রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৩

নারী নিয়ে কেন টানাটানি?

জিনিয়া জাহিদ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হেফাজতে ইসলামের বহুল আলোচিত লংমার্চ শেষ হলো গতকাল ৬ এপ্রিল। অল্প কিছু নাস্তিক ব্লগারের ইসলাম অবমাননাকর অত্যন্ত আপত্তিজনক লেখার প্রতিবাদে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি নিয়েই মূলত সরকার, বিরোধীদল ও ধর্মভীরু জনগণ তাদের এই লংমার্চে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছিল।

অথচ সবার সমর্থন পেয়েও গতকালের (শনিবার) সমাবেশে সব থেকে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে ইসলাম রক্ষার মিশনে রাস্তায় নামা খোদ হেফাজত কর্মীদেরর হাতেই। স্বাধীন বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে ইসলাম হেফাজত করতে গিয়ে নারী অবমাননার চূড়ান্ত নজির স্থাপন করেছে হেফাজতে ইসলাম।

খবরে প্রকাশ, হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা গতকাল বিভিন্ন মিডিয়ার নারী সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনে শুধু বাধাই দেয় নি, সেই সঙ্গে একজন নারী সাংবাদিককে মারধর করেছে, তার কাপড়চোপড় ধরে টানাটানি করেছে।

ঘটনার শিকার একুশে টিভির সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন যিনি বর্তমানে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে চিকিত্সাধিন আছেন তার ভাষ্যানুযায়ী, “ওরা আমাকে পরিকল্পিতভাবে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছিলো। সহকর্মীরা  এগিয়ে না এলে ওরা আমাকে মেরে ফেলতো। পল্টন মোড় থেকে বিজয় নগর পর্যন্ত ওরা আমাকে মারতে মারতে ৬ থেকে ৭ বার ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে এলোপাতাড়ি লাথি মারে। যখন উঠে দৌড়াতে থাকি পেছন থেকে আবার ধাক্কা দিয়ে ফেলে  আমার মাথায় লাথি মারে। বারবার তারা আমার কাপড় টেনে হিঁচড়ে কিল ঘুষি মারতে থাকে।"

অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে লক্ষ্য করি, এই "ওরা" হলো সাদা আলখেল্লা (লম্বা পাঞ্জাবি) পরা কয়েকজন যারা গতকাল হেফাজতের সমাবেশ থেকে নাদিয়াকে বলেছিল, “আপনি মহিলা মানুষ, আপনার এখানে কি?" যারা আরও বলেছিল, "আমাদের ১৩ দফা পড়োনি? সেখানে নারী নীতিতে মেয়েদের অবাধ চলাফেরা নিষেধ করা হয়েছে।"

অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি, নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো সমাবেশ স্থলে প্রকাশ্যে একজন নারী অপদস্থ হন!! ব্যথিত হয়ে অনুভব করি, আইন-শৃঙ্খলায় নিয়োজিত বাহিনীর উপস্থিতিতেই একজন নারীর প্রাণ বিপন্ন হয়!!

যে কোনো আন্দোলনে গতি আনতে যেমন মূল দাবির সঙ্গে কিছু লেজুড় দাবি জুড়ে দেওয়া হয়, সেরকম ধর্ম নিয়ে অবমাননাকর কোনো ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তির মূল দাবির সঙ্গে বাকি দাবিগুলোকে আমরা হেফাজতের লেজুড় দাবি বলেই মনে করেছিলাম।

কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় যেভাবে তারা নারীদের আক্রমণ করেছে, যে উগ্র ভাষায় তাদের সঙ্গ তারা কথা বলেছে, তা আসলে কিসের আলামত? মুসলিমপ্রধান পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হলেও বাংলাদেশে প্রকাশ্যে এহেন নারীনিগ্রহের এই ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয়।

হেফাজতের দাবিকৃত ১৩ দফার দফা ৪ এ তারা বলেছে, "ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্জ্বলনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।"

সত্যি বলতে কি তাদের এই দফাটিকে শাহবাগকেন্দ্রিক বলেই আমরা ধারণা করেছিলাম। কারণ, কিছু কিছু পত্রিকায় শাহবাগে নারী-পুরুষের প্রকাশ্য অবস্থান নিয়ে কিছু কিছু ব্যক্তির কিছু মন্তব্য মাঝে মধ্যে দৃষ্টিগোচর হলেও তেমন একটা গুরুত্ব দিয়ে খবরগুলোতে চোখ রাখার প্রয়োজনবোধ করিনি।

এ  দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলের নেত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রিপরিষদ, উচ্চ আদালত, সামরিক বাহিনী, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী, খেলাধুলা থেকে শুরু করে কৃষক, শ্রমিক, মজুর হেন পেশা নেই যেখানে নারীর বিচরণ নেই। এমন একটি দেশে হঠা‍‍ৎ করেই কিছু "সাদা আলখেল্লা পরা কয়েকজন" কিভাবে পেশাগত দায়িত্বরত নারীদের অপদস্থ করার সাহস পায়? কিভাবে তারা নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণকে রুখবে বলে হুমকি দেয়? ইসলামকে হেফাজতের বড় বড় বুলি আউড়িয়ে কিভাবে তারা বেগানা নারীর গায়ে হাত দেয়?

বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মপালনে এখানে কোনো জোরজবরদস্তি নেই। কে দাড়ি রাখবে কে রাখবে না সেটা যেমন এখানে ব্যক্তির উপর নির্ভর করে, ঠিক তেমনি কে পর্দা করবে কে করবে না, সেটাও একজন নারীর উপর নির্ভর করে। এ দেশের কোথাও লেখা নেই নারী-পুরুষ অবাধে বিচরণ করতে পারবে না, কাজ করতে পারবে না। কোথাও লেখা নেই মাথায় কাপড় দিতে হবে, কোথাও বলা নেই অমুক জায়গায় নারীদের যাওয়া বারণ। এদেশে সংসদে বসে নারী-পুরুষ একসঙ্গেই দেশের নীতি-নির্ধারণ করে থাকে।

তবে হঠাৎ করেই ইসলাম রক্ষার দাবিদার এই হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার মাঝে নারী নিয়ে টানাটানি কেন? উদ্দেশ্য কি?

হেফাজতে ইসলামের কাছে জানতে চাই, বিনা অপরাধে প্রকাশ্যে মা-বোনের অপমান কেন করা হলো? হেফাজতকে সার্বিক সমর্থন দেওয়া আমাদের দেশের কাণ্ডারী দুই নারী মাননীয় শেখ হাসিনা এবং মাননীয় খালেদা জিয়ার কাছে প্রকাশ্যে নারী নিগ্রহের এই ঘটনায় তাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাই। আরও জানতে চাই আমরা বাঙালি নারীরা কি শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতি সব বিষয়ে অগ্রসর হয়ে এগিয়ে যাবম নাকি সাদা আলখেল্লা পরা ওই মাদ্রাসা পড়ুয়া কিশোরের চড়-থাপ্পর-লাথি খেয়ে ১৩ দফার মারপ্যাচে পড়ে আফগানিস্থানের নারীদের মত ঘরে বসে থাকব? আপনাদের কাছে জবাব চাই, জবাব দিতেই হবে।

অনেক কষ্টে পাওয়া স্বাধীন এই দেশটায় আমাদের আজকের নারীদের যে অবস্থান সেখানে ধর্মান্ধতার নামে আমাদের ঘরে বন্দি করে রাখার হুমকি কখনই বাস্তবে রূপ নেবে না। শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও আমরা তা প্রতিহত করে যাব।

অজস্র সমস্যা সংকুল এই দেশটাকে পেছনের দিকে না টেনে সবাইকে একযোগে কাজ করে এগিয়ে নিতে দিন। নারীপ্রধান সরকারের কাছে নারীবিদ্বেষী দাবি নিয়ে নতুন কোনো সমস্যার সৃষ্টি না করাই হবে সবার জন্য মঙ্গলকর।
Jiniea-sm
জিনিয়া জাহিদ: বাংলাদেশের স্বনামধন্য এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নরওয়ে থেকে "ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স ইকনমিক্স" বিষয়ে এমএস শেষ করে অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি করছেন। সেখানে বাংলাদেশের "খাদ্য নীতি"নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি এক বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন