সোমবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৩

হেফাজতের দাবি আর ভোট রাজনীতির হিসাব-নিকাশঃ কর্মহীন হওয়ার শঙ্কায় কোটি নারী

হাসান নাসির ॥ ‘আমরা খুবই নিরীহ। রাজনীতি বুঝি না। কিন্তু পেটে লাথি পড়লে চুপ করে বসেও থাকব না। প্রয়োজনে ঝাঁটা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসব।’
উক্তিটি একজন পোশাককর্মীর। হেফাজতে ইসলামের দাবিতে উদ্বিগ্ন তারা। ধর্মভিত্তিক এ সংগঠনটির ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়িত হলে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের কাজ করার সুযোগ বন্ধ হবে। ফলে শুধু পোশাককর্মীই নয়, কর্মহীন হওয়ার শঙ্কায় এখন দেশের প্রায় এক কোটি নারী। মুখ থুবড়ে পড়বে দেশের সিংহভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী পোশাক খাত। এজন্য দুশ্চিন্তায় শিল্প মালিকরাও। কারণ হেফাজতে ইসলামের দাবিÑ ক্ষমতায় যেতে ও থাকতে হলে তাদের দাবি মেনে নিতে হবে। উৎকণ্ঠা আরও বেড়েছে এজন্যই যে, হেফাজতের লংমার্চ কর্মসূচীতে নৈতিক সমর্থন দিয়েছে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট।
শুধু তাই নয়, সশরীরে মঞ্চে গিয়ে সংহতি প্রকাশ করে এসেছেন বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা। এদিকে, নারী বিষয়ে হেফাজত ইসলামের অবস্থান এবং এ অবস্থানের প্রতি বিএনপির সমর্থনের পর শুরু হয়ে গেছে ভোটের সমীকরণও।
বিজিএমইএ সূত্রেপ্রাপ্ত তথ্যমতে, বর্তমানে শুধু পোশাক শিল্পে নিয়োজিত রয়েছে প্রায় ৩০ লাখ নারীকর্মী। শ্রমনির্ভর এই শিল্পে নারীরাই মূল জনশক্তি। এরা পুরুষের পাশাপাশি থেকে কাজ করে থাকেন। পোশাক শিল্প, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন এনজিও, ব্যাংক-বীমা ও সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মিলে প্রায় এক কোটি নারী এখন কর্মজীবী। তাছাড়া বর্তমানে যেসব কিশোরী-তরুণী শিক্ষা জীবনে রয়েছে তাদের চোখে-মুখেও স্বপ্নÑ একদিন তারা হবে উচ্চপর্যায়ের এক্সিকিউটিভ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ব্যাংকার বা কোন না কোন ক্ষেত্রে কর্মজীবী। সে স্বপ্নের বাস্তবায়নেও এখন অনিশ্চয়তা। শুধু তাই নয়, হেফাজতের ১৩ দফা দাবি মানা হলে তাদের শিক্ষা জীবনও পড়বে হুমকির মুখে। এ নিয়ে এখন ব্যাপক আলোচনা সাধারণ মানুষের মধ্যে। বুঝে কিংবা না বুঝে যারা প্রথমে হেফাজতের লংমার্চকে সমর্থন জানিয়েছিলেন তারাও যেন অনেকটাই চুপসে গেছেন। আর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যাঁরা সমর্থন জুগিয়েছিল তাঁরা পড়েছেন বেশ বেকায়দায়।
বিজিএমইএ’র প্রাক্তন সিনিয়র সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরীর কাছে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বাস্তবায়ন নয়, বরং এ ধরনের দাবি বিবেচনা করারও কোন যুক্তি থাকতে পারে না একবিংশ শতাব্দীতে। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, যদি নারীদের কর্মজীবী হওয়ার পথ রুদ্ধ হয় তাহলে সবার আগে বন্ধ হয়ে যাবে এদেশের পোশাক শিল্প। এই শিল্প শুধু বৈদেশিক মুদ্রাই অর্জন করছে না, বিপুলসংখ্যক নারীর কর্মসংস্থান করেছে। যে নারীরা এখন পেটের দায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন তাঁদের আবার ঘরে ফেরানোর অপচেষ্টা কেউ মেনে নেবে না। তিনি বলেন, এ ধরনের দাবি শুধু অসাংবিধানিকই নয়, বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন কোন দল বা ব্যক্তি করতে পারেন না। বিজিএমইএ’র এ নেতা বলেন, এসব দাবির প্রতি সংহতি জানানো কিংবা বিবেচনার কোন সুযোগ থাকা উচিত নয়। এমন দাবি বাস্তবায়িত হলে দেশ এক শ’ বছর পিছিয়ে যাবে।
কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের লংমার্চ নিয়ে দেশজুড়ে ছিল উৎকণ্ঠা। অনেকেই শুধু সরকার বিরোধিতার খাতিরে এ কর্মসূচীকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়েছিলেন। আর্থিকভাবেও সহায়তা দিয়েছেন। গত ৬ এপ্রিলের এ কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে ছিল সাংঘাতিক রকমের টেনশন। বিশেষ করে অপ্রীতিকর কোন ঘটনা বা নাশকতা হতে পারে এমন আশঙ্কা ছিল জনমনে। বিভিন্ন মহলের সমর্থনে জনস্রোতের ফলে বেশ খোশ মেজাজ এবং আনন্দ পরিলক্ষিত হচ্ছিল সরকারবিরোধী মহলে। কিন্তু মতিঝিলের শাপলা চত্বরের সেই মহাসমাবেশ থেকে যে ঘোষণা এলো তাতে রীতিমতো বেকায়দায় তারা। এখন বরং সুর পাল্টানোর চেষ্টা করছেন লংমার্চ সমর্থনকারীরা।
এদিকে, হেফাজতের এমন দাবি এবং নারীবিরোধী মনোভাবে শুরু হয়ে গেছে ভোটের হিসাব-নিকাশ। দেশের অর্ধেক ভোটার নারী। আবার তাদের একটি বড় অংশ কর্মজীবী। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া নারী ভোটারদের মধ্যে রয়েছে কর্মজীবী হওয়ার প্রত্যাশা। বিএনপি-জামায়াত তথা ১৮ দলীয় জোটের শুধু নৈতিক সমর্থনই নয়, বরং মঞ্চে গিয়ে সরাসরি সংহতি জানানোর বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে সাধারণ মানুষকে। ভাবনাটা এ জন্যই যে, একটি দল ক্ষমতায় থাকলে সাধারণত ঐ দলের জনপ্রিয়তা কিছুটা হ্রাস পায়। জনগণের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ফারাক থাকায় কিছু ভাসমান ভোট বিরোধী দলের পক্ষেই যায়। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান বিরোধী দল অবিবেচকের মতো হেফাজতে ইসলামের লংমার্চকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সুতরাং আগামী সাধারণ নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক নারী ভোটারই হতে পারে জয়-পরাজয়ের নিয়ামক। রাজনৈতিক বোদ্ধামহল মনে করছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে দুই দলের মধ্যে ভোটের পার্থক্য গড়ে দেবে নারীরা।
আবার ভোটের হিসাব-নিকাশ এখানেই শেষ নয়। হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী যদি গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় তাহলেও বর্তমান সরকারের জন্য তা হতে পারে হিতে বিপরীত। শাহবাগে এবং এর অনুসরণে সারাদেশে গণজাগরণের ব্যানারে যারা জড়ো হয়েছে তাদের কোন না কোন রাজনৈতিক বিশ্বাস থাকলেও মানতেই হবে যে, তারা আধুনিক চিন্তা-চেতনার। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ হাজার শিক্ষার্থী থাকলে তার মধ্যে মিছিল-মিটিংয়ে থাকে বড় জোর এক থেকে দেড় হাজার। সংসদ নির্বাচনে বাকিরা সুচিন্তিত রায় দিয়ে থাকে। এ ভোট প্রদানের বিপরীতে তাদের কোন স্বার্থ নেই। তারা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি করে না। ব্যবসা বাগিয়ে নেয়া কিংবা লাইসেন্স পারমিটের ধান্ধায় নেই এ তরুণরা। যেহেতু তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মধ্যে কোন স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা নেই সেহেতু তারা প্রতিবারই একটি দলকে ভোট দেবেই এমনটি রাজনৈতিক দলগুলো আশা করতে পারে না। তরুণ প্রজন্মের সমর্থন ও রায় পেতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকেও অর্জন করতে হবে আধুনিক তারুণ্যকে ধারণ করবার ক্ষমতা। আর যদি সে ধারণক্ষমতা কোন দলের না থাকে তাহলেও মহাবিপদ। এখনকার আধুনিক তারুণ্যের একটি বিরাট অংশই রাজনীতি থেকেও দেশকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাদের ভাবনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি আধুনিক, সমৃদ্ধ, বিজ্ঞানমনস্ক ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ। তাদের এ দাবির প্রতি যদি কোন দলই কর্ণপাত না করে তাহলে নির্বাচনকে সামনে রেখে তৃতীয় কোন রাজনৈতিক ফ্রন্টের আত্মপ্রকাশ ঘটতে পারে। সে প্রক্রিয়া এবং আলামত এখনই পরিলক্ষিত হচ্ছে কিছুটা হলেও।
#
জনকণ্ঠ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন