংস করে। এই হলো ধর্মান্ধদের ধর্মীয় কাজ এবং তথাকথিত ‘ইমানি দায়িত্ব পালন’।

সাঈদীর মৃত্যুদ-ের রায়ের পর থানা, পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ এবং পুলিশ হত্যা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুড়ানো, ট্রেন-বাসে অগ্নিসংযোগ, রেললাইন উপড়িয়ে ফেলা এবং সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, মন্দির ধ্বংস করার মধ্যে ইসলামের সেবা এবং স্বার্থ কী আছে, তা দেশের মানুষের বোধগম্য নয়। অন্যদিকে সাঈদী গংদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগের মঞ্চের আন্দোলনকারীদের বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া এখন ধর্মের শত্রু আখ্যায়িত করে তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। অথচ এই বিএনপিই আন্দোলনের শুরুতে শাহবাগের তরুণদের স্বাগত জানিয়েছিল। এখন তিনি বলছেন, ‘আন্দোলনকারীরা বিধর্মী ও নাস্তিক’। তাদের আন্দোলনে বিপদাপন্ন ধর্ম রক্ষায় তিনি এখন বেজায় ব্যাকুল। তাই সম্প্রতি মুন্সিগঞ্জের এক জনসভায় তিনি অভিযোগ করেছেন, ‘সরকার মসজিদে তালা দিচ্ছে, অথচ নাস্তিকদের রক্ষা করছে’ (ইত্তেফাক ১৬/০৩/১৩)। এসব বক্তব্যের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক তরুণগোষ্ঠী এবং আওয়ামী লীগ সরকারকে ঘায়েল করার নামে আসলে তিনি পাকিস্তানি আমলের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে দেশে নতুন করে চালু এবং চাঙ্গা করতে চাইছেন। আরে তাতে পোয়াবারো হরে জামাতের। কে নাস্তিক আর কে আস্তিক তা বেগম জিয়া জানেন কি করে? সেটাতো স্বয়ং আল্লাহতায়লার জানার কথা। পরম শক্তিশালী সৃষ্টিকর্তাতো তাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন, মেরে ফেলেননি। কারণ তিনি পরম করুণাময় রাহমানুর রহিম। তাছাড়া বেগম জিয়া হঠাৎ করে ধর্ম রক্ষায় এতো ব্যস্ত হয়ে উঠলেন কেন! তার সেøাগান হলো, দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও। তাই জানতে ইচ্ছে হয়, কোনটা তার অগ্রাধিকার, ধর্ম বাঁচাও না দেশ ও মানুষ বাঁচাও!

ধর্মের নামে এই তেলেসমাতি এবং সুবিধাবাদী কাজকর্ম আজকেই প্রথম নয়। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এ দেশের সাধারণ মুসলমানকে অজ্ঞ ও মূর্খ রাখার ব্যাপারে একদল মোল্লা-মৌলভীর ভূমিকাটি অতিসম্প্রতি প্রদত্ত ৯০ বছর বয়সী আলাউদ্দিন বিশ্বাসের জবানিতেই শোনা যাক : ‘তখনকার সময় যারা আলেম ছিলেন তারা আমাদের ইংরেজি শিক্ষার ব্যাপারে অনুৎসাহিত করতেন। তারা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করলে কাফের হওয়ার ফতোয়া দিতেন’ (তিন কালের সাক্ষী, জীবন যেমন, দৈনিক সংবাদ ৩০/০৩/১৩)। যুগে যুগে কালে কালে এই ধর্মান্ধ অজ্ঞ-মূর্খের দল এ দেশের সাধারণ মানুষের উন্নয়ন ও কল্যাণের প্রচেষ্টাকে ধর্মবিরোধী কুফরি কাজ বলে আখ্যায়িত করেছে, যার জের এখনো চলছে। শাহবাগের তরুণদের নাস্তিক-মুরতাদ, তথা কাফের আখ্যায়িত করা সেই একই সূত্রে গাঁথা এবং একই ধারাবাহিকতার ফল। ধর্মের নামে এই অধর্মের বেপারীদের সঙ্গীসাথীরাও দেশ ও জাতির শত্রু।

তবে দেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার এবং চেতনাকে হত্যা করার প্রচেষ্টা। ধর্মীয় রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিপরীতে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য আমাদের ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। দেশে একটি পাকিস্তানি ধাঁচের ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এই অশুভ প্রচেষ্টা তাই ব্যর্থ হতে বাধ্য। বাংলাদেশের মানুষ ধর্ম বুঝে। জামাত এবং বিএনপির কাছ থেকে নতুন করে তাদের ‘ছবক’ নিতে হবে না। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে যখন জোরেশোরে বঙ্গে ইসলামের আগমন ঘটে তখন তা বিএনপি-জামাতের সুবিধাবাদী, জঙ্গিবাদী এবং ভুল ব্যাখ্যার পথ ধরে আসেনি। এসেছে উদার মানবতাবাদী পথ ধরে। রাম-রহিমকে জুদা করে আসেনি। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তার উপরে নাই’Ñ এই মহাসত্যকে ধারণ করে অতীতের মতো অনাগত ভবিষ্যতেও বাঙালির ধর্ম সাধনার বিরতি ঘটবে না। হিংসা ও হত্যার পথে ধর্ম সাধনা হয় না।

মোঃ মইনুল ইসলাম : অধ্যাপক (অব.) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ভোরের কাগজ : বুধবার, ১০ এপ্রিল ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন