মঙ্গলবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৩

হেফাজতে ইসলাম নেতৃত্ব প্রশ্নগুলো ভেবে দেখবেন কি?

শেখর দত্ত
হেফাজতে ইসলামের লং মার্চ পরবর্তী মহাসমাবেশ হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি সত্ত্বেও বিশাল হবে এমন ধারণা ছিল। কিন্তু এতো বিশাল যে হবে তা ধারণারও অতীত ছিল। শক্তি-সামর্থ্যরে ক্ষমতা সংগঠনটি ভালোই দেখিয়েছে। বৃহত্তম একটা সমাবেশ করার জন্য যা যা করার দরকার সবই তারা করতে সক্ষম হয়েছে। প্রথমত মহাসমাবেশে জমায়েত হবে কারা তা নিয়ে উদ্যোক্তাদের ভাবতে হয়নি। মাদ্রাসায় ছাত্র-শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই তো রয়েছেই। কেউ বাদ না যাওয়ার ব্যবস্থা তারা করেছিল। দ্বিতীয়ত যাওয়ার জন্য নির্দেশ ছাড়াও ধর্মীয় স্পর্শকাতর স্থানে আঘাত করা হয়েছিল। ইসলাম গেলো, শাহবাগীরা দেশকে নাস্তিক করে ফেলছে; তারা আল্লাহ ও মহানবীর উদ্দেশে কটূক্তি করছে প্রভৃতি সব জিগির তোলা হয়। ফলে জিহাদি মনোভাব নিয়ে তারা ঢাকার মহাসমাবেশে যোগ দেয়।
প্রোগ্রাম ছিল পূর্ব ঘোষিত; তাই আগে থেকেই বড় একটা অংশ ঢাকা চলে আসে। থাকার জায়গার সমস্যা নেই, মাদ্রাসা তো আছেই। তৃতীয়ত জমায়েতের জন্য অর্থের কোনো সমস্যা ছিল না। কোটি কোটি টাকার বাজেট পাওয়া গিয়েছিল। চতুর্থত নামে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ হলেও প্রকৃত বিচারে তা ছিল জামাত, খেলাফতে ইসলাম, ওলামা কমিটি, ফরায়েজী আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফতে মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টিসহ কতক রাজনৈতিক দলের প্লাটফরম বিশেষ। আর জামাত তো ছিলই অপ্রকাশ্যে। উল্লিখিত দলগুলো ১৮ দলীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত দল। ঐক্য গঠনে তারা বেশ পারদর্শিতা দেখিয়েছে। পঞ্চমত বিএনপি ছিল এই জমায়েতের পেছনে ছাতার মতো। নৈতিক-আর্থিক সাহায্য যে ছিল যারপরনাই, তা কারোরই অস্বীকার করার উপায় নেই।

বলাই বাহুল্য জমায়েত ছিল সুপরিকল্পিত; কিন্তু এই বিশাল জমায়েত দিয়ে যা করার পরিকল্পনা ছিল, তা করা সম্ভব হয়নি। বিএনপি-জামাতের ১৮ দলীয় জোটের নীলনকশায় ছিল ওই মহাসমাবেশ থেকে লাগাতার হরতালের কর্মসূচি যেমন ঘোষণা করা হবে; তেমনি জমায়েতকে অন্তত কয়েকদিন বসিয়ে রাখা হবে। এই দুই কর্মসূচি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা জল্পনা-কল্পনাও চলছিল। সমাবেশ শেষ হওয়া এবং সমাবেশস্থল ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত ধারণা করা যাচ্ছিল না যে, কর্মসূচি সম্পর্কে কী ঘোষণা আসছে।

সমাবেশ দেখে আর ওই দুই ধরনের ঘোষণা আসবে ভেবে বিএনপি-জামাতের ১৮ দলীয় জোট ছিল মহাউৎফুল্ল। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের পাল্টা দীর্ঘ সময়ের একটা সমাবেশ দেখাতে পারবে বিএনপি-জামাত, তাই স্বস্তির একটা মনোভাব মঞ্চে ওঠা বিএনপি নেতা ড. মোশাররফের শরীরের ভাষায় প্রকাশ পাচ্ছিল। কিন্তু তা হয়েছে গুড়েবালি! পত্রিকা পাঠে জানা যায়, এতে জোট নেত্রী খালেদা জিয়া রাতের বৈঠকে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। কারণ ১৮ দলীয় জোটের নীলনকশার পর্বত করেছে মুষিক প্রসব! তবে এমন করাটাই অস্বাভাবিক ছিল না। কারণ স্পর্শকাতর স্থানে আঘাত দিয়ে নানা কিসিমের দলগুলোকে বিএনপি-জামাত নির্দেশ দিয়ে ঐক্যবদ্ধ করলেও ধর্মভিত্তিক এই দলগুলোর মধ্যে মতামতের পার্থক্য বিশাল। যদি পার্থক্য না থাকতো তবে সবগুলো মিলে তো একটাই দল হতো!

প্রসঙ্গত, সমাবেশে বক্তাদের বক্তৃতা ছিল সংক্ষিপ্ত। বক্তৃতা যারা মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন, তারাই অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন যে, মতামতের গভীর ও ব্যাপক পার্থক্য এতে ফুটে উঠেছে। সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় মতামতের পার্থক্য তুলে ধরতে মুন্সিয়ানার প্রয়োজন পড়ে। ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো এবং অরাজনৈতিক (ঘোষণামত) সংগঠনগুলোর নেতারা যে রাজনীতির চর্চায় যথেষ্ট পরিণত-পরিপক্ব এবং যার যার রাজনৈতিক অবস্থানে দৃঢ় তা বক্তৃতাগুলোতে প্রমাণিত হয়েছে। জামাত নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসার এক শিক্ষক ও নেতা যখন প্রধানমন্ত্রীর নাম ধরে কটূক্তিপূর্ণ সেøাগান দিয়েছেন, তখন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হেফাজতে ইসলামীর জুনায়েদ বাবুনগরী তাতে দ্বিমত প্রকাশ করে ওই বক্তব্যকে প্রত্যাহার ও প্রত্যাখ্যান করেছেন।

বক্তৃতায় সকল বক্তাই ব্লগার ও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চকে নাস্তিক আর সেই সঙ্গে মহানবীর অবমাননাকারী হিসেবে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করলেও কেবল ১৮ দলের জোটভুক্ত দলগুলোর নেতারা ছাড়া কেউ সরকারকে নাস্তিক বলেননি। শাহবাগের মঞ্চকে উৎখাত করার কথা বললেও সরকারকে উৎখাত করার কথা উচ্চারণ করেননি। তারা এমনটাই বলেছেন যে, ক্ষমতায় থাকতে হলে কিংবা ক্ষমতায় যেতে হলে ১৩ দফা মানতে হবে। অর্থাৎ অন্তত এ ক্ষেত্রে কমবেশি বিরোধী জোট ও সরকারের সঙ্গে সমদূরত্বের নীতি সামনে রেখেছেন।

বক্তৃতার মতো আচরণেও সুস্পষ্টভাবে পার্থক্য চোখে পড়েছে। একটি উগ্র অংশ তো সভাস্থল ত্যাগ করে প্রথম থেকেই প্রেসক্লাব পর্যন্ত এসে জঙ্গি অবস্থান নিয়েছে। সমাবেশ নয়, তাদের লক্ষ্য যে ছিল গণজাগরণ মঞ্চ আক্রমণ করা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সভার পর সুযোগ বুঝে তাই ওই উগ্র অংশই শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিল। আর তাই এই প্রথম দেখা গেলো গণজাগরণ মঞ্চের তরুণদের লাঠি হাতে। কেবল তাই নয় মঞ্চ থেকে যখন শান্তিশৃঙ্খলার কথা বলা হচ্ছিল, তখন শাপলা চত্বরে সোনালী ব্যাংকের গেট থেকে হিংস্রতার প্রতিমূর্তি হয়ে নামিয়ে ফেলা হচ্ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ছবি সংবলিত ব্যানার। অবমাননাকরভাবে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলা হচ্ছিল। এখানে বিবেচ্য বিষয়টা হলো এ রকম যে, ধর্ম নির্বিশেষ যে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের যেমন দায়িত্বশীলতা নিয়ে মহানবীর বিরুদ্ধে কটাক্ষ করা কিংবা মন্দির-প্যাগোডায় আক্রমণ করা উচিত নয়, একইভাবে জাতির পিতার ছবি ছিঁড়ে অবমাননা করাও অনুচিত। দুটোই স্পর্শকাতর ও গর্হিত অপরাধ। সমাবেশের মিছিল থেকে মহিলা সাংবাদিকদের আঘাত করা হয়েছে এই বলে যে, মহিলারা সাংবাদিকতায় থাকতে পারবেন না।

শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশ ও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশের বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করলে এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, দুটো সমাবেশের মধ্যে পার্থক্য আকাশ-পাতাল। শাহবাগের সমাবেশ থেকে পবিত্র ধর্মের বিরুদ্ধে যেমন কোনো শব্দ উচ্চারণ হয়নি, ঠিক তেমনি কোনো উগ্র ধরনের কাজও সংঘটিত হয়নি। আইনকে হাতে তুলে নেয়ার কোনো উদাহরণ রাখেনি শাহবাগ সমাবেশ, কিন্তু শাপলা চত্বরের সমাবেশ থেকে তা হয়েছে। প্রসঙ্গত, শাহবাগের সমাবেশের নেতৃত্বের মধ্যে যেমন মত-পথের পার্থক্য বিরাজমান, তেমনি শাপলা চত্বরের সমাবেশেও তা ছিল। প্রসঙ্গত, বাস্তবতা এমনই যে দেশে নাস্তিক যেমন ব্রিটিশ বা পাকিস্তানি আমলে ছিল; এখনো রয়েছে। একইভাবে ইসলামি চিন্তা-চেতনা ও সংগঠনের মধ্যেও মতামতের পার্থক্য রয়েছে। মওদুদীবাদ পাকিস্তানি আমলেও ছিল, এখনো রয়েছে। কারো ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ধামকি-হুমকি, আদেশ-নির্দেশের ওপর তা নির্ভর করেনি। ব্লগারদের মধ্যে যদি ব্যক্তিগতভাবে কেউ নাস্তিক থাকেন (ব্লগ এমনই বিষয় যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য অন্য নামেও তাতে মতামত প্রকাশ করা সম্ভব) তবে তারা তা মিছিলের সেøাগানে বা বক্তৃতায় নিয়ে আসেননি। মূলত ও প্রধানত দুটো দাবি তুলে ধরেছেন। মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি এবং জামাত-শিবির নিষিদ্ধকরণ। জমায়েত থেকে ঘোষিত হয়েছে, জাতির ওপর থেকে ‘কলঙ্কের বোঝা’ নামিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে দেশকে নিয়ে যাওয়াই হলো লক্ষ্য।

বলার অপেক্ষা রাখে না এতে রাজনীতি আছে, আবার নাইও। গণজাগরণ মঞ্চের চরিত্র যে সূচনায় নিরপেক্ষ ছিল তা বোঝা যাবে এ থেকে যে, প্রথম দিকে বিএনপি পর্যন্ত এই মঞ্চকে অভিনন্দিত করেছে বা পক্ষে বলেছে। বস্তুতপক্ষে তরুণদের ব্লগে প্রচারিত একান্ত নিজস্ব মতামত পত্রিকায় রাজনৈতিক ফায়দা লোটার অসৎ উদ্দেশ্যে প্রকাশ করে বিএনপি ও জামাত উসকানি দিয়ে বিভিন্ন মত-পথের ধর্মপ্রাণ মানুষদের একত্রিত করেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে যে, এতদসংক্রান্ত বিষয়ে সরকার ব্যবস্থা নিলেও এবং হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আলোচনা করলেও উগ্রতাকে বিরোধী জোট থেকে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে খুঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। বক্তৃতা-আচরণে উপরোল্লিখিতভাবে আক্রমণাত্মক হওয়াটা প্রমাণ করে, অরাজক-অস্থির-অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সেনাবাহিনীকে ‘দায়িত্ব পালন’ করতে নামানোটাই যেন বিএনপি-জামাত জোট সংশ্লিষ্ট দলগুলোর অভীষ্ট লক্ষ্য। এক্ষেত্রে বলতেই হয় যে, হেফাজতে ইসলামের মূল নেতা আহমেদ শফী অন্তত এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। ঘটনাকে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার ইস্পিত পথে নিতে দেননি। মঞ্চের সামনে থেকে দাবি ওঠার আগে হরতালের ঘোষণা পর্যন্ত দেয়া হয়নি। সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে বক্তৃতাও তিনি অন্যদের পাঠ করতে দেননি। পুত্র পিতার বক্তব্য পাঠ করেছেন। এখানেও পরিবারতন্ত্র! নাকি কে কী পাঠ করে দেন বলে এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা! বিএনপি-জামাতের উদ্দেশ্য সাধনে উগ্র কর্মসূচির ফাঁদে পা না দিয়ে পরিস্থিতিকে আপাতত ‘সেইভ’ করায় নিঃসন্দেহে ধন্যবাদযোগ্য কাজ করেন হেফাজতে ইসলামের বর্ষীয়ান এই নেতা।

এখন প্রশ্ন হলো এই যে, হেফাজতে ইসলাম আগামীতে বিএনপি-জামাতের উসকানিতে উগ্রতার পথে যাবে নাকি ১৩ দফা দাবি নিয়ে সংযত ও শান্তিপূর্ণ আচরণ করবে? দেশ ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধে ভাগ হয়ে গেছে বলে রাজনৈতিক উদ্দেশে খালেদা জিয়া বা এরশাদ যে উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন তাতে কি ধর্মীয় এই দলটি সায় দেবে? এর পরিণতি কি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশ ও পবিত্র ধর্মের জন্য ভালো হবে? পাকিস্তানি আমলে ও মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে পাকিস্তানি শাসক-শোষকরা এবং ঘাতক-দালালরা ধর্মের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধ সৃষ্টি করার অসৎ উদ্দেশে মাঠে নেমেছিল। ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, ধর্মপ্রাণ মানুষ যখন হানাদার বাহিনী ও ঘাতক-দালালদের চরম নির্যাতন ও হত্যা-খুনের শিকার হচ্ছেন, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রণাঙ্গনে লড়ছেন; তখন সাধারণভাবে কিংবা বলাই বাহুল্য নাম মনে রাখার মতো কোনো ধর্মীয় সংগঠনের নেতৃত্ব দৃঢ় অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নামেনি। এর পরিণতি সংশ্লিষ্ট সকলেরই উপলব্ধিতে নিতে হবে। এবারে অবস্থা অবশ্য ভিন্ন। কোনো কোনো ধর্মীয় সংগঠন এবারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে হেফাজতে ইসলামকে বিবেচনায় নিতে হবে, এ ধরনের পক্ষ-বিপক্ষ ভাগাভাগিতে আদৌ সংগঠনটি জড়িত হবে কিনা। বিএনপি-জামাতের রাজনৈতিক ফাঁদে পা দেবে কিনা। অভিজ্ঞতা কী বলে! বলে এই যে, ঘটনা ঘুরেফিরে ভিন্ন রূপে হলেও একইভাবে ফিরে আসে। তবে প্রথমবার আসে বিয়োগান্ত নাটক হিসেবে আর দ্বিতীয়বার আসে প্রহসনের নাটক হিসেবে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে। হেফাজতে ইসলাম দলটির কাছে নাটক, রঙ্গমঞ্চ ইত্যাদি শব্দ তাজ্য। তাই শব্দগুলো উচ্চারণ করছি বলে অপরাধ হিসেবে গণ্য না করতে বলি। প্রকৃত বিচারে রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, সংসার রঙ্গমঞ্চই বটে!

রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে পদার্পণ করে হেফাজতে ইসলাম ১৩ দফা উত্থাপন করেছে। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের যা অবস্থান তা তারা তুলে ধরেছেন। ভালো কথা! মত প্রকাশের স্বাধীনতা সকলেরই রয়েছে। এই ১৩ দফার প্রতি যদি কোনো রাজনৈতিক দল সমর্থন দেয় কিংবা হেফাজতে ইসলামই রাজনীতিতে নেমে বিজয়ী হয়ে আসে; তবে গণতন্ত্র মোতাবেক জনগণের রায় হিসেবে তা মেনে নিতেই হবে। কিন্তু তার আগে সংগঠনের নেতৃত্বকে কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।

এক. বিগত আওয়ামী লীগ আমলের শেষ দিকে এবং বিএনপি-জামাত আমলে যখন উগ্র জঙ্গি ‘বাংলাভাই’ আর মুফতি গংদের আবির্ভাব হলো, তখন ইসলাম হেফাজতকারীরা কোথায় ছিলেন? অন্য ধর্ম সম্প্রদায়ের একজন সচেতন মানুষ হিসেবে ছোটবেলা থেকে এ কথা জানি এবং বিশ্বাস করি, ইসলাম শান্তির ধর্ম। কিন্তু ১৩ দফায় উগ্র জঙ্গিবাদ সম্পর্কে কিছু নেই কেন? বর্তমান সরকার পবিত্র ধর্মের নামে বোমা-গ্রেনেডবাজি বন্ধ করেছে, এই কাজের প্রশংসা নেই কেন? স্বঘোষিত ও চিহ্নিত তালেবান খেলাফত মজলিশ আমির হাবিবুর রহমান মঞ্চে কেন? এটা কিসের ইঙ্গিতবহ?

দুই. আপনারা যদি রাজনীতি নয়, পবিত্র ধর্মরক্ষার কাজে ব্রতী হন (এমনটা হওয়া ধর্মপ্রাণ হিসেবে যুক্তিযুক্ত) তবে ১৮ দলীয় জোটের রাজনৈতিক নেতাদের মঞ্চে তুললেন কেন? এই ঐক্য কিসের ইঙ্গিত দেয়? ধর্মরক্ষার নাকি রাজনীতির? কৌশলী হয়ে আপনারা চিহ্নিত জামাত নেতাদের কাউকে মঞ্চে তুলেননি অথবা বক্তৃতা দিতে দেননি। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মতো জামাত থেকে কেউ এসে আপনাদের সঙ্গে সংহতি পোষণ পর্যন্ত করলো না কেন? লুকোচুরি খেলা কেন এ নিয়ে? যুদ্ধাপরাধীদের সর্Ÿোচ্চ শাস্তি নিয়ে বা মওদুদীবাদ নিয়ে আপনাদের বক্তব্য নেই কেন? সরকারকে দ্বিমুখী বলে নিন্দা করছেন। কে না জানে রাজনীতি নীতি-কৌশলের খেলা। বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টি কে না বিভিন্ন মুখে খেলছে। তবে ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে কিন্তু আপনাদের আয়নায় মুখ দেখার প্রয়োজন রয়েছে।

তিন. নারী-পুরুষের অবাধ চলাচল বন্ধ করার কথা বর্তমান যুগে আমাদের দেশের বাস্তবতায় আপনারা বলেন কিভাবে? মঞ্চে ওঠা ১৮ দলীয় নেতারা তো খালেদা জিয়ার সঙ্গে অবাধে বৈঠকে মিলিত হন। শেখ হাসিনাকে ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের পূর্বে পবিত্র হজের পরিধেয় পরে রাজনীতির মাঠে নামতে হয়েছিল। আপনাদের জানার কথা তিনি ধর্মপ্রাণ ও নামাজি। কিন্তু বেশভূষা ও ধর্ম পালন নিয়ে খালেদা জিয়া সম্পর্কে নানা কথা রাজনীতির অঙ্গনে রয়েছে। তদুপরি দেশের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে গার্মেন্টস খাত, সেখানে নারী শ্রমিকের সংখ্যাধিক্য। আর্মি-পুলিশ-প্রশাসন-সাংবাদিকতা-শিক্ষকতা-ওকালতি প্রভৃতি এমন কোনো পেশা নেই যেখানে নারীরা নেই। দুস্থ নারীরা ভিক্ষা করছে। মাটি কাটছে, ইট ভাঙছে। বিদেশে শ্রমিক হিসেবে যাচ্ছে। বাড়িঘরে গৃহপরিচারিকার কাজ করছে। আপনাদের নীতি বাস্তবায়িত হলে এ সবের কী হবে? প্রসঙ্গত, ইরানের রাষ্ট্রপতি প্রয়াত ভেনিজুয়েলার রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর পর তার বয়স্কা বিধবা মাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন বলে সেখানকার উগ্রবাদীদের দ্বারা নিন্দিত হয়েছেন, এতে কিন্তু ইসলাম ধর্মের মর্যাদা বাড়েনি। এ নীতি গ্রহণ করলে একঘরে হওয়া ভিন্ন বিকল্প নেই। খালেদা জিয়া ক্ষমতার বাইরে থেকে যাই বলুন না কেন, ক্ষমতায় গেলে তিনি নিঃসন্দেহে বুড়ো আঙুল দেখাবেন।

চার. ভাস্কর্য অপসারণ করার দাবি উত্থাপন করেছেন। এটাও কি বাস্তবসম্মত! তাতে তো চারুকলা ইনস্টিটিউট বন্ধ করতে হবে, নয় কি! ছোটবেলায় পাকিস্তানি আমলের শুরুতে জানতাম, ছবি তোলা গুনাহ। তখনো ওই মত গ্রাহ্যতা পায়নি। আর এখন! টেলিভিশনের সামনে আপনারা পর্যন্ত আসছেন। মহিলাদের সঙ্গে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন। পৌত্তলিকতার সঙ্গে ভাস্কর্যের পার্থক্য আপনাদের বুঝতে হবে, নয় কি?

পাঁচ. আর এটাই বাস্তব হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা এ দেশে রয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছে সব ধর্মাবলম্বীরা। তাই পৌত্তলিকতা বলে দেশ থেকে মূর্তি বিতাড়িত করা যাবে না। এটাই বাস্তব। আপনারা এই দাবি তুলে যদি উগ্রতা সৃষ্টি করেন তবে হিন্দু-বৌদ্ধ মন্দির-প্যাগোডা ভাঙার যে মনোভাব সৃষ্টি হয় তা আপনারা কি অনুধাবন করতে পারেন না? হিন্দু-বৌদ্ধ মন্দির ভাঙা নিয়ে আপনাদের বক্তব্য ও অবস্থান কী? সুস্পষ্ট বক্তব্য দেন। এটা তো আর মধ্যযুগ নয়! এতোটুকু অন্তত বর্তমান যুগে সকলকেই উপলব্ধিতে নিতে হবে যে, নিজ ধর্মের প্রতি ‘আস্থা ও বিশ্বাস’ রাখতে হলে অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও তা রাখার উপায় বের করে দিতে হবে, নয় কি? বর্তমান যুগ হচ্ছে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার যুগ, ধর্মকে এর বিপরীতে প্রতিস্থাপন করা কি যৌক্তিক নাকি তা ধর্ম বিরুদ্ধ। বিএনপি নেতারা দুর্গাপূজার সময় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে যান কেন? জোটবদ্ধ জামাতসহ ১৮ দল, যারা আপনাদের সঙ্গী, তারা তখন বিএনপিকে বাধা দেয় না কেন?

ছয়. ধর্মীয় অবমাননার জন্য শাস্তি মৃত্যুদ- প্রদানের বিষয়ে আইন করার দাবি আপনারা তুলেছেন। প্রশ্ন হলো, কোনটা অবমাননা আর কোনটা অবমাননা নয় তা স্থির করবেন কে? আর ধর্মের অবমাননা মানে কি অন্য সব ধর্মের অবমাননা নয়? এর সংজ্ঞা নির্ধারণ করবেন কে? পত্রিকায় দেখলাম পাকিস্তানে ‘ভালো মুসলিম’ না হলে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া যাবে না বলে আইন হয়েছে। নির্বাচন কমিশন জাজদের নিয়োগ করেছে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। সীতা দেবীর অগ্নিপরীক্ষার মতো ব্যবস্থা! ১০০-এর বেশি প্রার্থী এই পদ্ধতিতে বাদ পড়েছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফ এখনো ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হননি। প্রসঙ্গত, পবিত্র ধর্মকে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে টেনে এনে পাকিস্তানের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব কোন পর্যায়ে গেছে তা হেফাজতে ইসলামী নেতৃত্বকে ভেবে দেখতে বলি। ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবারÑ এই মত নিয়ে চললেই পবিত্র ধর্ম মহিমান্বিত হয়ে উঠবে। প্রশ্ন হলো, মসজিদ থেকে উলুধ্বনি উঠবে বলে জিগির তুলে যারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চান, তারাই প্রকৃত অর্থে কি ধর্মের অবমাননা করেন না?

ক্ষুদ্র এ কলামে সবশেষে বলতে হয়, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ধর্মের অবমাননা করেছে, এর উদাহরণ দেয়া বাস্তবে অসম্ভব। ব্লগে প্রকাশিত বলে কথিত মহানবীর প্রতি কটাক্ষ করে লেখা অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার আগে আপনারাও তো এ নিয়ে মাঠে নামেননি। তাই অপরাধ কি আপনারাও করেননি? এটা কার না জানা মহানবীর প্রতি কটাক্ষ যদি কেউ করে, তবে দেশে কেন, পৃথিবীব্যাপী কোনো মুসলমানই তা সহ্য করবেন না। তাই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ নিয়ে জাতীয়ভাবে সমাধানে আসা যেতেই পারে, যাওয়া দরকারও। প্রসঙ্গত, ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত বিশ্বখ্যাত শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন ‘উলঙ্গ সরস্বতী’[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: থএড়ইধপশ][জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: থএড়ইধপশ] অঙ্কন করেছিলেন। ভারতীয় জনগণ এ নিয়ে ধর্মীয় উগ্র ধর্মবাদীদের আস্ফালনে পাত্তা দেয়নি। বলাই বাহুল্য দেশ-কাল বিবেচনায় আইন হয়, মত প্রকাশে দায়িত্বশীলতারও দেশজ রূপ রয়েছে। এটাই গণতন্ত্র। তাই খালেদা জিয়া বা এরশাদের মতো ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে আনবেন না, ধর্মকে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিস্থাপন করবেন না, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে ধর্মকে জড়াবেন না। চাঁদে সাইদীকে দেখা যাচ্ছে বলে ধর্মকে রাজনীতিতে অপব্যবহার যারা করছে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রধান কর্তব্য। উল্টোদিকে নাস্তিকতাকেও রাষ্ট্র ও রাজনীতির সঙ্গে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে জড়ানোর কোনো অবকাশ নেই। রাজনীতি রাজনীতির মতো চলুক, রাজনীতি দিয়েই রাজনীতির মীমাংসা হোক, বাংলার নতুন বছরের শুভাগমনের দিনগুলোতে এটাই দেশবাসীর একান্ত কামনা।

শেখর দত্ত : রাজনীতিক, কলাম লেখক।
ভোরের কাগজ : মঙ্গলবার, ৯ এপ্রিল ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন