বুধবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৩

খালেদাসহ হরতাল আহবানকারীদের 'হুকুমের আসামি' করা হবে

কালের কণ্ঠ, নিজস্ব প্রতিবেদক
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারীদের বিচারের জন্য প্রচলিত আইন এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রেখে আইন দুটি সংস্কার করার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এ ধরনের অপরাধের বিচারের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া যারা সহিংস হরতাল আহবান করছে, তাদের সংশ্লিষ্ট মামলায় 'হুকুমের আসামি' করা হবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও বাদ পড়বেন না। এ সিদ্ধান্তগুলো জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। গতকাল মঙ্গলবার পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু ও আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও জামায়াত নিষিদ্ধের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের প্রতিবাদ দেশজুড়ে গণজাগরণ সৃষ্টি করে। এরপর হেফাজতে ইসলামের নামে মাঠে নামে কয়েকটি ইসলামী দল। তারা ব্লগারদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলছে। অভিযোগ রয়েছে, জামায়াতই নেপথ্যে থেকে ব্লগারদের বিরুদ্ধে ইসলামী কয়েকটি দলকে মাঠে নামিয়েছে। এ অবস্থায় স্বরাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী গতকাল যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের বক্তব্য তুলে ধরলেন। এর আগে গত সোমবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তিনজন ব্লগারকে।
সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে যেসব ধর্ম প্রচলিত রয়েছে, সেসব ধর্মের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে কেউ যদি আঘাত করে তবে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে ১১ সদস্যের কমিটিও গঠন করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ধর্ম নিয়ে 'আপত্তিকর' মন্তব্যকারী ব্লগারদের খুঁজে বের করার জন্য কমিটিতে দুজন আলেমকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
তবে ওই কমিটিতে কোনো ব্লগার বা অন্য কোনো ধর্মের প্রতিনিধিকে রাখা হয়নি কেন- সাংবাদিকরা জানতে চাইলে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান তিনি।
আইনমন্ত্রী বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতসংক্রান্ত বিষয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে ঢাকায় একজন বিচারকও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় শহরেও ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচারক নিয়োগ করা হবে।
আইনমন্ত্রী বলেন, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি ওয়েবসাইট কিংবা অন্য কোনো যোগাযোগমাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে চায়, তবে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রেখে প্রচলিত আইন এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ব্লগ, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এবং পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের প্রচলিত আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হবে।
'তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬' এবং দণ্ডবিধির ধারা অনুযায়ী, তাদের বিরুদ্ধে শান্তির বিধান রয়েছে উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, আইন সংশোধন করে শাস্তির মাত্রা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।
স্বরাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী জানান, পবিত্র কাবা শরিফের গিলাফ পরিবর্তনের ছবিকে মানববন্ধন বলে প্রচার চালানোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রসঙ্গত, গিলাফ পরিবর্তনের ওই ছবিকে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের মুক্তির দাবিতে কাবা শরিফের ইমামদের 'মানববন্ধন' বলে কয়েকটি সংবাদপত্র ছবি প্রকাশ করে।
যেসব পত্রিকা ধর্মীয় উসকানি দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন- সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, গণমাধ্যম বা অন্য যে মাধ্যমই হোক না কেন ধর্মীয় উসকানিমূলক ও অবমাননাকর বক্তব্য প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইন প্রতিমন্ত্রী বলেন, যে পত্রিকা এই ছবিকে মানববন্ধন বলে প্রচার করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ঢাকার জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রচলিত আইনে শাস্তি : 'তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬'-এর ৫৭ ধারা উদ্ধৃত করে আইনমন্ত্রী জানান, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহলে তার এই কাজ একটি অপরাধ। এর জন্য সে অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
এ ছাড়া 'তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬'-এর ৬৬ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কম্পিউটার, ই-মেইল বা কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, রিসোর্স বা সিস্টেম ব্যবহারের মাধ্যমে এ আইনের অধীনে কোনো অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করে, তাহলে তার ওই কাজও অপরাধ। সেও সেই দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
দণ্ডবিধির ২৯৫-ধারা অনুযায়ী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান অপবিত্রকরণ, ২৯৫-ক ধারা অনুযায়ী ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসের অবমাননা করলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।
দণ্ডবিধির ২৯৬-ধারা অনুযায়ী ধর্মীয় সমাবেশে গোলমাল সৃষ্টি, ২৯৭-ধারা অনুযায়ী সমাধিস্থানে অনধিকার এবং ২৯৮-ধারা অনুযায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিপ্রায়, ব্যক্তির শ্রুতিগোচরে কোনো শব্দ উচ্চারণ, ব্যক্তির দৃষ্টিগোচরে অঙ্গভঙ্গি বা বস্তু রাখে, তাহলে অপরাধীর সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডদানের বিধান রয়েছে।
তারা হবে 'হুকুমের আসামি' : হরতালে হত্যা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মামলায় ১৮ দলীয় জোটের নেতাদের 'হুকুমের আসামি' করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইন প্রতিমন্ত্রী।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ১৮ দলের হরতাল শান্তিপূর্ণ নয়। হরতাল আহবানকারীরা মানুষ হত্যা, জনগণের সম্পত্তি বিনষ্ট, পথেঘাটে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, ব্যবসা-বাণিজ্যে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করায় তাদের অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করছি। সারা দেশে শান্তিপূর্ণভাবে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। হরতাল আহবানকারীদের এসব ঘটনার 'হুকুমের আসামি' হিসেবে প্রতিভাত করছি।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, 'ইয়েস, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন