বুধবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৩

গণতান্ত্রিক আন্দোলন না, জনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ?

পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক দেশেই বিরোধী দল সরকারবিরোধী আন্দোলন করে থাকে। কেননা সরকার পারিচালনায় সরকারি দল যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে, বিরোধী দলের পক্ষের তার সঙ্গে একমত হওয়া সম্ভব নয়। তাই যেখানে মতের বিরোধিতা সেখানেই দাবি আদায়ের আন্দোলন। আন্দোলনের লক্ষ্যÑ সরকারকে বিরোধী দলের যুক্তিসঙ্গত দাবি মেনে নিতে বাধ্য করা। প্রত্যুত্তরে সরকার গৃহীত পদক্ষেপসমূহের যৌক্তিকতা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন এবং কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। সরকার ও বিরোধী দলের এই নীতিগত বিরোধ একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব সময় সহনীয় পর্যায়ে রাখা হয়। একটা সীমারেখা থাকে যা সরকার বা বিরোধী দল কেউ অগ্রাহ্য করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না। এভাবেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সমঝোতা ভিত্তিক বিরোধী দল ও সরকার কাজ করে থাকে।
সংসদই হচ্ছে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকল ক্রিয়াকর্মের কেন্দ্রবিন্দু। জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা সেখানে প্রতিনিধিত্ব করেন। সরকার ও বিরোধী দল সম্মলিতভাবে সংসদকে কার্যকর রাখে। সংসদ পরিচালনা পদ্ধিতিতে এমন সব বিধিনিষেধ আছে যা সরকার ও বিরোধী দল উভয়কেই মেনে চলতে হয়। অধ্যক্ষ প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবে সংবিধান অনুযায়ী সংসদকে পরিচালনা করেন। তাই সংসদে দীর্ঘমেয়াদি অনুপস্থিতির কোনো সুযোগ নেই। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংসদ যে দায়িত্ব পালন করেন তাতে সরকার ও বিরোধী দল উভয়েরই অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে সরকার যদি এককভাবে আইন প্রণয়ন করেন এবং বিরোধী দলের সেখানে সংশ্লিষ্টতা না থাকে তাহলে সে আইন সার্বিক অর্থে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা ঠিকভাবে পরিণত হয়েছে বলে মনে করা ঠিক হবে না। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে বিরোধী দল কোনো প্রকারের সহযোগিতা না করে সংসদের বাইরে থেকে ক্ষমতাসীন দলকে এককভাবে আইন প্রণয়নে বাধ্য করছে। সংসদে উপস্থিত না হয়ে সংসদীয় বিষয় রাজপথে এনে সেই বিষয়ভিত্তিক সংঘাত ও দ্বন্দ্ব অনিবার্য করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম অবনতি ঘটিয়ে, সরকারকে অচল করে দেয়ার অপপ্রায়াস কখনো গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হতে পারে না। অথচ বাংলাদেশে এটাই হচ্ছে বর্তমান বাস্তবতা। আমরা যদি বিরোধী দলের আন্দোলনের প্রতি দৃষ্টিপাত করি তাহলে দেখা যাবে এই আন্দোলন প্রথম দিন থেকে সহিংস ছিল। জ্বালাও পোড়াও এই যদি আন্দোলনের লক্ষ্য হয় তবে তাকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলা যাবে কী করে? বিগত চার বছর এবং সাস্প্রতিক কয়েক মাসের আন্দোলনে যানবাহন ও বিষয় সম্পত্তির যে ক্ষতিসাধন করা হয়েছে তা সহস্র কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করা রেল কোচ ও সিএনজি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। রেললাইন তুলে ফেলা হচ্ছে। রেলস্টশনে আগুন দেয়া হচ্ছে। মূল্যবান অত্যন্ত জরুরি রেলওয়ে সিগনাল সিস্টেম ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে।

প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত রেলওয়েকে সরকার সংস্কার করে যখন সচল করে তুললেন ও সক্রিয় করে তুললেন। যে ভাবে যাতায়াত ব্যবস্থা স্বল্প খরচে যাতায়াত সহজলভ্য করলেন। তা এখন সত্য সত্যই বিপন্ন। দীর্ঘ পথে রেলে ভ্রমণে মানুষ এখন আতঙ্কিত। কারণ কখন দুর্ঘটনা ঘটবে। তুলে ফেলা রেল লাইনে ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হবে, রেলস্টেশনে হঠাৎ করে আক্রমণ করা হবে, ব্রিজ ভেঙে ফেলা হবে, যাত্রাপথে কখন অগ্নিসংযোগ করা হবে, এ কথা কেউই বলতে পারবে না। রাজপথে তো কথাই নেই। যে সব যানবাহন, মিনিবাস, সিএনজি, বিআরটিসি কোচ বিদেশ থেকে আমদানি করে যানবাহন সিস্টেমে যাতায়াতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা হয়েছিল কম হলেও ওই সব আমদানিকৃত যানবাহনের তার ৫ ভাগ এতোদিনে অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস করা হয়েছে। কতো যে প্রাইভেট কার ও সরকারি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে তার হিসাব নেই। ট্রাক মিনিবাস রিকশাতে আহরহ অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। বিন্দুমাত্র দেশপ্রেম থাকলে কেউ এভাবে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে আমদানি করা এই কোচ, বাসে অগ্নিসংযোগ করে ভস্মীভূত করতে পারতো না। দেশের সম্পদের প্রতি কোনো মমত্ববোধ থাকলে এ ধরনের জঘন্য পরিচালনা করা সম্ভব হতো না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ না করা হলে এবং ট্রাইব্যুনাল বাজেয়াপ্ত করে তাদের মুক্তি না দিলে, গৃহযুদ্ধ শুরু করা হবে। এরূপ হুমকি দিয়েই জামাত-শিবির চক্র যে সহিংস তৎপরতা শুরু করেছে এবং তার ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে তা ভেবে সকলেই আজ উদ্বিগ্ন। যে গার্মেন্টে উৎপাদিত পোশাক রপ্তানি করে আমরা বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার আয় করি এবং যেখানে ৬০-৭০ লাখ শ্রমিক বিশেষ করে মহিলা শ্রমিক এই পেশায় নিয়োজিত আছে। সেই গার্মেন্ট শিল্পের আজ রপ্তানি প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। গার্মেন্ট মালিকরা ইতোপূর্বে আহাজারি শুরু করছে। পরিণতি যে কী ভয়াবহ হতে পারে তা তারা বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন।

এ কারণে গার্মেন্ট শিল্পসমূহ বন্ধ হলে দেশের লাখ লাখ শ্রমিক চাকরি হারাবে। বহির্বিশ্বে এ দেশের গার্মেন্ট শিল্প একবার রপ্তানি বাজার হারালে পরে সেই বাজার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা কি সম্ভব হবে? এ ব্যাপারে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনা করে হরতাল অবসানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। গতবার ইরি-বোরো উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ কোটি টন অর্থাৎ মোট প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের দুই-তৃতীয়াংশ। আর এবার বিদ্যুৎ সার সেচসহ প্রয়োজনীয় কৃষি সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা বিঘিœত হচ্ছে। যেভাবে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত করা হয়েছে তাতে মনে হয় এ বছর ২৫-৩০ লাখ টন ইরি বোরো ফসল উৎপাদন কম হতে পারে। আর তাই যদি বাস্তবতা হয় এবং দেশে এবার যদি ওই পরিমাণ খাদ্য আমদানি করতে হয় তাহলে দেশে এক চরম সংকটের সৃষ্টি হবে। নগদ অর্থে ২৫-৩০ লাখ টন খাদ্যশস্য ক্রয় করতে হলে আমাদের আমদানি ব্যয়ও অনুপাত হারে কমিয়ে আনতে হবে। বিশ্বব্যাপী মন্দা ও মুদ্রাস্ফীতি অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ যেভাবে বিগত চার বছর তার অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে সক্ষম হয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে জিডিপির হার ৬ পয়েন্টের উপরে রাখতে সক্ষম হয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা সকল মানুষের জন্য নিশ্চিত করেছে কৃষি শ্রমিকদের মাথাপিছু আয় প্রায় দ্বিগুণ করতে সক্ষম হয়েছে। খাদ্যশস্যের মূল্য স্থিতিশীল রেখে কৃষকরা অর্থনৈতিক অবস্থা সচল রেখেছে। খাদ্যশস্যের আমদানি প্রায় বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে তা নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবি রাখে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিদ্যুৎ খাতে যে অকল্পনীয় উন্নয়ন সাধিত হয়েছে তা নিশ্চয়ই বর্তমান সরকারের দৃশ্যমান একের পর এক সফলতার প্রমাণ। এ কথা সত্য বিরোধী দলের সহিসং জঙ্গিবাদী তৎপরতা, দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির চেষ্টা, উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সরকারকে শুরু থেকেই যুক্তিহীন বিরোধিতা ও সরকারি কর্মকা-কে স্তব্ধ করার ষড়যন্ত্রসহ বিরোধী দলের নানা ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হতে না হলে সরকার দেশে যতোটুকু উন্নয়ন অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন তার থেকে দ্বিগুণ উন্নয়ন করতে পারতেন। একটা দেশে বিরোধী দলের লক্ষ্যই যদি থাকে সরকারকে কাজ করতে না দেয়া। উন্নয়ন তৎপরতা ব্যাহত করা। অগণতান্ত্রিকভাবে সহিংস তৎপরতার মাধ্যমে সরকারের সকল কাজের প্রতিরোধ করা। তাহলে উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করা সম্ভব কি? এতো সত্ত্বেও শেখ হাসিনার সরকার যুক্তিহীন সহিংসতা ও নিরন্তর বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েও যথাযথভাবে বিরোধী দলকে নিয়ন্ত্রণে রেখে উন্নয়ন তৎপরতা দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। এ কারণেই বিরোধী দলের গাত্রদাহ। শিক্ষাক্ষেত্রে কেন বিপ্লব সংঘটিত হলো। কৃষিক্ষেত্রে দেশ কেন স্বয়ংসম্পূর্ণ হলো। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প কেন বাস্তবায়িত হলো। স্বাস্থ্যসেবা কেন জনগণের দোরগোড়ার পৌঁছে দেয়া হলো। আন্তর্জাতিক পরিম-লে দেশের ভাবমূর্তি কেন উজ্জ্বল হলো। উন্নয়নের সকল সূচকসমূহ কেন উন্নতি হলো? দারিদ্র্য নিয়ন্ত্রণে কেন দেশ সফলতা অর্জন করলো। আন্তর্জাতিক শন্তি রক্ষার তৎপরতায় কেন বাংলাদেশ সফলতার সঙ্গে অংশ নিলো। জাতিসংঘ কেন বাংলাদেশের উন্নয়ন নীতি অনুমোদন করলো। কেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক পরিম-লে মর্যাদা সম্পন্ন স্বীকৃতি পেলেন। এর সব কিছুতেই বিরোধী দল ক্ষুব্ধ। তাই তাদের প্রয়োজন সরকারের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করা। সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করা। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে হেয় করতে, শেখ হাসিনার অসামান্য সফলতাকে ব্যর্থ বলে প্রমাণ করতে হলে এবং তা করতে হলে অভ্যন্তরীণভাবে যা করতে হয় বর্তমান বিরোধী দল তাই করে চলেছে।

একটা সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশে সংসদে না গিয়ে, আলাপ-আলোচানা না করে রাজপথে সহিংস তৎপরতা চালিয়ে, ক্ষমতা দখল যা নাকি বর্তমান বিরোধী দলের একমাত্র লক্ষ্য তা সফল হলে দেশ কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাবে তা কি তারা ভেবে দেখেছেন। এখন নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে না। তত্ত্বাবধায়কের কথাও নয়। এখন একমাত্র দাবি সরকারের পতন। সেই লক্ষ্যে বিরোধী দল ও তার সহযোগীরা কাজ করে যাচ্ছে। তাদের ভাষায় তারা ইতোপূর্বে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। এমতাবস্থায় তাদের গণতান্ত্রিক মতে ও পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব কি? যারা সমঝোতার কথা বলেন তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে বিরোধী দলকে গৃহযুদ্ধের অবস্থান থেকে ফিরিয়ে আনা। তার পরই কেবল আলোচনা সম্ভব।

বিরোধী দল জানে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে হলে এই সরকারের পতন ঘটাতে হবে। তাই ওটাই তাদের এখন মূল লক্ষ্য। তারা সেই লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বিরোধীদলীয় নেতা যে সব উসকানিমূলক উক্তি করে চলেছেন, তা দেশ, জাতি ও গণতন্ত্রের জন্য ভয়াবাহ হতে পারে বলেই মনে হয়।

ডা. এস এ মালেক : কলাম লেখক।
ভোরের কাগজ : বুধবার, ৩ এপ্রিল ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন