ফারুক যোশী
বাংলাদেশ যাচ্ছে কোন দিকে? সে এক প্রশ্ন সারা দেশজুড়ে। এখানেও অর্থাৎ ব্রিটেনসহ পৃথিবীর দেশে দেশে বহু উচ্চারিত কথা এগুলো। মুক্তিযুদ্ধের ৪২ বছর পর দেশ যেখানে স্বকীয়তা আর ঐতিহ্য নিয়ে এগিয়ে যাবার কথা, সেখানে আবির্ভূত হয়েছে নতুন এক অপশক্তি। ধর্র্মীয় উন্মাদনা যেন চট্টগ্রাম থেকে ধেয়ে আসছে। যেন অন্ধকারের এক মহাপ্লাবন ঢাকার দিকে ছুটে গেলো গত ৬ এপ্র্রিল। সে প্লাবন যেন জানিয়ে দিয়ে গেলো আমাদের রাজনৈতিক এমনকি সাংস্কৃতিক ভিতটা কতোই নড়বড়ে। লাখ লাখ মানুষের আবেগকে আমি দোষ দেই না। কিন্তু যে সাহসটুকু দেখালো তারা, তা কিন্তু ভাবিয়ে তুলছে গোটা জাতিকে। ইসলামি দল থাকতেই পারে।
একটা গণতান্ত্রিক দেশে এবং মুসলিম কিংবা ইসলামি বিশ্বাসে বাস করা নব্বই শতাংশ মানুষের কাছে ইসলামি চেতনা থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু হেফাজতে ইসলামের মতো একটা অরাজনৈতিক সংগঠন (তাদের ভাষায়) যে দাবি নিয়ে ঢাকার দিকে লংমার্চ করলো এবং ১৩ দফা দাবি দিয়ে তার বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে আল্টিমেটাম দিলো, তাতে কিসের ইঙ্গিত দিয়ে গেলো তারা?বাংলাদেশ যাচ্ছে কোন দিকে? সে এক প্রশ্ন সারা দেশজুড়ে। এখানেও অর্থাৎ ব্রিটেনসহ পৃথিবীর দেশে দেশে বহু উচ্চারিত কথা এগুলো। মুক্তিযুদ্ধের ৪২ বছর পর দেশ যেখানে স্বকীয়তা আর ঐতিহ্য নিয়ে এগিয়ে যাবার কথা, সেখানে আবির্ভূত হয়েছে নতুন এক অপশক্তি। ধর্র্মীয় উন্মাদনা যেন চট্টগ্রাম থেকে ধেয়ে আসছে। যেন অন্ধকারের এক মহাপ্লাবন ঢাকার দিকে ছুটে গেলো গত ৬ এপ্র্রিল। সে প্লাবন যেন জানিয়ে দিয়ে গেলো আমাদের রাজনৈতিক এমনকি সাংস্কৃতিক ভিতটা কতোই নড়বড়ে। লাখ লাখ মানুষের আবেগকে আমি দোষ দেই না। কিন্তু যে সাহসটুকু দেখালো তারা, তা কিন্তু ভাবিয়ে তুলছে গোটা জাতিকে। ইসলামি দল থাকতেই পারে।
জাতীয় শিক্ষানীতির বাস্তবায়নে তারা বাধা দিচ্ছে, তাদের ভাষায় ব্যক্তি ও বাক স্বাধীনতার নামে বেহায়াপনা, ব্যভিচার, অনাচার প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বলন বন্ধ, নারীনীতি-শিক্ষানীতি বাতিল, ভাস্কর্য স্থাপন বন্ধ করা, ব্লগারদের গ্রেপ্তার ও ফাঁসিসহ ১৩ দফা দাবি নিয়ে তাদের চলছে আন্দোলন।
সহজ হিসাব আমাদের। বাঙালি জাতির। আমাদের অর্জন আছে ৪২ বছরের। তাদের কথায়ই বোঝা যাচ্ছে এগুলো আমরা অর্জন করেছি এই বাংলাদেশে। সারা বিশ্বে এ নিয়ে আমাদের একটা সামনে এগিয়ে যাবার পরিচিতিও আছে। এই পরিচিতি কিংবা এই অর্জনকে মুছে ফেলতেই তারা চট্টগ্রাম থেকে ডাক দিয়েছে। এই ডাকে সাড়া দিয়েছে লাখ লাখ মানুষ। লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে আছে জামাতী সন্ত্রাসীরা। এদের সঙ্গে আছে বিএনপির কর্মীরা। সঙ্গে আছে জাতীয় পার্টির এরশাদরা। খুব সহজ এবং সোজা কিছু বক্তব্য আমরা শুনেছি তাদের কাছ থেকে। তারা দফায় দফায় বলেছেন নাস্তিকদের বিচার করতে হবে। কে সেই নাস্তিক? এরশাদ একজন আস্তিক বলেই দাবি করেছেন। যেহেতু তিনি নাস্তিকদের বিচার দাবি করেছেন। কোন আস্তিকতায় লেখা আছে মেরী-মরিয়মদের সঙ্গে ১০ মিলিয়ন ডলারের লাম্পট্যের কথা। কোন আস্তিকতায় লেখা আছে স্বৈরাচার টিকিয়ে রাখতে শত শত ছাত্র-তরুণদের হত্যা করার কথা। খালেদা জিয়া কিংবা নিজামী কিংবা ঐ সুফিদের প্রশ্ন রাখতে ইচ্ছে হয় কোন আস্তিকতায় লেখা আছে একজন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বসে গল্প করে দেশ চালানো যায়, আন্দোলনের গতিধারা নির্ধারণ করা যায়Ñ আবার নারী-পুরুষের অবাধ কথা বলার বিরুদ্ধে দাবি তোলা হয়। এখানে কি বেহায়াপনা পরিলক্ষিত হয় না?
নারীদের ঘরে আটকিয়ে রাখতে গেলে লাখ লাখ নারীদের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির চাকা কে চালাবে? ঐ হেফাজতিরা তো লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি দিয়ে গিট দেয়া ছাড়া একটা সুচ কী চালাতে সক্ষম? অথচ খালেদা জিয়াও ঐ দাবিগুলোকে সমর্থন জানাচ্ছেন, সংহতি জানাচ্ছেন। যদি মামাবাড়ির এই আবদারটা স্বপ্নেই পেয়ে যায় হেফাজতিরা, তাহলে খালেদা জিয়ার জায়গা হবে কোন জায়গায়? ঘোমটা পরে কিচেনে কিংবা বোরকা পরা মঞ্চে না কি? তাদের দাবিগুলো যদি সরকারকে পাত্তা দিতে হয় তাহলে নারীরা মাঠে থাকবে না। নারীরা সাংবাদিক হতে পারবেন না। নারীরা কাজ করতে পারবেন না। নারীরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবেন না। নারীরা তাদের দাবি নিয়ে কথা বলতে পারবেন না। প্রকারান্তরে শেখ হাসিনাও থাকবেন না, থাকবেন না খালেদা জিয়াও। ঘরের কোনায় যাবেন। অন্যদিকে দাবি মেনে নিলে স্মৃতিসৌধ ভেঙে যাবে, অপরাজেয় বাংলায় ক্রেন লাগবে। দেশের সবকিছু, সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে হবে। অন্ধকার চারদিকেÑ অমাবস্যার গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে যাবে দেশ। আমরা এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, যেখান থেকে খুব সহজভাবে ডাক দেয়া যায়। সব ইসলাম নামধারী দলগুলোর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই দাবি সব সময় ঘোরপাক খায়। অর্থনীতি-দারিদ্র্য-সভ্যতা এদের স্পর্শ করে না। শুধুই এদের সামনে ঐ শব্দগুলো। দফায় দফায় দাবি। সরকার-বিরোধী দল-ছোটখাটো দলগুলোর নেতানেত্রীদের কেউ কেউ নামাজ-কালাম পড়ে না, তাদের বাসায় মদের বার থাকে তারা ঐসব অভিযোগে গ্রেপ্তারও হয়, নেতাদের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের লাম্পট্যের অভিযোগ তারপর এরাই যেন আস্তিক-নাস্তিক কিংবা পবিত্রতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। কি অদ্ভুদ রাজনীতি আমাদের!
কি এক মধ্যযুগীয় দাবি ঐ হেফাজতিদের। অথচ বিএনপি এই দাবি সমর্থন করে, করেন এরশাদও। জামাতীরাতো আছেই। কারণ তারাতো তাদের মিশন সার্থক করতে তা-ব চালিয়ে যাচ্ছে সারা দেশব্যাপী। হেফজতিদের দিয়ে তারা তাদের মিশন সার্থক করতে চায়। ঠিক পাশাপাশি আমাদের বিস্ময়ের সঙ্গে শুনতে হয় সরকারের কথা। সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খা আলমগীর যখন বলেন হেফাজতিদের দাবিগুলো বিবেচনা করা হবে, তখন আমরা কার ওপরই বিশ্বাস রাখি? আমাদের তখন সন্দেহ দানা বাঁধেÑ গত ৪২ বছরের অর্জনকে সরকারও সন্দেহের চোখে দেখছে না কি ? নতুবা এখানে ঐ মধ্যযুগীয় চিন্তা-ভাবনাকে তিনি বিচেনায় নিয়ে নেন কোন যুক্তিতে? অন্যদিকে হানিফের মতো বেশি কথা বলা নেতা যখন বলেন হেফাজতিদের দাবি অযৌক্তিক এবং মধ্যযুগীয়, তখন আমাদের প্রশ্ন রাখতেই হয় সরকার কোন বিভ্রান্তির মাঝে আছে। সমন্বয় নেই সরকার আর তার মানুষগুলোর মাঝে। যদি তাদের মাঝেই সমন্বয় না থাকে, তাহলে জনগণ বিভ্রান্তির মাঝেই তো পড়বে। এমনকি নিরাপত্তায় দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ কিংবা প্রশাসন কোন দিকে যাবে? হেফাজতিদের হুঙ্কারের পর ব্লগারদের নিয়ে একটা বিছরি কা- করলো সরকার। ব্লগারদের ধরা হলো এমনকি রিমান্ডে নেয়া হলো। এখানে রিমান্ডে নেয়ার মতো কি আছে? যা তারা লিখেছে, তা-ই তো তাদের এভিডেন্স। এখানে রাখঢাকের কিছু নেই। কিন্তু তবুও তাদের রিমান্ডের ব্যাপারটা আসে কেন। তাছাড়া সুফিও বলেছেন ব্লগ শুধু নাস্তিকরাই করে না , ব্লগ করে আলিম-ওলামারাও। কিন্তু সরকার তথাকথিত নাস্তিক ব্লগারদের পাশাপাশি বাশের কেল্লা জাতীয় কিংবা নামে-বেনামে ইসলামি ধুয়া তোলা বিভিন্ন ব্লগার কিংবা ব্যক্তিদের কি রিমান্ডে নেবে না। এরা আস্তিকতার জিগির তুলে যেভাবে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, তা ইসলামের শান্তির পতাকার সঙ্গে যায় না। এখানেও সরকার এক ধরনের ব্যর্থতার মাঝেই হাবুডুবু খাচ্ছে। অর্থাৎ চাপে পড়ে তরুণ ব্লগারদের গ্রেপ্তার কিংবা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা আর চাপ না থাকায় বিভ্রান্তি ছড়ানো কথিত ইসলামি ব্লগারদের কিছু না করা। ব্লগারদের ধরে প্রকারান্তরে ঐ বিভ্রান্তি ছড়ানোকারী বাঁশের কেল্লা কিংবা সামহ্যোয়ার ব্লগারদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।
আর ব্লগারদের বলতেও ইচ্ছে হয়, সমাজ-সভ্যতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধর্মের অপব্যবহারকারীরা অনেক সময়ই মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করেছে। তাদের প্রয়োজনে তারা ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছে সময়ে সময়ে। এখনো দিচ্ছে। জামাত কিংবা মওদুদীদের কথা বিভিন্নভাবেই উচ্চারিত হচ্ছে ইসলাম ধর্মের অপব্যাখ্যাকারী হিসেবে, এমনকি ইসলামি চিন্তাবিদরাও তাদের ধর্মের অপব্যাখ্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সেই জায়গায় পবিত্র ধর্মকে কেনইবা ব্লগাররা টার্গেট করেন। কি মুসলমান, কি হিন্দু, কি বৌদ্ধ প্রত্যেকটা ধর্মকেই বিভিন্ন সময় ব্যবহার করেছে ঐ বকধার্মিকরা। ধর্মের নাম নিয়ে এরা রোহিঙ্গা নিধন করছে। ঐ ধার্মিকদের অনেকেই বাবরি মসজিদ ভেঙেছে আবার এই ধর্মের নাম নিয়েই বাংলাদেশে মন্দির গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, হত্যা-ধর্ষণ চালানো হচ্ছে, অগ্নিসংযোগ হচ্ছে হিন্দু তথা সংখ্যালঘুদের স্থাপনায়। কিন্তু তাই বলে ধর্মকে গালি দিয়ে ঐ ভ-দের বিরুদ্ধে যাবার কোনো প্রয়োজন আছে? সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী জামাতী-মওদুদীবাদীদের বিরুদ্ধেই লড়তে হবে। বিরুদ্ধাচরণ করার কি কোনো প্রয়োজন আছে ধর্মের সঙ্গে? ধর্মীয় বিশ্বাস যার যার। এ স্বাধীনতাটুকু থাকতেই পারে। কিন্তু যে স্বাধীনতায় সমাজে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে সে স্বাধীনতাটুকুর প্রকাশ না ঘটালেই হয়। আর নাস্তিকতা এমন কোনো ব্যাপার নয়, যা প্রকাশ্যে বলে বেড়াতে হবে। এই ব্রিটেনে কয়েক মিলিয়ন মানুষ আছে, যারা নাস্তিক। কিন্তু তাদের কথা কখনো উত্তাপ সৃষ্টি করে না। কারণ নাস্তিকতার কথা বলে এরা বাহবাও কুড়াতে চায় না, তাই।
ধর্মের অপব্যাখ্যাকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়তেই হবে। আমরা মধ্যযুগে ফিরে যাবার এমনকি স্বপ্নও দেখতে পারি না। হেফাজতিরা যে দাবি নিয়ে এগুচ্ছে, সে দাবিগুলোকে অন্ধকারের দিকে ফিরে যাবার আহ্বান। এই আহ্বানে বাঙালি সাড়া দিতে পারে না। বাংলাদেশকে পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষ কোনো তালেবানি রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায় না। যেখানে মেয়েরা বোরখার অন্তরালে ঢেকে রাখবে নিজেদের। যেখানে শিক্ষা কিংবা নারীদের পথ চলতে হবে অন্ধকারের অতলান্তের দিকে। হেফাজতিদের মিছিলে সেøাগান উঠেছে তারা নাকি তালেবানি রাষ্ট্র বানাতে চায়। সেই সেøাগান উচ্চারণকারীরা লাখ লাখ হতে পারে কিন্তু এরা ষোল কোটি নয়। এ কথাটি বিরোধী দলগুলো কি ভাববে। এরা হয়তো ভাববে না। কারণ সম্মুখে তাদের ক্ষমতার হাতছানি। তবে এ কথাগুলো ভাবতে হবে ম খা আলমগীরের কিংবা সরকারেরও। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পেছনে এই তালেবানি চেতনা কাজ করেনি কখনো। রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রের অগণিত মানুষ ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মদানকে চেতনায় গেঁথে রাখবে। তারুণ্য পিছু হটতে পারেই না। বাঙালিদের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা, সেই স্বাধীনতায় তালেবানি রাষ্ট্রের চিন্তা যারা করে, তারা আর যে-ই হোক সে বাঙালি হতে পারে না। সে হতে পারে না এমনকি বাংলাদেশী।
ফারুক যোশী : সাংবাদিক, লেখক।
ভোরের কাগজ : বুধবার, ১০ এপ্রিল ২০১৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন