বৃহস্পতিবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৩

হেফাজতের দাবি অযৌক্তিক ও সংবিধান পরিপন্থীঃ আইন মন্ত্রণালয়ের অবস্থানপত্র

আশরাফুল হক রাজীব
আইন মন্ত্রণালয়ের এক অবস্থানপত্রে বলা হয়েছে, কোরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করার দাবি সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী। আর ধর্ম অবমাননার শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নতুন আইন প্রণয়ন করার দাবি অযৌক্তিক। হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি সম্পর্কে সাংবিধানিক ও আইনগত অবস্থান এভাবেই তুলে ধরেছে আইন মন্ত্রণালয়। প্রতিটি দাবি সম্পর্কে আলাদা ব্যাখা দেওয়া হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ থেকে এ ১৩ দফা দাবি তুলে ধরা হয়।

আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে এ অবস্থানপত্র তৈরি করা হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের প্রধান দাবি হচ্ছে সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন এবং কোরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করা। আইন মন্ত্রণালয়ের অবস্থানপত্রে বলা হয়েছে, এ দাবি সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী। আল্লাহ, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি
মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন পাসের দাবি সম্পর্কে আইন মন্ত্রণালয় বলেছে, দণ্ডবিধির ২৯৫(এ) ধারা অনুসারে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে কেউ ধর্মের প্রতি অবমাননাকর কোনো অপরাধ করলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬-এর ৫৭ ধারায় শাস্তির বিধান রয়েছে। দু-একটি মুসলিম রাষ্ট্র ছাড়া বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রেই এ অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান নেই। এ অপরাধ দমনে দেশের বিদ্যমান আইন যথেষ্ট উপযোগী। তাই নতুন করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে আইন প্রণয়নের কোনো দরকার নেই।
'শাহবাগ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং নবীকে নিয়ে কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তির দাবি' করেছে হেফাজতে ইসলাম। এ দাবি সম্পর্কে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ নতুন প্রজন্মের প্রগতিশীল চিন্তাধারার যুবশক্তি শাহবাগ চত্বরে সমবেত হয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনকারীদের বিচার দাবি করে আসছে। তারা ধর্মদ্রোহী বা ধর্ম অবমাননাকারী নয় বলে শুরু থেকেই দৃঢ়ভাবে দাবি করে আসছে। শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে নেতৃত্বদানকারী এবং অংশগ্রহণকারী যুবসমাজ ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় বহুবার উচ্চারণ করেছে যে তারা কোনো সময়ই আল্লাহ, হজরত মুহাম্মদ (সা.), ইসলাম ধর্ম কিংবা অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে কোনো বক্তব্য দেয়নি এবং কোনো কার্যক্রমও গ্রহণ করেনি। এর পরও ইসলাম ধর্ম ও মহানবী (সা.) সম্পর্কে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্য সরকারের নজরে আসায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরই মধ্যে সন্দেহভাজন চারজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তদন্তসাপেক্ষে প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে প্রচলিত আইনানুযায়ী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি কার্যক্রম চলবে। কোনো ব্যক্তি অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সুপরিকল্পিতভাবে অন্যের ওপর দোষ চাপানোর লক্ষ্যে এ ধরনের ষড়যন্ত্র করছে কি না সে বিষয়েও তদন্ত চলবে। তদন্তসাপেক্ষে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যাবে তাদের প্রচলিত আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে।
'ব্যক্তি ও বাক্স্বাধীনতার নামে বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ' বন্ধ করারও দাবি জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। ব্যভিচার দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা অনুসারে দণ্ডনীয় অপরাধ। তা ছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিনেন্স, ১৯৭৫-এর ৭৫ ধারায় প্রকাশ্যে অশ্লীল আচরণের জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। অন্য মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিনেন্সেও শাস্তির বিধান রয়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তি ও বাক্স্বাধীনতা এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব নাগরিকের অবাধ বিচরণ সংবিধানের স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। এ অধিকার ক্ষুণ্ন করে কোনো বিধান প্রণয়ন করা হলে তা সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী হবে। অনুচ্ছেদ ৭ ও ২৬ অনুযায়ী ওই বিধান বাতিলও হবে।
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নাগরিকের অবাধ বিচরণ নিষিদ্ধ করা হলে সরকারি বেসরকারি কর্মস্থলসহ জাতীয় উন্নয়নের চাবিকাঠি গার্মেন্ট সেক্টরের লাখ লাখ নারী কর্মী কর্মহীন হয়ে পড়বে, যা জাতীয় অর্থনীতি ও উন্নয়নকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এ ছাড়া এ দাবি পূরণ করা হলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষা ব্যবস্থা বিলুপ্ত করতে হবে। ফলে নারীর ক্ষমতায়ন বিঘি্নত হবে, যা সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী।
নারীনীতি, শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি প্রসঙ্গে আইন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নারীনীতি ও শিক্ষানীতি বাতিলের কোনো সুযোগ নেই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যসূচিতে মুসলমানদের জন্য ইসলাম ধর্ম শিক্ষা এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য তাদের ধর্ম শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। সংবিধান ও জাতিসংঘের ম্যান্ডেট অনুযায়ী প্রণীত নারীনীতি ইসলাম ধর্মের পরিপন্থী না হওয়ায় এবং জাতীয় শিক্ষানীতিতে ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা থাকায় নারীনীতি ও শিক্ষানীতি বাতিলের কোনো সুযোগ নেই।
অবস্থানপত্রে বলা হয়েছে, সংবিধান অনুযায়ী কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার কোনো সুযোগ নেই। সংবিধানের ২৮ এবং ৪১ অনুচ্ছেদ নাগরিকদের ধর্ম চর্চার সমতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। এর পরও তাদের অমুসলিম ঘোষণা করা হলে সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে তারা আদালতের শরণাপন্ন হতে পারবেন।
দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্য স্থাপন বন্ধ করার দাবি সম্পর্কেও সাংবিধানিক এবং জাতিসংঘের কালচারাল হেরিটেজ-সংক্রান্ত বিধিবিধান তুলে ধরা হয় অবস্থানপত্রে। এতে বলা হয়, সংবিধানের ২৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে সরকার জাতীয় সংস্কৃতি ও শিল্পকলাগুলোর পরিপোষণ এবং উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে মুসলি্লদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায়ে বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করার দাবি করেছে হেফাজতে ইসলাম। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের কোনো মসজিদে নামাজ আদায় কিংবা অন্যান্য ধর্মীয় কার্যকলাপ পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো বাধা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়নি বলে আইন মন্ত্রণালয়ের অবস্থানপত্রে বলা হয়। তবে সম্প্রতি একটি রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসীরা মুসলি্ল বেশে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে প্রবেশ করে ওই মসজিদের খতিবকে জুমার নামাজে ইমামতি করা থেকে বিরত থাকতে জোরপূর্বক বাধ্য করে। একই সঙ্গে মসজিদের ভেতরে জায়নামাজে আগুন ধরিয়ে দেয়। জাতীয় মসজিদ ও ধর্মপ্রাণ মুসলি্লদের নিরাপত্তার স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শৃঙ্খলামূলক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করায় ধর্মপ্রাণ মুসলি্লরা নির্বিঘ্নে মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায়সহ অন্যান্য ধর্মীয় কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করছেন।
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা হেফাজতে ইসলামের সব দাবির সাংবিধানিক ও আইনগত দিক ব্যাখ্যা করেছি। এসব দাবির সবই অযৌক্তিক। বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অনুভূতিকে সর্বোচ্চ সম্মানের স্থানে রেখে সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতেই বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম এবং অনুচ্ছেদ ২ক-এ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংরক্ষণ করায় মূলত আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস সংবিধানে সংরক্ষিত আছে। ফলে হেফাজতে ইসলামের ১ নম্বর দাবিটি সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী।'
মন্ত্রী বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। এ সম্পর্কে একাধিক আইন রয়েছে। তাই মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নতুন আইন প্রণয়নের কোনো দরকার নেই। নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ বন্ধ করলে সব গার্মেন্ট বন্ধ করতে হবে। এটা করা হলে জাতীয় অর্থনীতি ও উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে নারীর ক্ষমতায়ন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী। তিনি বলেন, কাউকে সরকার অমুসলিম ঘোষণা করতে পারে না। কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার কোনো সাংবিধানিক সুযোগ নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী জানান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে এ অবস্থানপত্র তৈরি করা হলেও এটা সরকারেরই অবস্থান। এ অবস্থানপত্র প্রয়োজনে সরকারের অন্যান্য সেক্টরেও ব্যবহার করা হবে।
'রেডিও-টেলিভশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাড়ি-টুপি ও ইসলামি কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসিঠাট্টা এবং নাটক-সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস' বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। এ বিষয়ে অবস্থানপত্রে বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে নাটক-সিনেমায় ধর্মের প্রতি অবমাননাকর কিছু প্রচার করা হলে তা প্রচলিত আইনেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে নাটক-সিনেমায় সাধারণত সামাজিক ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলির প্রতিফলন ঘটানো হয়। সেখানে ইতিবাচক-নেতিবাচক উভয় ধরনের চরিত্রই প্রদর্শন করা হয়।
মন্ত্রণালয়ের অবস্থানপত্রে বলা হয়, সংবিধানে স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনসহ তা প্রচারেরও অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্ম প্রচারের কাজ বন্ধ করা সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন হবে। কোনো এনজিও বা মিশনারি কোনো ধর্মের প্রতি অবমাননাকর কোনো কর্মকাণ্ড করলে তা প্রচলিত আইনেই বিচারযোগ্য। এতে আরো বলা হয়, বর্তমানে দেশে কোনো গণহত্যা সংঘটিত হয়নি। এ ছাড়া দেশের কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ ও মসজিদের ইমাম-খতিবকে হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ তাঁদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রসংক্রান্ত কোনো ঘটনাও ঘটেনি।
#
কালের কণ্ঠ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন